বিজ্ঞাপন
default-image

বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে বিদেশি নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ২৪ অক্টোবর পাশ্চাত্য দেশগুলোতে তাঁর তিন সপ্তাহের সফর শুরু করেন। সকালে তিনি দিল্লি থেকে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে রওনা হন।

এটি ছিল ভারতীয় ইন্দিরা গান্ধীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কূটনৈতিক সফর। তিনি বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও পশ্চিম জার্মানি সফরের উদ্দেশে যাত্রা করেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পকে৴ ভারতের অভিমত এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটাতে উদ্‌গ্রীব পাকিস্তানের যুদ্ধ–হুমকি নিয়ে কথা বলা। ওয়াকিবহাল মহল জানায়, ইন্দিরা বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের গভীর উদ্বেগের কথা বিদেশি নেতাদের বোঝাতে পারবেন বলে দৃঢ় আশাবাদ নিয়ে গেছেন। ইন্দিরা গান্ধী, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যকে পাকিস্তানের ওপর চাপ দিতে বলবেন।

তবে পশ্চিমা মহল মনে করছিল, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য পাকিস্তানের কাঠামোয় বাংলাদেশের নেতাদের সমাধানে আসতে রাজি করাতে ইন্দিরা গান্ধী সক্ষম হবেন। তাঁরা এ–ও ভাবছিলেন, ইন্দিরা এ ধরনের ভূমিকা নেবেন না কিংবা বাংলাদেশের সমস্যাকে ভারত-পাকিস্তান সমস্যা হিসেবেও দেখাতে দেবেন না।

জাতিসংঘ দিবস উপলক্ষে দিল্লিতে এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধানের জন্য পাকিস্তানের সরকারকে বাধ্য করতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানান।

বাংলাদেশ নিয়ে বিদেশি পত্রিকা

সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির সংবাদপত্র প্রাভদা ২৪ অক্টোবর বাংলাদেশের ঘটনা নিয়ে দীর্ঘ নিবন্ধ প্রকাশ করে। নিবন্ধে পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানের সামরিক দখলদারি রাজত্বের নিন্দা করা হয়।

লন্ডনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলে, ৯০ লাখ ক্ষুধার্ত মানুষের জীবনধারণের সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে হয়তো শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করতে হবে। তবে ইন্দিরার তিন সপ্তাহের বিশ্ব সফরকালে চলবে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ না–ও হতে পারে। বিশ্বশান্তি অক্ষুণ্ন রাখতে হলে শরণার্থীদের দেশে ফেরার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।

বাংলাদেশ ও মুক্তিবাহিনী

মুজিবনগরে অনুষ্ঠিত এক সভায় মোজাফফরপন্থী ন্যাপ অভিমত প্রকাশ করে, বাংলাদেশের একমাত্র সমাধান পূর্ণ স্বাধীনতা। বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা কমিটি গঠনে সমর্থন জানিয়ে সভায় সর্বস্তরে এমন কমিটি গঠনের প্রত্যাশা করা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ।

৮ নম্বর সেক্টরের আওতাধীন এলাকার সাদীপুর, তীতুদহ ও বেড়াশুলাসহ কয়েকটি স্থানে এদিন যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সেনা ও রাজাকারদের সমন্বয়ে গড়া পাকিস্তান বাহিনীর একটি দল সকাল ১০টার দিকে ২ ইঞ্চি মর্টারের সাহায্যে মুক্তিযোদ্ধাদের সাদীপুরের অবস্থানে আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা গোলাবর্ষণ শুরু করেন। এরপর দুই পক্ষে বহুক্ষণ যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে একজন শহীদ ও কয়েকজন আহত হন।

চুয়াডাঙ্গার সদর থানার তীতুদহ গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন অবস্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর আরেকটি দল আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা আক্রমণ করলে দুই পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর একজন সেনা ও কয়েকজন রাজাকার হতাহত হয়।

এই সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল ঝিনাইদহ মহকুমার সদর থানার অন্তর্গত বেড়াশুলা গ্রামে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী রাজাকারদের ক্যাম্পে আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের আকস্মিক আক্রমণে রাজাকাররা হতভম্ব হয়ে তেমন কোনো প্রতিরোধ গড়তে পারেনি। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে প্রায় ১১ জন রাজাকার হতাহত হয়।

পাকিস্তানে তৎপরতা

পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো এই দিন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের বিশেষ দূত হিসেবে মিসরের রাজধানী কায়রোয় রওনা হন। ভুট্টো মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করবেন। দুই দিন কায়রোয় অবস্থানের পর তিনি জেনেভায় যাবেন।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী অবরুদ্ধ বাংলাদেশের আখাউড়া থেকে রাত আটটায় ভারতের ত্রিপুরা রাজে৵র রাজধানী আগরতলায় গোলাবর্ষণ করলে পাঁচজন বেসামরিক লোকসহ ২০ জন আহত হয়। সেখানে নিষ্প্রদীপ মহড়া চলাকালে শহর ও আশপাশে কতগুলো গোলা পড়ে। এই প্রথম কোনো রকম প্ররোচনা ছাড়াই পাকিস্তানিরা আগরতলা শহরে গোলাবর্ষণ করে। প্রায় ১০ মিনিট গোলা বর্ষিত হয়। করিমপুরেও পাকিস্তানিরা গোলাবর্ষণ করে।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৮; আনন্দবাজার পত্রিকা যুগান্তর, কলকাতা, ভারত, ২৫ ও ২৬ অক্টোবর ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান