বিজ্ঞাপন
default-image

সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় ২৪ আগস্ট পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতদের দুই দিনব্যাপী সম্মেলন শুরু হয়। সম্মেলনে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে গোপন আলোচনা হয়। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুলতান মোহাম্মদ খানের সভাপতিত্বে এ সম্মেলনে বিভিন্ন দেশে নিয়োজিত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতেরা বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম সম্পর্কে বিভিন্ন দেশের সরকারি মহলের প্রতিক্রিয়া বর্ণনা করেন।

যুক্তরাষ্ট্রে নিয়োজিত রাষ্ট্রদূতের পক্ষ থেকে জেড এম ফারুকী বলেন, চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারে সহায়তার জন্য প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন পাকিস্তানের প্রতি সহানুভূতিশীল। তিনি স্বীকার করেন, যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস ও সাধারণ মানুষ বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল। আওয়ামী লীগ ও শরণার্থীদের প্রতি সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডির সমর্থনের কারণে পাকিস্তানের সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানে বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে পাকিস্তানের পক্ষে প্রচারকাজ চালানো সহজ হবে। পাকিস্তানের দুই অংশ থেকে ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রচারাভিযান চালানো হলে সুফল পাওয়া যাবে বলে তিনি মত দেন।

সোভিয়েত ইউনিয়নে নিয়োজিত রাষ্ট্রদূত জামসেদ মার্কার বলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে রাশিয়া কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করবে না বলে তাঁর ধারণা। ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়ন চুক্তি কেবল দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় রাশিয়ার প্রতিপত্তি বাড়াবে। এ চুক্তি যতটা চীনের বিরুদ্ধে, ততটা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয়।

যুক্তরাজ্যে নিয়োজিত হাইকমিশনার সালমান আলী বলেন, ব্রিটিশ সরকার পাকিস্তানের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে একমত নয়। বিভিন্ন বাঙালি প্রতিষ্ঠানের কার্যকলাপের বিরোধিতা করার জন্য তিনি পাকিস্তান সলিডারিটি প্রতিষ্ঠান গঠনে সহায়তা করেছেন বলে প্রকাশ করেন। ব্রিটেনের সংবাদপত্র ইহুদিদের করায়ত্ত বলেই পাকিস্তানবিরোধী। লেবার পার্টি ১৯৪৭ সালের দেশভাগ বানচাল করার জন্য বদ্ধপরিকর। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর যুক্তরাজ্য সফর এবং জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন শুরু হওয়ার সময় দ্য টাইমসসহ অন্যান্য সংবাদপত্রে প্রচারণামূলক বিজ্ঞাপন দেওয়ার প্রস্তাব করেন। তিনি সেখানে পূর্ব পাকিস্তানে অবাঙালি হত্যাসম্পর্কিত পাকিস্তানি চলচ্চিত্র প্রদর্শনের ব্যবস্থা করবেন বলে জানান।

চীনে নিয়োজিত বাঙালি রাষ্ট্রদূত কে এম কায়সার বলেন, চীন বাংলাদেশের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে রাজি নয়। বাংলাদেশের প্রতি ভারতের সমর্থন সন্তোষজনক বলে চীন মনে করে। ভারত-সোভিয়েত চুক্তির খবর চীনের সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়নি। তারা মনে করে, এ চুক্তি তাদের স্বার্থবিরোধী। চীন আফগানিস্তান, বার্মা, শ্রীলঙ্কা ও নেপালের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করবে। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হলে চীন কী ধরনের সাহায্য দেবে, সে সম্পর্কে তিনি নিশ্চিত নন।

জাতিসংঘে নিয়োজিত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত আগা শাহী বলেন, জাতিসংঘের আসন্ন সাধারণ অধিবেশনে ভারত বাংলাদেশের ব্যাপারে সদস্যদেশগুলোর জোরালো সমর্থন পাবে। সেটা এড়াতে হলে বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠা, উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শরণার্থীকে দেশে ফিরিয়ে নেওয়া, বর্তমান খাদ্য সমস্যার সমাধান এবং শেখ মুজিবের বিচার স্থগিত রাখার ব্যাপারে কার্যকর পন্থা গ্রহণ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদপত্রগুলো, বিশেষত নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, টাইমনিউজউইক পাকিস্তানের প্রতি বিরূপ মনোভাবাপন্ন।

যুগোস্লাভিয়ায় নিয়োজিত রাষ্ট্রদূত আই এ আখুন্দ বলেন, যুগোস্লাভ সরকার পাকিস্তানের প্রতি সহানুভূতিশীল, তবে তারা বাংলাদেশের বিদ্রোহে ভারতের হাত রয়েছে বলে বিশ্বাস করে না।

ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস ও সুইজারল্যান্ডে নিয়োজিত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতেরা বলেন, এসব দেশের সরকার বাংলাদেশ সম্পর্কে পাকিস্তানের বক্তব্য মেনে নেয়নি। পোল্যান্ড ও চেকোস্লাভাকিয়াও পাকিস্তানের সঙ্গে একমত নয়। শুধু ফ্রাংকোর স্পেন পাকিস্তান সরকারকে সমর্থন করছে।

বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ডি পি ধরের গোপন বৈঠক

ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারণী কমিটির চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ বিষয়ে বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত ডি পি ধর ২৪ আগস্ট কলকাতায় বাংলাদেশ সরকারের নেতাদের সঙ্গে গোপন একটি বৈঠক করেন। ডি পি ধর বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করার জন্য ২৩ আগস্ট দিল্লি থেকে কলকাতায় আসেন।

তিনি বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে বাংলাদেশের ভেতরে মুক্তিবাহিনীর কার্যক্রম ও তার প্রভাব, শরণার্থী সমস্যার নানা দিক এবং ভারতের পূর্বাঞ্চলে বাংলাদেশের ঘটনাকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতিসহ আরও কিছু বিষয়ে আলোচনা ও পর্যালোচনা করেন। বাংলাদেশ সরকারের নেতাদের সঙ্গে এ আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে বলে দিল্লির সরকারি সূত্র জানায়।

মুক্তিবাহিনীর অভিযান

মুক্তিবাহিনীর ২ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা সুবেদার আবদুল ওহাবের (স্বাধীনতার পর বীর বিক্রম ও অনারারি ক্যাপ্টেন) নেতৃত্বে কুমিল্লা-সিলেট সড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়া-কুমিল্লা সীমান্তবর্তী কালামুড়া ব্রিজের দুই মাইল দক্ষিণে মাধবপুর ও মিরপুরের মাঝখানে পাকিস্তানি সেনাবাহী দুটি স্টেট বাস, তিনটি জিপ ও দুটি ডজ গাড়ি অ্যামবুশ করে। তীব্র আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর গাড়িগুলো ক্ষতিগ্রস্ত এবং কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। তিনজন পাকিস্তানি সেনা এবং একজন রাজাকার অস্ত্রশস্ত্রসহ ধরা পড়ে। ২ নম্বর সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা কালামুড়া ব্রিজে অবস্থানরত রাজাকারদের ওপর হামলা করলে সাতজন আত্মসমর্পণ করে। পরে মুক্তিযোদ্ধারা কালামুড়া ব্রিজ ধ্বংস করেন।

মেহেরপুরে একদল পাকিস্তানি সেনা নাটোদা থেকে মুজিবনগরের দিকে অগ্রসর হলে মুক্তিবাহিনীর একটি দল বাগুয়ানে এবং আরেকটি দল মানিকনগরে পাকিস্তানি সেনাদের অ্যামবুশ করে। প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী যুদ্ধে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনারা হতাহত হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধাও আহত হন।

সাতক্ষীরায় আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা আশাশুনিতে রাজাকারদের ক্যাম্প আক্রমণ করে। ক্যাম্পটি সম্পূর্ণ ধ্বংস এবং কয়েকজন রাজাকার নিহত হয়।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর দুই, আট ও নয়; মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি: যুক্তরাজ্য, আবদুল মতিন, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা; আনন্দবাজার পত্রিকা ও যুগান্তর, ভারত, ২৫ ও ২৬ আগস্ট ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান