বিজ্ঞাপন
default-image

স্বাধীন বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯ অক্টোবর বলেন, বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশ প্রশ্নে ইয়াহিয়া চক্রের সঙ্গে কোনো মীমাংসায় আসবে না। একজন বাঙালি জীবিত থাকলেও মুক্তিযুদ্ধ চলবে। বড় শক্তিগুলোর দান হিসেবে নয়, বাঙালিরাই কেবল বাংলাদেশকে স্বাধীন ও রক্ষা করতে পারে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে যে মুক্তিযুদ্ধ চলছে, তাতে তিনি খুবই আশাবাদী। মুক্তাঞ্চলে কুমিল্লা ও নোয়াখালী অঞ্চলের জন্য বাছাই করা গেরিলা এবং বাংলাদেশ বাহিনীতে সম্প্রতি কমিশন পাওয়া সেনা কর্মকর্তাদের উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার সময় তিনি এ কথা বলেন।

বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান মুজিবনগরে সাংবাদিকদের বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আটক রাখার কোনো অধিকার ইয়াহিয়া খানের নেই। বঙ্গবন্ধু একটি সম্পূর্ণ স্বাধীন রাষ্ট্রের নায়ক ও রাষ্ট্রপতি। অন্য একটি রাষ্ট্রের নেতাকে আটকে রাখার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না।

ইন্দিরা গান্ধীর সংবাদ সম্মেলন

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দিল্লিতে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ইয়াহিয়া খান নাকি আলোচনার জন্য উদ্‌গ্রীব। কিন্তু তাঁকে কথা বলতে হবে বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে, ভারতের সঙ্গে নয়। হয়তো তার ভিত্তি হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। সমস্যা বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের মধ্যে। এখানে ভারতের কোনো ভূমিকা নেই। ভারত এই বিরোধের কারণে যে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে, সেটা হলো ৯০ লাখ শরণার্থীর বোঝা। তিনি বলেন, মুক্তিবাহিনীর কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর মতো অস্ত্র ও শক্তি নেই। কিন্তু তাদের মধ্যে জ্বলছে দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার স্পৃহা। দেশপ্রেম যাদের হাতিয়ার, পরিণামে তারাই বিজয়ী হয়।

ইন্দিরা গান্ধী আরও বলেন, ভারত সীমান্তে সেনা মোতায়েন করছে পাকিস্তান। ভারতের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াচ্ছে। ধর্মীয় মতান্ধতাকে উসকানি দিচ্ছে। এসব উপেক্ষা করে কি ভারতীয় বাহিনীকে সতর্ক অবস্থান থেকে সরিয়ে আনা সম্ভব? যিনি ঘুষি পাকিয়ে আছেন, তাঁর সঙ্গে কি করমর্দন করা চলে?

বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান ইন্দিরা গান্ধীর বক্তব্য সম্পর্কে সাংবাদিকদের বলেন, তিনি বাংলাদেশের জনগণ এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মনের কথাই বলছেন। বাংলাদেশের সমস্যা বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গেই মেটাতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে ভারতীয় দূতাবাসের একজন মুখপাত্র বলেন, পাকিস্তান সীমান্তে সেনা সমাবেশের ব্যাপারে সংযত থাকার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধ ভারত প্রত্যাখ্যান করেছে। তিনি বলেন, সংযত থাকার অনুরোধ জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক আরও তিক্ত করেছে মাত্র।

রাও ফরমান আলীর স্বীকারোক্তি

অবরুদ্ধ বাংলাদেশে পাকিস্তানি অনুগত গভর্নরের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ১৯ অক্টোবর এএফপির প্রতিনিধির কাছে স্বীকার করেন, মুক্তিবাহিনীর ক্রমবর্ধমান গেরিলা আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা নাজেহাল হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, জুন-জুলাইয়ের তুলনায় নাশকতার ঘটনা অনেক বেড়েছে। এসব কারণে হতাহতের ঘটনা ঘটছে। তিনি বলেন, প্রথম দিকে গেরিলা আক্রমণ সীমাবদ্ধ ছিল যোগাযোগব্যবস্থা, বিদ্যুৎ সরবরাহ ও চা-বাগানগুলোতে। পাকিস্তানি সেনারা নিরাপত্তা জোরদার করলে তারা ব্যক্তিগত হামলায় নামে এবং পাটের সরবরাহে আক্রমণ চালায়। তিনি বলেন, দক্ষিণের জেলাগুলোতে গেরিলা নাশকতার পরিমাণ বেশি।

পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডি থেকে বার্তা সংস্থা এপি জানায়, পাকিস্তানের সামরিক সূত্রে জানা গেছে, নভেম্বরে মুক্তিবাহিনীর ওপর প্রচণ্ড আঘাত হানার জন্য পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসন পরিকল্পনা করছে। বর্ষা শেষ হলে মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে সুবিধা হবে বলে তারা ভাবছে।

বিভিন্ন সামরিক সূত্রে জানা গেছে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী পশ্চিম পাকিস্তানের ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার সীমান্তে প্রায় আড়াই লাখ এবং পূর্ব পাকিস্তানে ৮০ হাজার সেনা মোতায়েন রেখেছে।

ঢাকায় মুক্তিবাহিনীর অভিযান

২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা এই দিন ঢাকার মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার নিরাপত্তায় নিয়োজিত পাকিস্তানি সেনাদের ফাঁকি দিয়ে হাবিব ব্যাংক ও ইপিআইডিসি ভবনের সামনে বোমা ফাটান। এতে পাকিস্তানি সেনাসহ কিছু সাধারণ মানুষও হতাহত হন।

পরদিন ইত্তেফাক-এ প্রকাশিত খবরে বলা হয়, ‘বেলা অনুমান ১১টায় মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকাস্থ হাবিব ব্যাংক ও ইপিআইডিসি ভবনের সম্মুখে বোমা বিস্ফোরণের ফলে ৫ ব্যক্তি নিহত ও ১৩ ব্যক্তি আহত হয়। আহতদের মধ্যে ৬ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলিয়া হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে। বোমা বিস্ফোরণের ফলে হাবিব ব্যাংক বিল্ডিংয়ের সম্মুখে পার্ক করা ৬টি মোটরগাড়ি সম্পূর্ণরূপে ভস্মীভূত হইয়াছে। ইহা ছাড়া আরও ১৯/২০টি মোটরগাড়ি ও ৮ তলা হাবিব ব্যাংক বিল্ডিংয়ের কাঁচের সার্সি ইত্যাদি ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে।’

এই সেক্টরের আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা কুমিল্লার মিয়াবাজার ও পান্নাপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে অভিযান চালান। আকস্মিক এ আক্রমণে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়।

৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা মর্টার, মেশিনগান ও এলএমজির সাহায্যে যশোর জেলার ঝিকরগাছার গোয়ালহাটিতে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দলকে অ্যামবুশ করেন। পাকিস্তানি সেনাদলটি ছুটিপুর থেকে বিশাহারীর দিকে যাচ্ছিল। তারা অ্যামবুশের আওতায় এলে মুক্তিযোদ্ধাদের অতর্কিত আক্রমণে বেশ কয়েকজন হতাহত হয়।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর দুই ও আট; ইত্তেফাক, ঢাকা, ২০ অক্টোবর ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত ২০ ও ২১ অক্টোবর ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান