বিজ্ঞাপন
default-image

মুক্তিসংগ্রামের এই পর্যায়ে ১২ ডিসেম্বর থেকে ঢাকা দখলের লড়াই শুরু হয়। বাংলাদেশের বেশির ভাগ এলাকা কার্যত মুক্ত।

আগের দিন ভারতীয় বাহিনীর ছত্রীসেনারা ঢাকার আশপাশে মুক্ত কিছু এলাকায় নেমে পড়েন। সবকিছু পরিকল্পনামতো চলছিল।

ভৈরব বাজার থেকে যৌথ বাহিনী এদিন নরসিংদীতে এসে পৌঁছায়। ঢাকা মাত্র ৫২ কিলোমিটার দূরে।

আগের দিন যারা ময়মনসিংহ দখল করেছিল, তারাও ক্রমশ ঢাকার দিকে আগুয়ান। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন হেলিকপ্টারে অবতরণকারী সেনা।

হেলিকপ্টার এসেছে মেঘনা ও যমুনা দ্রুত পার হয়ে যেতে। যৌথ বাহিনীর বেশ কয়েকটি দল ঢাকামুখী। পাকিস্তান সেনাবাহিনী নানা স্থানে যৌথ বাহিনীকে পাল্টা আক্রমণ করলেও মোটেই রুখতে পারেনি।
যৌথ বাহিনীর একটি অংশ খুলনার উপকণ্ঠে পৌঁছায়। হিলি থেকে এগিয়ে তারা বগুড়া শহর থেকে ১০ মাইল দূরে অবস্থান নেয়।

বগুড়ার পতন আসন্ন। চট্টগ্রামেও পাকিস্তানি বাহিনী ছত্রভঙ্গ। তাদের অনেকে আশ্রয় নেয় সেনানিবাস ও শহরের আশপাশে। চট্টগ্রাম বিমানবন্দর ও পাকিস্তানি ঘাঁটিতে ভারতীয় বিমানবাহিনী ব্যাপক বোমাবর্ষণ করে।

কক্সবাজারে ধ্বংস হয় একটি গানবোট ও দুটি জাহাজ। রাঙামাটিতে ছত্রভঙ্গ পাকিস্তানি সেনারা মিয়ানমারের দিকে পালাতে থাকে।

নিক্সনের অপচেষ্টা

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এদিন পাকিস্তানের ওপর সশস্ত্র আক্রমণ অবিলম্বে বন্ধ করার জন্য ভারতের প্রতি আহ্বান জানান।

যুদ্ধ সম্পর্কে ব্যবস্থা নিতে নিরাপত্তা পরিষদে নতুন বৈঠক ডাকারও অনুরোধ জানান। নিক্সন নিরাপত্তা পরিষদের উদ্দেশে বলেন, এই লড়াই থামানোর জন্য জরুরি ব্যবস্থা নিতে হবে।

পূর্ব বাংলা ভারতীয় সেনারা প্রায় দখল করে নিয়েছেন।
হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র রোনাল্ড জিগলার এক বিবৃতিতে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ভারতের এই আক্রমণ জাতিসংঘের একটি সদস্যরাষ্ট্রের ওপরই আক্রমণ।

বিষয়টি অবিলম্বে নিরাপত্তা পরিষদে আনার জন্য নিক্সন জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি জর্জ বুশকে নির্দেশ পাঠিয়েছেন।

আজ সকালে তিনি কিসিঞ্জারের সঙ্গে আলোচনা করে সে অনুযায়ীই অগ্রসর হচ্ছেন।
এদিন রাতে নিরাপত্তা পরিষদে বৈঠক ডাকার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের জোর চেষ্টা সত্ত্বেও সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পোল্যান্ডের জোরালো দাবির মুখে তা স্থগিত হয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টাকে চীন সমর্থন জানিয়েছিল।

অবশেষে নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতি ১৩ ডিসেম্বর আবার বৈঠক শুরুর সিদ্ধান্ত নেয়।
যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত এল কে ঝা এদিন নিউইয়র্কে টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেন, পাকিস্তান বাংলাদেশের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিলে ভারত অস্ত্র সংবরণে রাজি হতে পারে।


নিউইয়র্কে সফররত ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বৈঠকে বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হলে এবং ভারতীয় এলাকা থেকে পাকিস্তানি সেনা সরিয়ে নিলে ভারত যুদ্ধবিরতি এবং সেনা অপসারণের প্রস্তাব বিবেচনা করবে।


যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনের হাইড পার্কে প্রায় ১৫ হাজার প্রবাসী বাঙালি এক সমাবেশে বাংলাদেশের স্বীকৃতি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি দাবি করেন।

সমাবেশে বক্তব্য দেন লন্ডনে বাংলাদেশ মিশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান রেজাউল করিম, লেবার পার্টির সাংসদ পিটার শোর ও জন স্টোনহাউস এবং বাংলাদেশ থেকে আসা আওয়ামী লীগ নেতা আসহাব-উল হক জোয়ারদার।

সমাবেশ শেষে প্রবাসী বাঙালিরা বিরাট মিছিল নিয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার অনুরোধসংবলিত একটি স্মারকলিপি পেশ করেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির ব্যাপারে সাহায্য করতেও প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানানো হয়।

পরদিন দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় এই মিছিলকে ‘বিজয় সমারোহ’ বলে অভিহিত করা হয়।


লন্ডনের মহাত্মা গান্ধী হলে ইন্ডিয়া লিগ আয়োজিত এক সভায় লেবার পার্টির সাবেক মন্ত্রী পিটার শোর বলেন, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি এবং ব্যবহারিক সাহায্য দিতে যুক্তরাজ্যের তৈরি থাকা উচিত।

ইন্দিরার সাবধানবাণী

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দিল্লিতে এক জনসভায় চলমান ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের প্রেক্ষাপটে বলেন, পশ্চিমা শক্তিগুলোর সঙ্গে পাকিস্তানের সামরিক চুক্তি যেন কাজে লাগানোর চেষ্টা না করা হয়।
ইন্দিরা গান্ধী এদিন জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে পাঠানো এক বার্তায় বলেন, পাকিস্তান পূর্ববঙ্গ থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করলে, বাংলাদেশ সরকারের প্রতি যাদের আনুগত্য রয়েছে, তাদের সঙ্গে আপসরফা করে, তাহলে তিনি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব বিবেচনা করতে রাজি আছেন।
দিল্লি ও মুজিবনগরের সূত্রগুলো এদিন জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর ভারত মহাসাগরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছে। এ খবরে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।

নুরুল আমিনের তৎপরতা

নুরুল আমিন এদিন ইসলামাবাদে পাকিস্তানে নিয়োজিত চীনা রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করেন।

উপমহাদেশে যুদ্ধের কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে চীন সরকারকে জানাতে তিনি চীনা রাষ্ট্রদূতকে অনুরোধ জানান।

নুরুল আমিন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সাক্ষাতের পর চীনা রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করেন।


সূত্র: স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসী বাঙালি, আবদুল মতিন, র‌্যাডিক্যাল পাবলিকেশন্স, লন্ডন; আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত, ১৩ ও ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১; দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ ও দ্য গার্ডিয়ান, ১৩ ডিসেম্বর ১৯৭১
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান