‘বন্ধু নয়, ভাই। ভাই বিপদে পড়েছে। ভাইয়ের পাশে ভাই আছে এবং চিরকাল থাকবে।’ বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ অন্য মন্ত্রী ও জাতীয় পরিষদ সদস্যদের সঙ্গে দুই দিন ধরে দফায় দফায় বৈঠকের পর ডি পি ধর ১৭ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় কলকাতায় সাংবাদিকদের কাছে এ মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখন একটি বাস্তবতা, এই সত্য সব দেশের মেনে নেওয়া উচিত। ডি পি ধর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারণী কমিটির চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ বিষয়ে বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত।
ডি পি ধর জানান, তিনি রাতেই দিল্লি ফিরে যাচ্ছেন। সেখানে তিনি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা এবং মুক্তিবাহিনীর সাফল্য নিয়ে একটি প্রতিবেদন দেবেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকারের স্বার্থে প্রয়োজন দেখা দিলেই স্বীকৃতি দেওয়া হবে।
ভারতের পররাষ্ট্রসচিব টি এন কাউল এ দিন নিউইয়র্কে জাতিসংঘের এক সভায় নিরপেক্ষ গোষ্ঠীকে জানান, বাংলাদেশের শোচনীয় মানবিক বিপর্যয় সম্পর্কে এই গোষ্ঠী সুস্পষ্ট মতামত জানাতে না পারলে ওই সব নিরপেক্ষ দেশের মন্ত্রী সম্মেলনে ভারত যোগ না-ও দিতে পারে। নিরপেক্ষ দেশগুলোর দ্বিতীয় অধিবেশনে বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের কঠোর
মনোভাব জানাতে তিনি এই আলোচনায় অংশ নেন। এক সপ্তাহ পর নিরপেক্ষ গোষ্ঠীর মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন হওয়ার কথা।
ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণের কাছে পাঠানো বার্তায় বলেন, বাংলাদেশ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্মেলন আন্তর্জাতিক সমাজের বিবেককে জাগাতে সাহায্য করবে। বাংলাদেশ সমস্যার সমাধানের পথ সন্ধান শিগগিরই পাওয়া যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দিল্লিতে তাঁর বাসভবনে লোকসভার সদস্য প্রবোধ চন্দ্রের বাংলাদেশ রক্তস্নান বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন। অনুষ্ঠানে ইন্দিরা কয়েকজনকে বইটি উপহার দেন। প্রবোধ চন্দ্র বলেন, বই বিক্রির অর্থ বাংলাদেশের কল্যাণে ব্যয় করা হবে।
ভারতের লোকসভার সদস্য এবং বাংলাদেশের জন্য জাতীয় সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক সমর গুহ দিল্লিতে সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠনের জন্য ডি পি ধর ও টি এন কাউলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, সোভিয়েত সমর্থন লাভের নামে তাঁরা বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বে পরিবর্তন ঘটানোর চেষ্টা করছেন।
দিল্লিতে দেশি-বিদেশি কূটনৈতিক মহল এ দিন সাংবাদিকদের জানায়, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বৈঠক যত এগিয়ে আসছে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য পাকিস্তানের ওপর চাপ তত বাড়ছে। ওই মহল আরও বলে, এটা খুব অস্বাভাবিক ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যে গত ১৫ সেপ্টেম্বর মস্কোতে আফগানিস্তানের রাজার সম্মানে আয়োজিত ভোজসভায় সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোর্নি আচমকা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাধানের জন্য আহ্বান জানান। ভারত নিউইয়র্কে জোটনিরপেক্ষ দেশগুলোকে বাংলাদেশ প্রশ্নে একমত করার চেষ্টা করছে। এ ছাড়া শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির প্রশ্নও আছে। কুয়ালালামপুর ও প্যারিসে আন্তর্জাতিক সংসদীয় সম্মেলনে ভারত এ বক্তব্য নিয়ে অনেকটা সফলও হয়েছে। পাকিস্তান সেখানে সুবিধা করতে পারেনি।
ফরাসি লেখক ও ভাবুক অঁদ্রে মালরো প্যারিসে এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশে গিয়ে তিনি বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রামে যোগ দেওয়ার জন্য তৈরি রয়েছেন। রওনা হওয়ার তারিখ তিনি শিগগিরই ঘোষণা করবেন। তাঁর এই বিবৃতি বিভিন্ন দেশের সংবাদপত্র গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করে। ৬৯ বছর বয়সী মালরো দ্য গলের সরকারে সংস্কৃতিমন্ত্রী ছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা
পাকিস্তানের লাহোর থেকে প্রকাশিত সরকার নিয়ন্ত্রিত ইমরোজ পত্রিকায় এক সংবাদে বলা হয়, একজন সরকারি চিকিৎসক প্রতিদিন শেখ মুজিবের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছেন। তাঁকে পাকিস্তানের জাতীয় সংবাদপত্রগুলো দেওয়া হয়েছে। তবে কেউ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারেনি।
অপারেশন ওমেগা দলের সদস্যদের এ দিন জেল থেকে মুক্তি দিয়ে ঢাকা নিয়ে যাওয়া হয়। ঢাকার ব্রিটিশ উপহাইকমিশন জানায়, শিগগিরই তাঁরা লন্ডন ফিরে যাবেন বলে আশা করছেন।
পাকিস্তানি অনুগত বেসামরিক প্রাদেশিক মন্ত্রিপরিষদের ১০ জন মন্ত্রীর ৯ জন এ দিন শপথ নেন। এর আগে সকালে গভর্নর আবদুল মোত্তালিব মালিক মন্ত্রীদের নাম ঘোষণা করেন। আব্বাস আলী খান, অংশু প্রু চৌধুরীসহ কয়েকজন মন্ত্রী হন। অংশু প্রু চৌধুরী ছাড়া বাকিরা শপথ নেন।
জামায়াতে ইসলামীর নেতা গোলাম আযম মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল এডুকেশন সেন্টারে রাজাকারদের বলেন, মুসলিম জাতীয়তায় পূর্ণ বিশ্বাসীরাই পাকিস্তানের জন্য জীবন দান করতে পারে।
গেরিলা অভিযান
মানিকগঞ্জের শিবালয়ে এ দিন পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে আক্রমণ করলে মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা আক্রমণ চালান। যুদ্ধে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়।
৮ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি বাহিনীর মাসলিয়া ঘাঁটি আক্রমণ করলে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি সেনাদের পরাগপুর অবস্থানে হামলা করলে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি বাহিনীর রাজাপুর সীমান্তঘাঁটিতে অ্যামবুশ করলে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর দুই ও আট; স্বাধীনতাসংগ্রামে প্রবাসী বাঙালি, আবদুল মতিন, র্যাডিক্যাল এশিয়া পাবলিকেশনস, লন্ডন, যুক্তরাজ্য; মূলধারা ’৭১, মঈদুল হাসান, ইউপিএল, ঢাকা; দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ ও দ্য গার্ডিয়ান, লন্ডন, যুক্তরাজ্য, ১৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা ও যুগান্তর, কলকাতা, ভারত, ১৮ ও ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান