বিজ্ঞাপন
default-image

ভারতের রাজধানী দিল্লিতে ৩০ জুলাই সরকারি একটি সূত্র সাংবাদিকদের জানায়, জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের বাংলাদেশের পরিস্থিতি বিবেচনা করে দেখার প্রস্তাব করেছেন। এই বিচার–বিবেচনা আনুষ্ঠানিক, না ঘরোয়া হবে, তা স্থির করার ভার তিনি নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতির কাছে লেখা একটি চিঠিতে উ থান্ট এ কথা বলেন। পরিষদের সব সদস্যরাষ্ট্রকে চিঠির অনুলিপি দেওয়া হয়।

রয়টার্স জানায়, জাতিসংঘের স্থায়ী পরিষদের সভাপতি জাক কোসসিউস্কো সপ্তাহখানেক আগে
পাওয়া ভারত-পাকিস্তান পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের গোপন স্মারকলিপির পূর্ণ বিবরণ প্রকাশের ব্যাপারে ১৫ জাতি পরিষদের অন্য সদস্যদের সঙ্গে আলাপ–আলোচনা করেছেন।

বাংলাদেশ ও ভারতে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক মোতায়েনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনাকে জড়িয়ে মহাসচিবের প্রস্তাবে ভারতে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। তারা মনে করে, এ উদ্যোগ মূল বিষয় থেকে বিশ্বের দৃষ্টি সরিয়ে দিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের দ্বন্দ্ব বলে তুলে ধরার অভিসন্ধি। সমস্যাটিকে ভারত–পাকিস্তানের বিরোধ হিসেবে তুলে ধরার কোনো প্রচেষ্টাতেই ভারত যুক্ত হতে অসম্মতি জানায়।

ভারতের কেন্দ্রীয় শ্রম ও পুনর্বাসনমন্ত্রী আর কে খাদিলকর সংসদের উচ্চকক্ষ রাজসভায় জানান, বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য এ বছরের বাজেটে বরাদ্দ করা ৬০ কোটি ইতিমধ্যেই খরচ হয়ে গেছে। আরও টাকা দরকার। তিনি আরও বলেন, এ পর্যন্ত শরণার্থীর সংখ্যা ৭০ লাখ ৬ হাজার ৭১৬ জনে দাঁড়িয়েছে। শরণার্থী আসার সম্ভাবনা ৮০ লাখ থেকে ১ কোটি।

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের একজন মুখপাত্র সাংবাদিকদের জানান, শরণার্থী শিবিরগুলো দেখাশোনার কাজে নিযুক্ত বিদেশিদের বদলে এখন সেখানে ভারতীয়দের নিয়োগ করা হয়েছে। বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার ২৬ জন প্রতিনিধিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে চলে যাওয়ার জন্য নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এমন বিদেশি কর্মী প্রায় ৪৮ জন। বাকিদেরও চলে যাওয়ার জন্য নোটিশ দেওয়া হবে।

বিদেশি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন

ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা ‘পূর্ববঙ্গে গণহত্যা’ শিরোনামে এদিন আধা পৃষ্ঠার একটি বিজ্ঞাপন ছাপে। বিজ্ঞাপনে ঢাকার রাস্তায় তিন তরুণের মৃতদেহের একটি ছবির নিচে লেখা ছিল, ‘ছবিটি আপনার ছেলেমেয়েদের দেখান এবং তাদের সঙ্গে নিয়ে ১ আগস্টের জনসমাবেশে যোগ দিন।’ অ্যাকশন বাংলাদেশের উদ্যোগে প্রকাশিত এই বিজ্ঞাপনে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীসহ অন্য বক্তাদের নাম এবং বার্মিংহাম, ব্র্যাডফোর্ড, কেমব্রিজ, কার্ডিফ, কভেন্ট্রি, গ্লাসগো, লিডস, লিভারপুল, ম্যানচেস্টার, পোর্টসমাউথ ও শেফিল্ড থেকে যাতায়াতের ব্যবস্থা সম্পর্কে খোঁজ নেওয়ার জন্য টেলিফোন নম্বর উল্লেখ করা হয়। গণসমাবেশে যোগ দিতে অসমর্থদের কাছে বাংলাদেশ আন্দোলনের কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য অর্থ সাহায্যের আবেদন জানানো হয়।

পূর্ব পাকিস্তানে শান্তি স্থাপনের ব্যাপারে এদিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদে একটি যৌথ প্রস্তাব পেশ করা হয়। সিনেটে প্রস্তাব পেশ করেন সিনেটর ওয়াল্টার মন্ডেল; প্রতিনিধি পরিষদে ডোনাল্ড ফ্রেজার। দুজনই ডেমোক্র্যাট দলীয় সদস্য। বৈদেশিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটির সদস্য সিনেটর জেমস পিয়ারসন সিনেটে বলেন, পররাষ্ট্র দপ্তর যদি পাকিস্তানকে এ কথা বুঝিয়ে দিতে না পারে যে বাংলাদেশের মানুষকে বর্বরভাবে হত্যা করাটাকে যুক্তরাষ্ট্র ক্ষমার চোখে দেখছে না, তাহলে সিনেট আইন করে পাকিস্তানকে সাহায্য দেওয়া বন্ধ করে দিতে পারে। বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য পাকিস্তান ব্যবস্থা না নিলে সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদ উভয়েই পাকিস্তানকে এ সাহায্য বন্ধের জন্য ব্যবস্থা নিতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সিনেটর ইউজিন ম্যাককার্থি লন্ডনের ডরচেস্টার হোটেলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে তিনি সমর্থন করেন। নাইজেরিয়ার গৃহযুদ্ধের সময়ও তিনি স্বাধীন বায়াফ্রার দাবি সমর্খন করেছিলেন। তিনি মনে করেন, ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবি অধিকতর যুক্তিসংগত।

ব্রিটেনের বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটির নেতারা ইউজিন ম্যাকার্থীকে ১ আগস্ট ট্রাফালগার স্কয়ারে অনুষ্ঠেয় সমাবেশে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যেতে হচ্ছে বলে এই দিন তিনি ডরচেস্টার হোটেলে সংবাদ সম্মেলনে যোগ দেন।

সফল গেরিলা অভিযান

মুক্তিবাহিনীর একটি দল ইমামুজ্জামানের (স্বাধীনতার পর বীর বিক্রম ও মেজর জেনারেল) নেতৃত্বে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের চার মাইল দক্ষিণে নানকরায় পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দলকে অ্যামবুশ করে। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন সেনা হতাহত এবং একজন আহত অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বন্দী হয়।

কুমিল্লার শ্রীমন্তপুর, কোটেশ্বর আনন্দপুর ও নারায়ণপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের আলাদা হামলায় পাকিস্তানি সেনারা হতাহত হয়।

মুক্তিবাহিনীর একটি দল আশুগঞ্জ-সিদ্ধিরগঞ্জ লাইনে সরবরাহকারী বৈদ্যুতিক গ্রিডের দুটি থাম ধ্বংস করলে আশুগঞ্জ-ঢাকা বিদ্যুতের সংযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এই মুক্তিযোদ্ধারা এদিন ভৈরব-নরসিংদী-ঘোড়াশাল বাইপাস আশুগঞ্জ-ঢাকা লাইনের ১০০০ কিলোওয়াট গ্রিডের একটি থামও ধ্বংস করে এবং ভৈরব-ঢাকা টেলিফোন লাইনের দুটি করে মোট চারটি থাম ধ্বংস করে উপড়ে ফেলে।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর দুই; দ্য টাইমস, যুক্তরাজ্য, ৩১ আগস্ট ১৯৭১; ইত্তেফাক, ৩১ জুলাই ও ১ আগস্ট ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা, ভারত, ৩১ জুলাই ও ১ আগস্ট ১৯৭১; যুগান্তর, ভারত, ১ ও ২ আগস্ট ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান