পূর্ববঙ্গ পরিস্থিতির দ্রুত রাজনৈতিক সমাধান হবে বলে ৩০ অক্টোবর যৌথ ঘোষণায় আশা প্রকাশ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ফ্রান্স। সোভিয়েত নেতা লিওনিদ ব্রেজনেভ এবং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট জর্জ পম্পিদু স্বাক্ষরিত যৌথ ঘোষণায় এটি বলা হয়। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে শান্তি রক্ষার জন্য সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যেতে দুই নেতা সম্মত হন। শরণার্থীদের কারণে ভারত সরকারের সমস্যার বিষয়টিও যৌথ ঘোষণায় উল্লেখ করা হয়। সোভিয়েত নেতা ব্রেজনেভের ছয় দিনের ফ্রান্স সফরে ওই যৌথ ঘোষণা আসে।
যুক্তরাজ্যের একটি মহল এই দিন লন্ডনে সাংবাদিকদের জানায়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর যুক্তরাজ্য সফরকে ঘিরে দুটি বিষয় নিয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে।
এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ পূর্ণ স্বাধীনতা এবং ভারতে আসা বাংলাদেশি শরণার্থীদের সসম্মানে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন।
লন্ডনের হেনরি থর্নটন স্কুলে এ দিন বাংলাদেশ জাতীয় ছাত্র সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ স্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটি এ সম্মেলনের আয়োজন করে। ম্যানচেস্টার, লিডস, বার্মিংহাম, এক্সেটার, কেমব্রিজ, অক্সফোর্ড এবং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্র প্রতিনিধিদল সম্মেলনে যোগ দেয়। যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী সম্মেলনের উদ্বোধন করেন। যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির সাংসদ পিটার শোর এবং যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের ছাত্রসংগঠনের নেতারা অধিবেশনে বক্তব্য দেন। অধিবেশনের একটি পর্বে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম নিয়ে আলোচনা হয়। আলোচনা করেন রেহমান সোবহান ও আজিজুর রহমান খান।
আন্তর্জাতিক ভারত সহায়ক সমিতি প্যারিসে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ভারতে আসা বাংলাদেশের শরণার্থীদের ত্রাণকার্যের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যয়ের কিছুটা অংশ তারা মেটানোর চেষ্টা করবে।
ভারতে সোভিয়েত বিমানবাহিনীর প্রধান
সোভিয়েত ইউনিয়নের বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার মার্শাল পি এস কুতাকোভের নেতৃত্বে একটি সামরিক প্রতিনিধিদল ছয় দিনের ভারত সফরে দিল্লি এসে পৌঁছায়।
ওয়াকিবহাল মহল জানায়, পাকিস্তানের ভারত আক্রমণের প্রেক্ষাপটে ভারতের প্রতিরক্ষা প্রস্তুতির সঙ্গে এই সফরের যোগ রয়েছে। তারা ভারতে বিমান আক্রমণের সম্ভাবনা ও প্রতিরক্ষার বিষয়টি বিশ্লেষণ করে দেখবে। প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আসা বিশেষজ্ঞদের নাম গোপন রাখা হয়।
মুজিবনগরে একটি ওয়াকিবহাল মহল জানায়, পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য বাংলাদেশ সরকার বিমান সংগ্রহ করেছে। বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির রুদ্ধদ্বার বৈঠকে এ কথা বলেন। তিনি জানান, মুক্তিবাহিনী হেলিকপ্টার ও বিমান এবং মুক্তাঞ্চলে কিছু বিমান অবতরণক্ষেত্র পেয়েছে। এসব শত্রুদের অবস্থান নির্ণয়, মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবহন এবং তাঁদের রসদ সরবরাহের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এসবের সংখ্যা কম হলেও কাজে লাগছে।
মুক্তিবাহিনীর অভিযান
২ নম্বর সেক্টরের ঢাকা মহানগরীর জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকা শহরের উত্তরে অ্যামবুশ করে পাকিস্তানের টহল দলের কয়েকজনকে হতাহত করেন। দলটি পরে মালিবাগ ও কমলাপুরে রাজাকারদের ওপর হামলা করলে চারজন নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল লালবাগের কাঁঠালবাড়ী ইউনিয়নে অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে স্থানীয় শান্তি কমিটির আহ্বায়ক এবং তার একজন সহযোগী নিহত হয়।
৫ নম্বর সেক্টরের ১৭৫ জন মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি বাহিনীর গৌরীনগর ঘাঁটি আক্রমণ করেন। তাঁদের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে পাকিস্তান সেনা ও রাজাকাররা পিছু হটতে বাধ্য হয়। মুক্তিযোদ্ধারা এরপর গৌরীনগর পৌঁছান। গোলাগুলির শব্দে সালুটিকর থেকে পাকিস্তানিদের একটি সাহায্যকারী দল এসে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর পাল্টা আক্রমণ চালালে মুক্তিযোদ্ধারা গৌরীনগর ছেড়ে আসেন। এই সংঘর্ষে দুজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। পাকিস্তানি বাহিনীর ১১ জন হতাহত হয়।
৭ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা কুমারপুর সেতু ধ্বংস করতে এসে পাকিস্তানি সেনাদের একটি কনভয়কে আসতে দেখে তাদের অ্যামবুশ করেন। এতে দুটি জিপ ক্ষতিগ্রস্ত ও কিছু সেনা হতাহত হয়।
পাকিস্তানের তৎপরতা
পাকিস্তান সেনাবাহিনী এ দিন সকালে বিলোনিয়ার ভারতীয় অংশে গুলিবর্ষণ করে। মুক্তিবাহিনীও পাল্টা জবাব দেয়। এ ছাড়া পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রাগপুর ও দর্শনা থেকে ভারতের সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে মর্টার ও মেশিনগানের সাহায্যে নির্বিচার গোলা ও গুলিবর্ষণ করে। এতে কয়েকজন শরণার্থী আহত হয়।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর দুই ও পাঁচ; আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত, ৩১ অক্টোবর ও ১ নভেম্বর ১৯৭১
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান