ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ৩০ নভেম্বর শান্তির নিদর্শন হিসেবে পাকিস্তানকে বাংলাদেশ থেকে সেনা ফিরিয়ে নিতে বলেন। তাঁর সাম্প্রতিক বিদেশ সফর নিয়ে সংসদে বিবৃতি দেওয়ার পর তা নিয়ে বিতর্ক শেষে ইন্দিরা প্রস্তাবটি দেন। তিনি বলেন, ভারত ও বাংলাদেশের জন্য ডিসেম্বর খুব কঠিন মাস। ভারত যথেষ্ট সংযম দেখিয়েছে। কিন্তু প্রতিবেশীদের তাঁরা নিশ্চিহ্ন হতে দিতে পারেন না।
ইন্দিরাকে পাঠানো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সাম্প্রতিক চিঠি নিয়ে এদিন মন্ত্রিসভার রাজনৈতিক কমিটিতে আলোচনা হয়। নিক্সনের যুক্তি খণ্ডন করে দ্রুত চিঠির জবাব পাঠানো হবে।
চিঠিতে নিক্সন অভিযোগ করেছেন, সীমান্তে উত্তেজনা হ্রাসের প্রস্তাবে ভারত অনমনীয় মনোভাব দেখাচ্ছে। নিক্সন ভারতকে সংযত হতে এবং ভারত ও পাকিস্তানকে সেনা সরিয়ে নিতে বলেন।
রাতে এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম বলেন, আত্মরক্ষার জন্য প্রয়োজনে ভারতীয় বাহিনীকে সীমান্ত পেরিয়ে পূর্ববঙ্গে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
চীন পাকিস্তানকে অস্ত্র দিচ্ছে
জাপানের টোকিও রেডিওতে বলা হয়, চীন পাকিস্তানকে আবার অস্ত্র দিতে শুরু করেছে। বেইজিং থেকে তারা এ খবর পেয়েছে। পিকিং থেকে পাকিস্তানে সামরিক বিমান সরবরাহ করা হচ্ছে।
ব্রিটেনের হাউস অব কমন্সে এদিন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার এবং পাকিস্তানকে কমনওয়েলথ থেকে বহিষ্কারের দাবি ওঠে। প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ দুটো দাবিই নাকচ করে দেন।
যুক্তরাজ্যের দ্য টাইমস পত্রিকায় বলা হয়, একটি জাতীয় সরকার গঠন সম্পর্কে আলোচনার জন্য পূর্ববঙ্গের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও মুসলিম লীগ নেতা নুরুল আমিনকে ইয়াহিয়ার পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
মুক্তিবাহিনীর রণকৌশলে বদল
মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে জানানো হয়, মুক্তিযোদ্ধারা এখন রণকৌশল পাল্টেছেন। হিট অ্যান্ড রান বা আক্রমণ করেই ফিরে আসার কৌশল ছেড়ে তাঁরা পাকিস্তানিদের অগ্রবর্তী ঘাঁটি দখল করে সেখানেই অবস্থান নিচ্ছেন। এরপর পরবর্তী আক্রমণের প্রস্তুত হচ্ছেন। সব সেক্টরেই এই নীতি চলছে।
বলা হয়, অধিকৃত বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনা কর্তৃপক্ষ ফরিদপুর, বরিশাল ও পটুয়াখালীর বিভিন্ন ঘাঁটি থেকে দ্রুত সেনা নিয়ে এসে সেনানিবাস ও গ্যারিসনে সমবেত করছে। জেলাগুলোর বহু এলাকা কার্যত মুক্ত। ঢাকা-বরিশাল নদীপথে যোগাযোগ এবং ঢাকা শহরে ব্যবসা-বাণিজ্য কার্যত বন্ধ।
৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের যশোর শহরের দিকে অভিযান এদিনও অব্যাহত থাকে। ভারতীয় সেনা সহায়তায় পাকিস্তানি ঘাঁটিগুলোতে বোমা ফেলে তারা চাপ সৃষ্টি করে।
সিলেট অঞ্চলে নির্ধারিত সময়ের আগেই মুক্তিযোদ্ধারা রাধানগর মুক্ত করে বিজয় উদ্যাপন করেন।
টাঙ্গাইলে কাদেরিয়া বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা মানিকগঞ্জ ও টাঙ্গাইলের মাঝামাঝি নাগরপুর দখলের উদ্দেশ্যে ২৯ নভেম্বর কেদারপুরে সমবেত হন। খবর পেয়ে পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ করলে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাও আহত হন।
২ নম্বর সেক্টরে ঢাকা শহরের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত গেরিলারা শান্তিবাগে পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগীদের ওপর অভিযান চালালে দুজন নিহত হয়।
৬ নম্বর সেক্টরে যৌথ বাহিনী পঞ্চগড়ের বোদার উদ্দেশে অভিযান শুরু করে। পথে ময়দান দিঘির কাছে পুটিমারীতে পাকিস্তানি সেনাদের বাধার মুখে পড়লে সেখানেই প্রতিরক্ষা অবস্থান তৈরি করে।
সিলেট অঞ্চলে ৪ নম্বর সেক্টরের গণবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা কানাইঘাটে অবস্থানরত পাকিস্তানিদের উচ্ছেদ করার পরিকল্পনা নিয়ে পাঁচ মাইল দূরে লুবাছড়া চা-বাগান এলাকায় সমবেত হন। ২৬ নভেম্বর রাতে তাঁরা সেখানে অস্থায়ী প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলেন। পরের রাতে বড় চাতলাপুর গ্রামাঞ্চলে অগ্রাভিযান শুরু করেন। এখানে দরবস্ত-কানাইঘাট রোডে পাকিস্তানি বাহিনীর চলাচল প্রতিহত করার ব্যবস্থা নেন। গ্রামের সামনে ও পেছনে দুইদিকেই তাঁরা প্রতিরক্ষাব্যবস্থা নেন, যাতে কানাইঘাটের পাকিস্তানি সেনারা পালাতে না পারে, আবার বাইরে থেকে নতুন সেনারা এসে যুক্তও না হতে পারে।
পাকিস্তানি সেনারা কামান দিয়ে তাঁদের আক্রমণ শুরু করে। প্রবল আক্রমণের মুখেও তাঁরা ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত তাঁরা অবস্থান ধরে রেখে দরবস্ত-কানাইঘাট রোডে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন।
পাকিস্তান ও অধিকৃত বাংলাদেশে
পাকিস্তানের এক সরকারি মুখপাত্র বলেন, মুক্তিবাহিনী পূর্বাঞ্চলের সীমান্তবর্তী ১৮টি স্থানে অভিযান চালিয়ে আজ রংপুর ও পঞ্চগড়ে প্রবল চাপ সৃষ্টি করে। পাকিস্তানি বাহিনী পঞ্চগড় ত্যাগে বাধ্য হয়।
বার্তা সংস্থা এপি জানায়, ভারতীয় আক্রমণের চাপে পূর্ব পাকিস্তানের তিনটি সীমান্তবর্তী গ্রাম থেকে পাকিস্তান সেনারা সরে যেতে বাধ্য হয়েছে বলে পাকিস্তানের সরকারি কর্তৃপক্ষ আজ স্বীকার করে। এক সরকারি মুখপাত্র জানান, পূর্ব পাকিস্তানের ১৫ বর্গমাইল এলাকা এখন ভারতের নিয়ন্ত্রণে।
পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি খান আবদুল ওয়ালি খানকে তাঁর বাসভবনে নজরবন্দী এবং তাঁর গতিবিধির ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।
রাওয়ালপিন্ডিতে এক সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতে ইসলামীর পূর্ব পাকিস্তান শাখার আমির গোলাম আযম বলেন, জামায়াতে ইসলামীর সদস্য এবং রাজাকাররা পাকিস্তানকে রক্ষার জন্য প্রাণ দিচ্ছে।
সূত্র: স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসী বাঙালি, আবদুল মতিন, র্যাডিক্যাল পাবলিকেশন্স, লন্ডন, যুক্তরাজ্য; ইত্তেফাক, ঢাকা, ১ ডিসেম্বর ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত, ১ ও ২ ডিসেম্বর ১৯৭১; দ্য টাইমস, লন্ডন, যুক্তরাজ্য, ৩০ নভেম্বর ১৯৭১
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান