বিজ্ঞাপন
default-image

যুক্তরাজ্যের হাউস অব কমন্সে ৩ আগস্ট বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ১৩০ জনের বেশি সদস্য আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য পাকিস্তানের কাছে আবেদন জানান। আবেদনকারী এমপিরা বলেন, শেখ মুজিবের মুক্তিই বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমাধানের প্রথম পদক্ষেপ। লেবার পার্টির এমপি রেজিল্যান্ড প্রেন্টিস পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস হোমকে শেখ মুজিবুর রহমানের নিরাপত্তা সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে বলেন। উত্তরে ডগলাস হোম বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্য সময়ে যুক্তরাজ্য ও পাকিস্তানের মধ্যে যে আলোচনা হয়েছে, তা এখন প্রকাশ না করাই ভালো।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদে এদিন রাতে পাকিস্তান ও গ্রিসকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করার বিধান রেখে যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সাহায্য বিলটি পাস হয়। তবে বিলের কয়েকটি বিধানের ফাঁকফোকরে প্রেসিডেন্ট নিক্সন ইচ্ছা করলেই সাহায্য করার সুযোগ থেকে যায়। প্রতিনিধি পরিষদের অধিকাংশ সদস্যই এতে সমর্থন জানান।

সোভিয়েত সংবাদপত্র প্রাভদায় এই দিন পাকিস্তানের ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুমকির প্রতি আবার পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। তারা উল্লেখ করে, ভারত এ ব্যাপারে দৃঢ় মনোভাব দেখিয়েছে।

নিউইয়র্কে জাতিসংঘের একজন মুখপাত্র সাংবাদিকদের জানান, বিভিন্ন দেশ ও সংগঠন যেসব ত্রাণসামগ্রী পূর্ব পাকিস্তানে পাঠিয়েছে, তা ব্যবস্থাপনার জন্য জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা সেখানে যাচ্ছেন। জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট এর আগে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে পূর্ব পাকিস্তানে মানবিক সাহায্য দিতে চেয়ে চিঠি দিয়েছিলেন। তার আলোকেই জাতিসংঘ পূর্ব পাকিস্তানে মানবাধিকারের ভিত্তিতে কাজ করবে। পর্যবেক্ষক পাঠানো সম্পর্কে যে খবর বেরিয়েছে, তা ভিত্তিহীন।

জাপানের রাজধানী টোকিওতে পরমাণু অস্ত্রবিরোধী আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ ওঠে। বিশ্ব শান্তি পরিষদের মহাসচিব এইচ ডি মালব্য মে মাসে পরিষদের বুদাপেস্ট সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবের কথা উল্লেখ করে বলেন, তাতে বাংলাদেশে গণনির্যাতনের শিকার বাঙালিদের প্রতি সহানুভূতি জানানো হয়েছে। পাকিস্তানি প্রতিনিধি তাঁর বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, বিশ্ব শান্তি পরিষদ ভারতের মুসলমান নিধন সম্পর্কে কিছুই বলেনি। এ সময় প্রতিনিধিদের ধিক্কারে তাঁর বক্তব্য চাপা পড়ে যায়।

নকশী সীমান্ত ঘাঁটিতে যুদ্ধ

জামালপুরের ঝিনাইগাতীর নকশী সীমান্ত ঘাঁটিতে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের মুখোমুখি ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। মুক্তিবাহিনীর ১১ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমানের (স্বাধীনতার পর বীর উত্তম, লেফটেন্যান্ট জেনারেল, সেনাপ্রধান ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি) নির্দেশে ক্যাপ্টেন আমীন আহম্মেদ চৌধুরীর (স্বাধীনতার পর বীর বিক্রম ও মেজর জেনারেল) নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দুটি দলের মুক্তিযোদ্ধারা নকশী সীমান্ত ঘাঁটিতে আক্রমণ করেন। মুখোমুখি যুদ্ধের একপর্যায়ে ভুলে নিজেদের ছোড়া গোলায় বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা হতাহত হন। মনোবল ভেঙে একপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর অনেকে হতাহত এবং ব্যাপক ক্ষতি হয়। মুক্তিবাহিনীর ২৬ জন শহীদ ও নিখোঁজ এবং ৩৫ জন আহত হন।

কুমিল্লায় একদল মুক্তিযোদ্ধা চৌদ্দগ্রাম ও মিয়ার বাজারের সংযোগকারী রাস্তায় পাকিস্তানি সেনাদের ওপর অতর্কিত হামলা করলে কয়েকজন হতাহত হয়। আরেকটি দল চৌদ্দগ্রামের সুরাইনল এবং মাদলীতে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানের ওপর আক্রমণ করে কয়েকজনকে হতাহত করে।

default-image

ভারতে বাংলাদেশের পক্ষে

ভারতের কেন্দ্রীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় দৃষ্টি আকর্ষণী প্রশ্নের জবাবে বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির ব্যাপারে ভারত কয়েকটি দেশের সঙ্গে আলোচনা করছে। ভারত বলেছে, পাকিস্তান শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের প্রহসন করলে বিষয়টিকে আরও জটিল করে তোলা হবে।

দিল্লিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র সাংবাদিকদের জানান, মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী টুংকু আবদুর রহমান আজ রাতে দিল্লি আসবেন। তিনি বাংলাদেশ সংকটের তাৎপর্য, শরণার্থী সমস্যা এবং এ ব্যাপারে ভারতের মনোভাব জানতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করবেন। ইসলামিক সেক্রেটারিয়েটের প্রতিনিধিদলকে ভারত অভ্যর্থনা জানাতে অস্বীকার করায় টুংকু আবদুর রহমান মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পরিচয়ে ভারতে আসবেন।

বাংলাদেশের স্বীকৃতির দাবিতে জনসংঘের সত্যাগ্রহের তৃতীয় দিনে দিল্লিতে ২০ জন নারীসহ ৬৩১ জন গ্রেপ্তার বরণ করেন।

বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচারের প্রতিবাদে এবং বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবিতে ত্রিপুরা রাজ্যের ছাত্ররা এদিন এসএফআইয়ের ত্রিপুরা শাখার ডাকে ধর্মঘট পালন করেন।

পাকিস্তান ও অবরুদ্ধ বাংলাদেশে

পাকিস্তান সরকারের কেনা উপকূলীয় এলাকায় চলাচলের উপযোগী চীনের তিনটি মালবাহী জাহাজ পূর্ব পাকিস্তানে পৌঁছায়। জাহাজগুলো চীনের বন্দর থেকে খাদ্যসামগ্রী নিয়ে আসে। পর্যবেক্ষক মহল আশঙ্কা প্রকাশ করে বলে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী জাহাজগুলো উপকূল এলাকায় যুদ্ধ তৎপরতায় ব্যবহার করবে।


সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, দুই ও এগারো; ইত্তেফাক, ৪ ও ৫ আগস্ট ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকাযুগান্তর, ভারত, ৪ ও ৫ আগস্ট ১৯৭১


গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান