বিজ্ঞাপন
default-image

ভারত ও পাকিস্তানের কাছে ২০ জুলাই জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের পাঠানো স্মারকলিপির জবাবে ভারতের বার্তা ২ আগস্ট নিউইয়র্কে তাঁর কাছে পৌঁছায়। চার পৃষ্ঠার ওই জবাবে ভারত জাতিসংঘের মহাসচিবকে জানায়, বাংলাদেশের মূল সমস্যাটি ধামাচাপা দেওয়ার বদলে সেখানে রাজনৈতিক সমাধানের উপযোগী স্বাভাবিক অবস্থা সৃষ্টি করা দরকার। শরণার্থীদের ফিরে যাওয়ার উপযুক্ত ও বিশ্বাসযোগ্য ব্যবস্থা করাও জরুরি। বাংলাদেশের মূল সংকট হচ্ছে, সংখ্যালঘু সামরিক শাসক সেখানে অবাধ নির্বাচনের রায় অস্বীকার করছে। বাংলাভাষী একটি জাতিকে গণহত্যা চালিয়ে নিশ্চিহ্ন করতে চাইছে। অবাস্তব পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সমস্যার সমাধান তো হবেই না, উপরন্তু মূল সমস্যাটি থেকে বিশ্বজনতার দৃষ্টি যারা অন্যত্র সরিয়ে দিতে চায়, তাদেরই সুবিধা করে দেওয়া হবে।

ভারতের কেন্দ্রীয় পররাষ্ট্রবিষয়ক উপমন্ত্রী সুরেন্দ্রনাথ সিং দেশটির সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় বলেন, বাংলাদেশের সীমান্ত বরাবর ভারতীয় এলাকায় এবং বাংলাদেশে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক মোতায়েনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র সরকার বেসরকারিভাবে প্রস্তাব করেছে। ভারত এ ব্যাপারে তাদের অসম্মতি জানিয়ে দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রে জনসমর্থন বাড়াতে

বাঙালি কূটনীতিক আবুল মাল আবদুল মুহিত ওয়াশিংটনে সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন বাড়াতে তিনি ওয়াশিংটনে একটি অফিস খোলার চেষ্টা করছেন। যুক্তরাষ্ট্রে থেকে কংগ্রেস ও প্রশাসন মহলে বাংলাদেশ সরকারের অনুকূলে সমর্থন বৃদ্ধির চেষ্টায় আত্মনিয়োগ করবেন বলে তিনি সংকল্প করেছেন।

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং লোকসভায় তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে ঘোষণা করেন, ‘বাংলাদেশের কোনো কোনো অংশে মুক্তিবাহিনীর সাফল্যের অছিলায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যদি ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাধাতে চান, তাহলে নিশ্চয়ই আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনী তার সমুচিত জবাব দেবে।’

দিল্লিতে নব কংগ্রেসের সংসদীয় দলের কর্মপরিষদের সভায় সংসদবিষয়ক রাষ্ট্রমন্ত্রী (প্রতিমন্ত্রী) ঘোষণা দেন, সংসদের প্রত্যেক সদস্য বাংলাদেশ তহবিলে ৫০ টাকা করে দান করবেন।

বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতিদানের দাবিতে দিল্লিতে জনসংঘের উদ্যোগে গতকাল থেকে শুরু হওয়া সত্যাগ্রহের দ্বিতীয় দিনে প্রায় ৭০০ সত্যাগ্রহী গ্রেপ্তারবরণ করেন। সংসদ ভবনের চারপাশে যে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, তা অমান্য করায় তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়।

বাংলাদেশের শরণার্থীদের চিকিৎসার জন্য পশ্চিম জার্মানির পাঠানো দ্বিতীয় ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল একটি বিশেষ বিমানে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কলকাতায় এসে পৌঁছায়। ১০৫ শয্যার এই হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটার, ডিসপেনসারি, অন্য আধুনিক যন্ত্রপাতিসহ সব ধরনের চিকিৎসার সুবিধা আছে। পশ্চিম জার্মান রেডক্রস ভারতীয় রেডক্রসকে এই হাসপাতাল দান করে। কলকাতায় পশ্চিম জার্মানির অস্থায়ী কনসাল জেনারেল ডা. কে এইচ কুনা কলকাতা বিমানবন্দরে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতীয় রেডক্রসের প্রতিনিধির কাছে হাসপাতালটির দায়িত্বভার অর্পণ করেন।

ভারতের রাজধানী দিল্লিতে পাকিস্তান হাইকমিশনের অন্যতম বাঙালি কর্মচারী আবদুল মজিদ এই দিন বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করে ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন। তিনি বিকেলে তাঁর নাবালক পুত্র মহিবুল মজিদকে সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তান হাইকমিশন ভবন ত্যাগ করেন। তাঁর কোনো কূটনৈতিক মর্যাদা ছিল না।

মুক্তিবাহিনীর শক্তি স্বীকার

পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের ব্যাংক ও অর্থসংস্থানগুলোর চার দিনব্যাপী বৈঠক উপলক্ষে এক বাণীতে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর ক্রমবর্ধমান শক্তি স্বীকার করে নিয়ে বলেন, তাদের চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করা হবে। ঢাকায় ২ আগস্ট থেকে এই সম্মেলন শুরু হয়। তিনি বলেন, জাতীয়তাবিরোধী শক্তি পাকিস্তানের অর্থনৈতিক কাঠামো বিকল এবং অখণ্ডতা ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা করছে। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।

গেরিলা অভিযান

একদল মুক্তিযোদ্ধা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিজয়পুর থানায় বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তবর্তী কালাছড়া চা-বাগানে পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটি আক্রমণ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের ছোড়া গ্রেনেড বিস্ফোরণে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকটি বাংকার ধ্বংস এবং কয়েকজন সেনা নিহত হয়। দুজন সেনা মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বন্দী হয়। মেশিনগানসহ কিছু অস্ত্র এবং কয়েক হাজার গুলি মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর দুজন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

উত্তরাঞ্চলের কুড়িগ্রামে মুক্তিবাহিনীর একটি দল ভারী অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর ভূরুঙ্গামারী কলেজ অবস্থানে আক্রমণ করে। দুই পক্ষের প্রচণ্ড যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হয়। আনসার আলী নামের একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও কয়েকজন আহত হন।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর দুই ও সাত; আনন্দবাজার পত্রিকাযুগান্তর, ভারত, ৩ ও ৪ আগস্ট ১৯৭১।

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান