বিজ্ঞাপন
default-image

বুদাপেস্টে শান্তি সম্মেলনে যোগ দিতে বাংলাদেশ সরকারের একটি প্রতিনিধিদল এদিন ভারত থেকে হাঙ্গেরির উদ্দেশে রওনা হয়। প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন আবদুস সামাদ আজাদ। ১২ মে থেকে বুদাপেস্টে শুরু হওয়া এই শান্তি সম্মেলন শেষে প্রতিনিধিদলটি বাংলাদেশ সরকারের বক্তব্য বিশ্বের জনগণের কাছে তুলে ধরার জন্য এশিয়া, পশ্চিম ও পূর্ব ইউরোপের কয়েকটি দেশসহ সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র সফর করবে।

বিভিন্ন দেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করার জন্য প্রতিনিধিদলটি বাংলাদেশ সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের চিঠি নিয়ে যায়। চিঠিতে পাকিস্তানিদের শোষণ ও অত্যাচারের ফলে বাংলাদেশের বর্তমান আন্দোলন গড়ে ওঠার পূর্বাপর ব্যাখ্যা করা হয়।

হাঙ্গেরি রওনা দেওয়ার আগে প্রতিনিধিদলের নেতা আবদুস সামাদ আজাদ জাতিসংঘ মহাসচিব উ থান্টসহ বিশ্বশক্তির কাছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন রক্ষা এবং তাঁর মুক্তির আবেদন জানান। তিনি আশা প্রকাশ করেন, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের বক্তব্য শুনবেন।

বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১০ মে দেশবাসীর উদ্দেশে দেওয়া বেতার ভাষণে বলেন, বাংলাদেশ আন্দোলনকে সারা বিশ্বের মানুষ সমর্থন জানিয়েছেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন, বিভিন্ন দেশও শিগগিরই বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেবে।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেশবাসীকে আশ্বাস দেন, আওয়ামী লীগের দেওয়া প্রতিশ্রুতি অক্ষরে অক্ষরে পালিত হবে। বাংলাদেশ সরকার বৃহৎ শিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত করবে। তিনি বাংলাদেশের তরুণদের মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে এবং চূড়ান্ত সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হতে আবেদন জানান।

মুক্তিবাহিনীর প্রধান কর্নেল এম এ জি ওসমানী ভূরুঙ্গামারীর মুক্তাঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি পরিদর্শন করেন। মুক্তিযোদ্ধারা তাঁকে গার্ড অব অনার দেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে আমার লোকের সামনে কথা বলতে পারছি, এ আমার গর্ব।’

কলকাতায় ওয়েস্ট বেঙ্গল ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিল, ক্যালকাটা অ্যাসোসিয়েশন অব ওয়ার্ল্ড ফেডারেলিস্টস এবং বাংলাদেশ সংগ্রাম সহায়ক সমিতির টালিগঞ্জ শাখার সদস্যরা বাংলাদেশ মিশনের প্রধান এম হোসেন আলীর সঙ্গে দেখা করেন। সমিতির পক্ষ থেকে ভারত–বাংলাদেশ সীমান্তে কয়েকটি ব্যবসাকেন্দ্র খুলে দুই দেশের মধ্যে বিনিময় প্রথার মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী লেনদেনের প্রস্তাব দেওয়া হয়।

ফিলিপস ইন্ডিয়া লিমিটেডের কারখানা কর্মচারীরা বাংলাদেশ থেকে আসা দুর্গতদের সাহায্যার্থে বাংলাদেশ সরকারের ত্রাণ তহবিলে অর্থসহায়তা করেন। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে মিশনের প্রধান এম হোসেন আলী সে অর্থ গ্রহণ করেন।

প্রবাসে বাংলাদেশের সমর্থনে

ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টি এই দিন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন সমর্থন করার জন্য ব্রিটেনের শ্রমিক ও প্রগতিশীল শক্তির প্রতি আবেদন জানায়।

ওয়ার্ল্ড কাউন্সিল অব চার্চেস ভারতে আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশের শরণার্থীদের অর্থসহায়তা পাঠায়।

টাইম ম্যাগাজিন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ‘পাকিস্তান: অপমান না যুদ্ধ’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। নিউইয়র্ক টাইমস প্রকাশ করে ‘ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ড’ শিরোনামে অন্য একটি প্রতিবেদন।

ভারতে বাংলাদেশের পক্ষে

আসামের মুখ্যমন্ত্রী মহেন্দ্রমোহন চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ থেকে ব্যাপকহারে আসা শরণার্থীদের কারণে আসামের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভারসাম্য বিপর্যস্ত হতে পারে।

ভারতের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা দপ্তরের মন্ত্রী দেবীপ্রসাদ চ্যাটার্জি এদিন কলকাতায় সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ে আসা শরণার্থীদের ত্রাণের জন্য টাকার অভাব হবে না। শরণার্থীদের জন্য ৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যে ১ কোটি ২০ লাখ টাকার ওষুধপত্র মঞ্জুর করেছে। অবস্থার গুরুত্ব বুঝে ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল চালু করা হবে।

পশ্চিমবঙ্গের দুর্গাপুরে এক সভায় পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিরোধী দল সিপিএমের নেতা জ্যোতি বসু বাংলাদেশ সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দিতে ভারত সরকারের প্রতি দাবি জানিয়ে একটি প্রস্তাব নেন। তিনি এ প্রস্তাব বাস্তবায়নে কোয়ালিশন সরকারের শরিক দলের আন্তরিকতায় সন্দেহ জানান।

কলকাতায় অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত প্রাথমিক শিক্ষক ফেডারেশনের সভায় বাংলাদেশের ব্যাপারে জাতিসংঘের নীরবতার সমালোচনা করে জাতিসংঘকে সচেতন করে তুলতে জনমত সৃষ্টির জন্য বিশ্বের শিক্ষকদের প্রতি আবেদন জানানো হয়।

অবরুদ্ধ বাংলাদেশে

ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান বলেন, সশস্ত্র প্রতিরোধ নির্মূল করা হয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিক্ষিপ্তভাবে সন্ত্রাস চললেও তা নির্মূল করতে বেশি লাগবে না।

এই দিন কক্সবাজারের পতন ঘটে। হাতিয়ায়ও মুক্তিবাহিনীর ওপর একটি পাকিস্তানি সেনাদল আক্রমণ করার পর দুই পক্ষে যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের অতর্কিত আক্রমণে রাজশাহীর চারঘাটে পুলিশ স্টেশন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এই দিন কুমিল্লা, খুলনা, যশোর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নাটোর, বরিশাল, পটুয়াখালীসহ কয়েকটি এলাকায় শান্তি কমিটির শাখা গঠিত হয়।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর এক, সাত ও নয়; মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি: যুক্তরাজ্য, আবদুল মতিন, সাহিত্য প্রকাশ; পূর্বদেশ, ১১ মে ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত, ১১ মে ১৯৭১


গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান