বিজ্ঞাপন
default-image

ইন্ডিয়া নিউজ-এ প্রকাশিত একটি সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান এখন আর সম্ভব নয়। পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন গঠনের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে তিনি বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সম্প্রতি ঘোষিত চার দফা দাবির পুনরুল্লেখ করেন। দাবিগুলো হলো: ১. অবিলম্বে শেখ মুজিবের মুক্তি, ২. বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি সেনা প্রত্যাহার, ৩. পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞের ক্ষতিপূরণ, এবং ৪. বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে ঘোষণা।

দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়, ইরানের উদ্যোগে পশ্চিম পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে রাজনৈতিক আলোচনার জন্য ইসলামাবাদ ও তেহরানে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু হয়েছে। আমেরিকা ও চীন এ উদ্যোগের সমর্থক। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুলতান মোহাম্মদ খান ইতিমধ্যে তেহরান এসেছেন।

রাশিয়া নিরাপত্তা পরিষদে বৈঠকের বিরোধী

জাতিসংঘের কূটনৈতিক মহল সূত্রে ১৯ আগস্ট জানা যায়, সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশ নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদে বৈঠকের বিরোধী। জাতিসংঘে সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত ভিক্তর ইসরায়েলিয়ান মহাসচিব উ থান্টের সঙ্গে দেখা করে জানিয়েছেন, তাঁর দেশ ভারত-পাকিস্তানের উত্তেজনা সম্পর্কে নিরাপত্তা পরিষদে বৈঠকের বিরোধী। তিনি উ থান্টকে জানান, উত্তেজনার উৎস পাকিস্তান। পাকিস্তানকে এমন অবস্থা সৃষ্টি করতে হবে, যাতে শরণার্থীরা আপন দেশে ফিরে যেতে পারেন।

বামপন্থী নিউ টাইমস পত্রিকায় এক সংবাদে বলা হয়, অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম ম্যাকমোহান বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে একটি চিঠি লিখেছেন।

ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র এ দিন সাংবাদিকদের বলেন, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে যে দুটি ৭০৭ বোয়িং বিমান লিজ দিয়েছে, সেগুলো পাকিস্তান এয়ারলাইনসের সঙ্গে যুক্ত করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে সেনা পরিবহন করা হচ্ছে বলে প্রচারিত সংবাদ সম্পর্কে তদন্ত করা হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ার স্থানীয় কর্তৃপক্ষ সাংবাদিকদের জানায়, একটি পাকিস্তানি জাহাজ থেকে পালানো ছয়জন বাঙালি নাবিক ফিলাডেলফিয়ায় রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন। জাহাজটি তাঁদের ছাড়াই বন্দর ছেড়ে গেছে। ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মুখপাত্র রিচার্ড টেইলার বাঙালি নাবিকদের প্রতিনিধিত্ব করবেন বলে জানিয়েছেন।

ভারতে বাংলাদেশের পক্ষে

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে আটক অপারেশন ওমেগা দলের সদস্যরা ১৯ আগস্ট সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে ফিরে আসেন। ফিরে এসে কলকাতায় সংবাদ সম্মেলনে দলের সদস্য ড্যানিয়েল গ্রোটা বলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হুমকি অগ্রাহ্য করে কয়েক দিনের মধ্যেই তাঁরা আবার বাংলাদেশে যাবেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রথমবারের যাত্রা সফল হয়নি ঠিকই, কিন্তু তাঁরা এক ধাপ এগিয়েছেন।’ তিনি বলেন, বেনাপোল থেকে আটক করে ভেতরে নেওয়ার সময় তাঁরা দেখেছেন গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

ভারতীয় মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহিম সুলেমান সাইফ এমপি এক বিবৃতিতে বলেন, কেন্দ্রীয় সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে মুসলিম লীগ এবং দেশের ৮ কোটির বেশি মুসলমান দৃঢ়ভাবে সরকারকে সমর্থন করবেন। এ ব্যাপারে লীগের নীতি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের ঘটনাবলি শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই লীগের সভাপতি মহাম্মদ ইসমাইল এক বিবৃতিতে কড়া ভাষায় পূর্ব বাংলার গণহত্যার নিন্দা করেন এবং ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য গভীর সমবেদনা জানান।

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজধানী কলকাতায় বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ শান্তি সংসদ আয়োজিত এক সভায় গায়ানার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ছেদি জগন বলেন, বাংলাদেশের জনগণ মুক্তিসংগ্রামে জয়ী হবেই। কেননা পৃথিবীর কোনো দেশেই স্বৈরাচারী শাসন জনগণের স্বাধীনতাসংগ্রামকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। ইয়াহিয়া সরকারও পারবে না। তিনি কয়েকটি শরণার্থীশিবির পরিদর্শন করেন।

নেপালের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বাংলাদেশ শরণার্থী সহায়ক সমিতির সভাপতি হৃষিকেশ শাহ এক বিবৃতিতে বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন বিচার শুরু ন্যায় ও আত্মনিয়ন্ত্রণ নীতির বিরোধী এবং বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের বাধাস্বরূপ। বিবৃতিতে তিনি শেখ মুজিবের জীবন রক্ষা ও তাঁর বিনা শর্তে মুক্তির জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে এক আবেদন জানান। তিনি আরও বলেন, এখন ক্রমেই পরিষ্কার হচ্ছে, শেখ মুজিবের সঙ্গে বোঝাপড়ায় না এসে পাকিস্তানের শাসকেরা বাংলাদেশে বেসামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা বা শরণার্থীদের দেশে ফিরিয়ে আনার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারবেন না।


সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকাযুগান্তর, ভারত, ২০ ও ২১ আগস্ট ১৯৭১; দ্য টাইমস, ২০ আগস্ট ১৯৭১; দ্য গার্ডিয়ান, দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফইন্ডিয়া নিউজ, ১৯ আগস্ট, ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান