পূর্বাঞ্চলে (বাংলাদেশ) অস্ত্রবিরতির জন্য পাকিস্তান সরকারকে চাপ দিতে ৬ এপ্রিল যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউস অব কমন্সে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। প্রস্তাবে দেশটির ১৮০ জনের বেশি সাংসদের স্বাক্ষর ছিল। এ প্রস্তাবের বিষয়ে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার অ্যালেক ডগলাস হোম বলেন, ব্রিটিশ সরকার পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবে না। তাঁর এ বক্তব্য সাংসদেরা মেনে নেন। কিন্তু তাঁরা উদ্বিগ্ন যে আর কালক্ষেপণ না করে সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করা উচিত।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র এদিন পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) পরিস্থিতির নিয়ে এক বিবৃতিতে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র এ-জাতীয় পরিস্থিতিতে ব্যবহৃত হলে স্বভাবতই তাঁরা উদ্বিগ্ন হবেন।
চট্টগ্রামে যুদ্ধ
চট্টগ্রামের চকবাজার এলাকায় ৬ এপ্রিল মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে দুটো দলের নেতৃত্ব দেন ক্যাপ্টেন হারুন আহমদ চৌধুরী (পরে বীর উত্তম ও মেজর জেনারেল) এবং লেফটেন্যান্ট শমসের মবিন চৌধুরী (পরে বীর বিক্রম ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল)। পাকিস্তানিরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা যখন প্রায় জয়ের পথে, পাকিস্তানিরা তখন ট্যাংক ব্যবহার করতে শুরু করে। আক্রমণের মুখে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেন। পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধা সংঘর্ষে শহীদ হন।
সিলেটের করিমগঞ্জ সীমান্তেও মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি সেনাদের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটে। আরেকটি প্রতিরোধযুদ্ধ হয় রাজশাহী শহরে।
৬ এপ্রিল চট্টগ্রাম শহরের নিয়ন্ত্রণ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে থাকলেও কক্সবাজারসহ জেলার বহু এলাকা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রতিরোধযোদ্ধাদের কর্তৃত্বে ছিল। রংপুর, সৈয়দপুর ও দিনাজপুর শহর বাদে বৃহত্তর উত্তরবঙ্গও প্রতিরোধযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল।
ঢাকায় পাকিস্তানপন্থী নেতারা
পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে ঢাকায় পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরী, জামায়াতে ইসলামীর প্রাদেশিক প্রধান গোলাম আযম, পীর মোহসেনউদ্দিন আহমদ (দুদু মিয়া) এবং আইনজীবী এ টি সাদী সাক্ষাৎ করেন। তাঁরা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতের হস্তক্ষেপের নিন্দা জানান এবং সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারীদের দমনে সামরিক বাহিনীকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
পরে এক বিবৃতিতে হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চায় বলে ভারতীয় বেতার মানুষ হত্যা ও জনপদ ধ্বংসের ভিত্তিহীন প্রচারণা চালাচ্ছে। ভারত এ উদ্দেশ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থনও দিচ্ছে।
জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা আবুল আলা মওদুদি লাহোরে এক বিবৃতিতে বলেন, পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে সেখানকার মানুষ তাদের স্বাধীনতা হারাবে। আন্দোলন ধ্বংস করার জন্য দেশের সশস্ত্র বাহিনীকে পূর্ণ সমর্থন দিতে সবার প্রতি তিনি আহ্বান জানান।
পদগর্নির চিঠির জবাবে ইয়াহিয়া
পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগর্নির চিঠির জবাবে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান বলেছেন, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পাকিস্তান কারও হস্তক্ষেপ সহ্য করবে না। আওয়ামী লীগ দেশকে ধ্বংস করার কোনো ম্যান্ডেট পায়নি। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্বমূলক নেতাদের সঙ্গে আলাপ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
সিঙ্গাপুরের পত্রিকায় সম্পাদকীয়
সিঙ্গাপুরের দ্য নিউ নেশন পত্রিকা এদিন ‘পূর্ব পাকিস্তানে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ বন্ধ হতে হবে’ শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তান থেকে অপসারিত বিদেশি নাগরিকদের কাছে পাওয়া হত্যাযজ্ঞের বিবরণ ভয়াবহ। পরিস্থিতি গণহত্যার কাছাকাছি। পাকিস্তানিদের কর্মকাণ্ড বৈধ প্রয়োজনের সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে। পূর্ব পাকিস্তানের হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করতে হবে। অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্বের পণ্ডিতি ব্যাখ্যা শুনিয়ে বিশ্বমানবতার কণ্ঠ রোধ করে রাখা যাবে না।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: দলিলপত্র, ত্রয়োদশ খণ্ড; বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক যুদ্ধ, সেক্টর ৭; লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে, রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম, (অনন্যা); বিদেশির চোখে ১৯৭১, আন্দালিব রাশদী, (নালন্দা); দৈনিক পাকিস্তান, ৭ এপ্রিল ১৯৭১
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান