বিজ্ঞাপন
default-image

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের দলনেতা এবং যুক্তরাজ্য ও বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ২৬ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে বার্তা সংস্থা পিটিআইকে এক সাক্ষাৎকারে জাতিসংঘের সদস্যদেশগুলোর প্রতি আবেদন জানিয়ে বলেন, তারা যেন নিয়মকানুনের খুঁটিনাটিতে আটকে না থেকে সত্য, ন্যায় ও মানবতার স্বার্থে বাংলাদেশ নামে বাস্তবতার দিকে দৃষ্টিপাত করে। তাকে স্বীকৃতি দেয়। বাংলাদেশের মানুষ মরিয়া হয়ে লড়ছে। তারা জিতবেই।

গেরিলা অভিযান

১ নম্বর সেক্টরের একদল গেরিলা মুক্তিযোদ্ধার অ্যামবুশে এ দিন ফেনীতে ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কসংলগ্ন দেবীপুরে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। এই সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল আন্ধারমানিক সীমান্তঘাঁটিতে আক্রমণ করলে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।

পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের একটি দল লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ বাজারের দিকে অগ্রসর হয়। খবর পেয়ে মুক্তিবাহিনীর একটি দল রামগঞ্জ বাজারের পূর্বদিকে অ্যামবুশ পাতে। অ্যামবুশের আওতায় এলে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ওপর আক্রমণ চালান। এতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়।

২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল গোপালগঞ্জের রায়চন্দ্রপুরে মধুমতী নদীতে পাকিস্তানিদের খাদ্যবোঝাই কয়েকটি নৌকার ওপর অভিযান চালায়। পাকিস্তানি বাহিনীর দুটি নৌকা ডুবে যায় এবং কয়েকজন রাজাকার ও পাঞ্জাবি পুলিশ হতাহত হয়।

৪ নম্বর সেক্টরে একদল মুক্তিযোদ্ধা কুমারশৈল চা–বাগানে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর এক অভিযান চালান। দুই পক্ষে প্রায় আড়াই ঘণ্টা সংঘর্ষে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়।

৭ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল রাজশাহী সীমান্তে একদল পাকিস্তানি সেনার ওপর অতর্কিতে হামলা করলে দলটির বেশির ভাগ সদস্য হতাহত হন। এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা রাজশাহী শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে চারঘাটের সারদায় পদ্মা নদীর তীরে মুক্তারপুর এলাকায় রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের (তখন আইয়ুব ক্যাডেট কলেজ) কাছে দুটি বিদ্যুৎ পাইলন (টাওয়ার) ক্ষতিগ্রস্ত করেন।

৮ নম্বর সেক্টরের বানপুর সাবসেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা চুয়াডাঙ্গায় পাকিস্তানি বাহিনীর দত্তনগর ঘাঁটি আক্রমণ করেন। সংঘর্ষে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়।

বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে সম্মেলনের প্রস্তাব

ভারতের রাজধানী দিল্লিতে ‘নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর বৈপ্লবিক মতবাদ ও বাংলাদেশ’ শীর্ষক আলোচনাচক্রে প্রস্তাব নেওয়া হয়, বাংলাদেশ সমস্যা পর্যালোচনার জন্য এশীয় দেশগুলোর সম্মেলন ডাকা হোক। প্রস্তাবে বলা হয়, ভারত উপমহাদেশে শান্তি বিঘ্নকারী বাংলাদেশ সমস্যা আলোচনার জন্য চীন, জাপানসহ এশিয়ার সব দেশকে আমন্ত্রণ জানানো উচিত। আরেকটি প্রস্তাবে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতিদান এবং বিনা শর্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি দাবি করা হয়।

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজধানী কলকাতায় ভারতীয় ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের বার্ষিক সভায় সবার সম্মতিতে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামীদের সাহায্যার্থে এবং প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের জন্য অর্থ সংগ্রহে ভারতীয় ক্রিকেট দল বাছাই একাদশের সঙ্গে তিন-চারটি প্রদর্শনী ম্যাচ খেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

জলন্ধর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে মার্ক্সবাদী পরিচালিত সর্বভারতীয় কিষান সভার ২১তম বার্ষিক অধিবেশনে কেন্দ্রীয় সরকারকে অবিলম্বে বাংলাদেশকে স্বীকৃতির দাবি জানানো হয়। এক প্রস্তাবে বলা হয়, ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তির পর সব দ্বিধা মুছে ফেলা উচিত। অধিবেশনে সিপিএম নেতা জ্যোতি বসু পরে সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সব ধরনের এমনকি অস্ত্র ও গোলাবারুদ দিয়েও সাহায্য করা উচিত। মুক্তিবাহিনী এখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধে সক্ষম।

পাকিস্তানে, অবরুদ্ধ বাংলাদেশে

অবরুদ্ধ বাংলাদেশে পাকিস্তানি অনুগত গভর্নর ডা. আবদুল মোত্তালিব মালিক মুক্তিযুদ্ধবিরোধী প্রচারণা চালানোর উদ্দেশ্যে এই দিন রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রে একটি বিশেষ অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি ছাত্রদের কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মকাণ্ডে অংশ না নেওয়ার আহ্বান জানান।

পাকিস্তানের করাচিতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কাউন্সিল অধিবেশনে নেওয়া এক প্রস্তাবে অবিলম্বে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি দাবি করা হয়।

জমিয়তে উলামা ইসলামের (হাজারভি) সাধারণ সম্পাদক মুফতি মাহমুদ পশ্চিম পাকিস্তানের সারগোদায় এক সংবাদ সম্মেলনে উপনির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য অবিলম্বে রাজনীতির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আহ্বান এবং পশ্চিম পাকিস্তানে বেসামরিক সরকার গঠনের দাবি জানান। সভায় দলের পশ্চিম পাকিস্তান শাখার সাধারণ সম্পাদক গাউস হাজারভি বলেন, রাজাকার বাহিনীতে শুধু জামায়াতের লোক নেওয়া হয়েছে। এতে পাকিস্তানপন্থী অন্য দলের কর্মীদেরও নেওয়া উচিত।

উপমহাদেশের বাইরে

ভারত সফর শেষে জাপানে ফিরে দেশটির সংসদীয় প্রতিনিধিদলের নেতা সাকুরাউচি এ দিন টোকিওতে সাংবাদিকদের কাছে এক বিবৃতিতে বলেন, ভারতে তিনি শরণার্থীশিবির ঘুরে ঘুরে শরণার্থীদের দেখে অভিভূত। জাতিসংঘ বা অন্য কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থার এ সমস্যা সমাধানের ভার নেওয়া উচিত। এ দায়িত্ব সারা বিশ্বের। সাকুরাউচি জানান, তিনি অবিলম্বে সরকারের কাছে তাঁর প্রতিবেদন পেশ করবেন।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: দলিলপত্র, দশম খণ্ড; দ্য গার্ডিয়ান, ২৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১; ইত্তেফাকদৈনিক পাকিস্তান, ঢাকা, ২৭ ও ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকাযুগান্তর, কলকাতা, ভারত, ২৭ ও ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান