মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে ১৩ সেপ্টেম্বর সপ্তদশ কমনওয়েলথ সংসদীয় সম্মেলনের উদ্বোধনী দিনে আলোচ্যসূচিতে না থাকলেও কয়েকজন প্রতিনিধি বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। যুক্তরাজ্যের প্রতিনিধি এবং সাবেক মন্ত্রী আর্থার বটমলি বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যেন পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কথা বলেন। কারণ, তিনিই পূর্ব পাকিস্তানের প্রতীক এবং সেখানকার জনগণের পক্ষে কথা বলার অধিকারী। আর্থার বটমুলি শেখ মুজিবের মুক্তি দাবি করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারের প্রতি আবেদন জানিয়ে বলেন, ব্রিটেন ইতিহাস থেকে শিখেছে, জননেতাকে কারাগারে পাঠাতে নেই।
ভারতের প্রতিনিধিদলের নেতা এবং নিম্নকক্ষ লোকসভার স্পিকার জি এস ধীলন কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোকে বাংলাদেশের শরণার্থী সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে বলেন, পূর্ববঙ্গ সমস্যা ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে নয়, বরং পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যকার যুদ্ধের সমস্যা।
নিউজিল্যান্ডের প্রতিনিধি এইচ সি টেম্পেল্টন তাঁর দেশের পক্ষ থেকে কমনওয়েলথ এবং যুক্তরাজ্যকে পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য অনুরোধ করেন।
আরও কূটনীতিকের পাকিস্তানের পক্ষত্যাগ
ফিলিপাইনে পাকিস্তানের বাঙালি রাষ্ট্রদূত খুররম খান পন্নী ১৩ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করেন। এর আগে ইরাকে নিযুক্ত বাঙালি রাষ্ট্রদূত আবুল ফতেহ পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য প্রকাশ করেন। খুররম খান পন্নী পদত্যাগের পর ম্যানিলায় অবস্থানের সিদ্ধান্ত নেন।
নাইজেরিয়ার রাজধানী লাগোসে পাকিস্তান হাইকমিশনের বাঙালি চ্যান্সারি কর্মকর্তা মহিউদ্দিন আহমদ জায়গীরদারও পদত্যাগ করে এই দিন সপরিবার লন্ডন পৌঁছে বাংলাদেশ মিশনে যোগ দেন। তিনি পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কূটনীতিক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে তাঁকে চ্যান্সারি প্রধান হিসেবে নাইজেরিয়ার লাগোসে পাঠানো হয়।
দিল্লিতে তাজউদ্দীনের প্রতিনিধি
বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের প্রতিনিধি মঈদুল হাসান ১৩ সেপ্টেম্বর ভারতের রাজধানী দিল্লিতে দেশটির বেসরকারি গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইংয়ের (‘র’) প্রধান রামনাথ কাওয়ের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি আলাদা একটি বাহিনী হিসেবে মুজিব বাহিনী গঠনের ফলে উদ্ভূত সমস্যা নিয়ে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করেন।
দিল্লিতে এ দিন কূটনৈতিক মহল সাংবাদিকদের জানায়, বাংলাদেশ নিয়ে বোঝানোর ব্যাপারে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিংয়ের শ্রীলঙ্কা সফর ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক সমাধান দরকার, এই কথাটুকুও শ্রীলঙ্কাকে দিয়ে যুক্ত ইশতেহারে বলানো সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশে সেনা ও রসদ পাঠানোর কাজে নিয়োজিত পাকিস্তানি বিমান ও জাহাজকে নামার ও তেল ভরার সুযোগ শ্রীলঙ্কা দিয়ে আসছিল। তারা আশঙ্কা করছিল, সমর্থন দিলে ভারত এ অঞ্চলে একটি বৃহৎ শক্তি হয়ে উঠবে।
ভারত সফররত যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ এবং ভারতে দেশটির সাবেক রাষ্ট্রদূত জন কেনেথ গলব্রেথ কলকাতায় এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেন, পূর্ব বাংলার জনগণকে অনভিপ্রেত কোনো সরকারের অধীনে রাখলে তা পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের জন্য বিপর্যয়কর হবে। বাংলাদেশ সমস্যার একমাত্র সমাধান সেখানকার জনসাধারণকে তাদের ইচ্ছানুযায়ী সরকার গঠন করতে দেওয়া।
পাকিস্তানে ও বাংলাদেশে
পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো এই দিন করাচিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকের বিষয়বস্তু প্রকাশ করা হয়নি। তবে কূটনৈতিক মহল জানায়, বৈঠকে ভুট্টো ইয়াহিয়ার কাছে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা দেওয়ার দাবি জানান, কিন্তু ইয়াহিয়া ভুট্টোকে তা এখনই সম্ভবপর নয় বলে জানান।
৩ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা আখাউড়া-হরশপুর রেললাইনে মুকুন্দপুরের কাছে ট্যাংকবিধ্বংসী মাইন পুঁতে রিমোট কন্ট্রোল হাতে নিয়ে অবস্থান নেয়। পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারবাহী একটি ট্রেন মাইনের ওপরে এলে মুক্তিযোদ্ধারা তাতে বিস্ফোরণ ঘটান। এতে পাকিস্তানি সেনারা হতাহত হয়। এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা শাহবাজপুরে পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থানে আক্রমণ চালান। এই সংঘর্ষে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়।
৭ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল রামচন্দ্রপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটি আক্রমণ করলে কয়েকজন সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধা দলের একজন শহীদ ও দুজন আহত হন।
৮ নম্বর সেক্টরের একদল মুক্তিযোদ্ধা হরিনগরে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি গানবোট ও সেনাবোঝাই লঞ্চকে অ্যামবুশ করলে গানবোট ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং লঞ্চ পানিতে ডুবে যায়।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর তিন ও আট; মূলধারা ’৭১, মঈদুল হাসান, ইউপিল, ঢাকা; স্বাধীনতাসংগ্রামে প্রবাসী বাঙালি, আবদুল মতিন, র্যাডিক্যাল এশিয়া পাবলিকেশনস, লন্ডন, যুক্তরাজ্য; দ্য গার্ডিয়ান ও দ্য টাইমস, লন্ডন, যুক্তরাজ্য, ১৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা ও যুগান্তর, কলকাতা, ভারত, ১৪ ও ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান