মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সহায়তায় গঠিত জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি ৬ নভেম্বর মুজিবনগরে দীর্ঘ বৈঠক করে।
সেখানে তারা আবারও সিদ্ধান্ত নেয়, পাকিস্তানের কাঠামোয় বাংলাদেশের আর কোনো রফা হতে পারে না। বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনার পর একটি রাজনৈতিক প্রস্তাবের রূপরেখা স্থির হয়। এটিই ছিল কমিটির প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠক।
মুজিবনগরে একটি সূত্র সাংবাদিকদের জানায়, চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে পাকিস্তানের বাঙালি রাষ্ট্রদূত কে এম কায়সারকে নিষ্ক্রিয় করে রাখায় কয়েক সপ্তাহ ধরে চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে রাষ্ট্রদূত পর্যায়ে আলোচনা কার্যত বন্ধ।
পাকিস্তান সরকার তাঁকে সব কাজ থেকে নিবৃত্ত করে রেখেছে। দূতাবাসের আরও চারজন বাঙালি কর্মীর ক্ষেত্রেও একই ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
রাশিয়া ভারতকে অস্ত্র দেবে
যুক্তরাষ্ট্র সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নিউইয়র্কে টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেন, ভারত আক্রান্ত হলে সোভিয়েত ইউনিয়সহ বহু দেশ তাদের অস্ত্র সাহায্য করবে বলে তাঁর বিশ্বাস।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের কারণে ভারতে উদ্ভূত পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্র ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছে। বাংলাদেশ সমস্যার সমাধানে আন্তরিক চেষ্টাও চলছে। তবে বিষয়টির গুরুত্ব সম্পর্কে সবাই সমানভাবে জানতে পারছেন কি না সন্দেহ।
ওয়াশিংটনে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, সীমান্ত থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করার কোনো প্রস্তাব তাঁর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
ভারতে পরিদর্শক দল পাঠানোর ব্যাপারে জাতিসংঘের প্রস্তাবও তিনি সমর্থন করেন না। তিনি বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমেই পাকিস্তান সরকার সংকটের অবসান ঘটাতে পারে। আর কোনো পথ খোলা নেই।
সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য এবং পার্টির মস্কো কমিটির প্রধান ভি ভি গ্রিসিন ক্রেমলিন প্রাসাদে বিপ্লব দিবস উদ্যাপন অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় বাংলাদেশে দ্রুত রাজনৈতিক সমাধানের জন্য আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, প্রচণ্ড গণ–অত্যাচারের কারণে ৯০ লাখের বেশি লোক পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে চলে গেছেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন এ ঘটনায় উদ্বিগ্ন।
ভারতে বাংলাদেশের পক্ষে
সিপিএম কেন্দ্রীয় কমিটি এই দিন বাংলাদেশ সম্পর্কে নেওয়া এক প্রস্তাবে বলে, দুই রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী সীমান্তে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এড়ানোর চেষ্টা করা উচিত। তারা দাবি করে, ভারত অবিলম্বে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিক এবং সর্বাত্মকভাবে সাহায্য করুক।
চারদিন ধরে নানা আলোচনার পর এদিন কলকাতায় কেন্দ্রীয় কমিটির অধিবেশন শেষ হয়।
সিপিআইয়ের সাধারণ সম্পাদক রাজেশ্বর রাও চণ্ডীগড়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সীমান্তে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক মোতায়েন করতে না দিয়ে ইন্দিরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
উপনির্বাচন নিয়ে সন্দেহ
পূর্ব পাকিস্তানের উপনির্বাচন ন্যায়সংগতভাবে হয়েছে কি না, তা নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান সংবাদপত্রগুলো এদিন সন্দেহ প্রকাশ করে। জুলফিকার আলীর ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) ছয়জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যেভাবে জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত হন, করাচির ডন পত্রিকার ঢাকার সংবাদদাতা তাকে রহস্যজনক বলে বর্ণনা করেন।
তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হলো, প্রতিটি ক্ষেত্রেই ছয় দলীয় জোটের একজন সর্বসম্মত প্রার্থী (পিডিপির সদস্য) পিপিপি প্রার্থীর পক্ষে সরে দাঁড়ান।
লাহোরের আরেকটি দৈনিক আজাদ ছয়জন প্রার্থীর জয় নিয়ে তদন্ত দাবি করে।
পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির (পিডিপি) সভাপতি নুরুল আমিন লাহোরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা করেন।
পূর্ব পাকিস্তানের সর্বশেষ পরিস্থিতি এবং নির্বাচন সম্পর্কে তিনি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলেন।পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য রাজাকার বাহিনীর শক্তি বাড়ানোর প্রয়োজনের কথাও তিনি প্রেসিডেন্টকে বলেন।
নুরুল আমিন লাহোরে বলেন, ইয়াহিয়া পূর্ব পাকিস্তানে রাজাকারের সংখ্যা আরও বাড়াতে এবং তাদের আরও বেশি করে অস্ত্র দিতে রাজি হয়েছেন। কারণ, ওখানে অন্তর্ঘাত বেড়ে গেছে।
মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযান
মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে এদিন সাংবাদিকদের জানানো হয়, মেহেরপুরের দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পশ্চিমে বিরাট অঞ্চল এখন মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। মুক্তিবাহিনী সকালে পাকিস্তানি সেনাদের যাদবপুর ঘাট ও বুড়িবাকা থেকে উচ্ছেদ করে।
মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে আরও জানানো হয়, ভারতের নদীয়ায় বানপুর সীমান্তে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়েছে। এই যুদ্ধ চলাকালে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা করে।
এদিন সকালে পাকিস্তানি সেনারা সীমান্তসংলগ্ন ছয়টি ভারতীয় গ্রামে বেপরোয়া গুলি চালালে মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা পাল্টা জবাব দেন।
২ নম্বর সেক্টরে ঢাকা শহরের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত গেরিলাযোদ্ধাদের একটি দল মতিঝিলে পিআইএ অফিসে অভিযান পরিচালনা করে।
তাদের বোমা বিস্ফোরণে অফিসের একাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আরেক দল গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা শাহবাগে পাকিস্তানিদের এক সহযোগীর ওপর হামলা করে।এই সহযোগী নিহত হয়।
৮ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা সাদীপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দলের ওপর আক্রমণ চালান।
ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের সেনা ও রাজাকারদের সমন্বয়ে গড়া পাকিস্তানি বাহিনীর এই দল সাদীপুরে পরিখা খোঁড়ার সময় মুক্তিযোদ্ধারা অতর্কিতে হামলা করলে তিনজন হতাহত হয়।
এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা চুয়াডাঙ্গার জীবননগরের রাজাপুরে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ করে। এর আগে তাঁরা জয়রামপুর-চুয়াডাঙ্গার মধ্যবর্তী রেললাইনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে।
ফেনী–বিলোনিয়া রেললাইনের কাছাকাছি ৫ নভেম্বর রাত ১২টার পর বৃষ্টিতে পরিখা খুঁড়ে অবস্থান নিয়েছিলেন এয়ার আহমদসহ (স্বাধীনতার পর মরণোত্তর বীর বিক্রম) একদল মুক্তিযোদ্ধা। ভোরে কমে আসা বৃষ্টিতে অনেকেই তন্দ্রাচ্ছন্ন।
এমন সময় রেলসড়কে ট্রেন চলার শব্দ। এক ক্যাপ্টেন চার জওয়ানকে নিয়ে রেলট্রলিতে করে বেরিয়েছে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের খোঁজে। তারা চিথলিয়ার দিকে আসছিল।
নাগালে এলেই গর্জে ওঠে হালকা মেশিনগান। সঙ্গে সঙ্গে নিহত হয় ওই পাঁচ পাকিস্তানি। দুঃসাহসী এয়ার আহমেদ ওই পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনের ব্যাজ আর ট্রলির অস্ত্রশস্ত্র আনতে ছুটে গেলে শত্রুর গুলি তাঁকে আর ফিরতে দেয়নি।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর আট; ইত্তেফাক, ঢাকা, ৭ নভেম্বর ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত, ৭ ও ৮ নভেম্বর ১৯৭১; ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন, ৬ নভেম্বর ১৯৭১
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান