বিজ্ঞাপন
default-image

যুক্তরাজ্যের দ্য টাইমস–এ ৭ আগস্ট পিটার হ্যাজেলহার্স্টের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। তাঁর নিবন্ধে বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশের সাম্প্রতিক নানা পদক্ষেপ পর্যালোচনা করা হয়।

পিটার হ্যাজেলহার্স্ট লেখেন, মস্কো ও দিল্লির মধ্যে সম্প্রতি নেওয়া কয়েকটি রাজনৈতিক পদক্ষেপ ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আশঙ্কা বাড়িয়ে দিতে পারে। প্রথমত, সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী গ্রোমিকো অপ্রত্যাশিতভাবে দিল্লি সফরের ঘোষণা দেওয়ায় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শিগগিরই শুরু হবে, এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ে। ভারতের রাজনৈতিক মহল মনে করে, এই সফরের ফলে ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ক নিকটতর বলে প্রমাণিত হবে এবং সম্ভাব্য আক্রমণকারীরা তা বিবেচনায় নেবে। দ্বিতীয়ত, ভারত সরকারের প্রবীণ কূটনীতিক ডি পি ধরকে গোপন আলোচনার জন্য মস্কো পাঠানো হয়। তৃতীয়ত, বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও তাঁর সহকর্মীরা দিল্লি সফরে গিয়ে ইন্দিরা গান্ধী এবং ভারতীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে
গোপন বৈঠকে করেছেন। এ ছাড়া ১ আগস্ট ভারতের পররাষ্ট্রসচিব টি এন কাউল, সাবেক রাষ্ট্রদূত ডি পি ধর এবং দুজন প্রবীণ সামরিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা ভারতে নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত নিকোলাই পেগভের সঙ্গে গোপনে সভা করেন।

লন্ডনের একটি কূটনৈতিক মহল এই দিন সাংবাদিকদের জানায়, তাদের ধারণা, বাংলাদেশের স্বীকৃতি আসন্ন। সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রে গ্রোমিকোর দিল্লি সফর বিষয়টিকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। গ্রোমিকোর দিল্লি সফরের পরপরই বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের ঘোষণা শোনা যেতে পারে।

default-image

গ্রোমিকোর সফরের প্রেক্ষাপট

ভারতের রাজধানী দিল্লিতে একজন সরকারি মুখপাত্র এদিন সাংবাদিকদের বলেন, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বারবার যুদ্ধের হুমকি দিতে থাকার প্রেক্ষাপটে আলোচনার উদ্দেশ্যেই সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রে গ্রোমিকো ভারত সফরে আসছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন চীন সফরে যাবেন, এই ঘোষণার পরপরই দিল্লি ও মস্কোতে কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে আন্দ্রে গ্রোমিকোর ভারতে আসার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়।

দিল্লিতে জনসংঘের নেতা–কর্মীরা এদিন পাকিস্তান হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়া সত্ত্বেও মিছিলকারীরা এক ঘণ্টা অবস্থান করেন।

পাকিস্তান সরকারকে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সরবরাহের প্রতিবাদে সমাজবাদী যুব জনসভার পক্ষ থেকে কলকাতায় যুক্তরাষ্ট্রের কনস্যুলেটের সামনে এদিন বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়। বিক্ষোভকারীদের একটি প্রতিনিধিদল কনস্যুলেটে গিয়ে স্মারকলিপি পেশ করে।

কলকাতায় বুদ্ধিজীবী সমাবেশ

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজধানী কলকাতায় জওহরলাল নেহরু রোডের পাশের ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবিতে ৭ আগস্ট শিল্পী-সাহিত্যিকদের সমাবেশ হয়। এই সমাবেশে জনসমাগমও হয় ব্যাপক। সমাবেশ শেষ হওয়ার পরও সেখানে মানুষ আসতে থাকেন।

সমাবেশে শিল্পী-সাহিত্যিকদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, অন্নদাশঙ্কর রায়, মনোজ বসু, বিমল কর, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সন্তোষকুমার ঘোষ, রমাপদ চৌধুরী, সাগরময় ঘোষ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, মনীন্দ্র রায়, চিন্মোহন সেহানবীশ, কানন দেবী, মাধবী চক্রবর্তী, উৎপলা সেন, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, অজয় কর প্রমুখ। সমাবেশে সমবেত কণ্ঠে গান করেন উৎপলা সেন, সতীনাথ মুখোপাধ্যায় ও অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়।

বাংলাদেশকে সাহায্যের জন্য ন্যাপের আবেদন

ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ৭ আগস্ট মুক্তাঞ্চল থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে পাকিস্তানি সামরিক চক্রকে সাহায্যকারী যুক্তরাষ্ট্র ও চীন সরকারের ভূমিকা সম্পর্কে সবাইকে সতর্ক করেন। তিনি বিশ্বের গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল দেশগুলোর কাছে বাংলাদেশ সরকারকে প্রয়োজনীয় সামগ্রী এবং নৈতিক সমর্থন দিয়ে সাহায্য করার জন্য আবেদন জানান।

মুক্তিবাহিনীর ৭ নম্বর সেক্টরের গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল বগুড়া জেলার পূর্ব অংশে সাবগ্রাম নামে একটি এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি লরি অ্যামবুশ করে। লরিটি ক্ষতিগ্রস্ত এবং কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সাত; মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি: যুক্তরাজ্য, আবদুল মতিন, সাহিত্য প্রকাশ; আনন্দবাজার পত্রিকাযুগান্তর, ভারত, ৮ ও ৯ আগস্ট ১৯৭১; দ্য টাইমসদ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ, ব্রিটেন, ৭ আগস্ট, ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান