বিজ্ঞাপন
default-image

যুক্তরাষ্ট্র সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ৪ নভেম্বর হোয়াইট হাউসে দেশটির প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সঙ্গে আলোচনা করেন। তাঁদের দুজনের আলোচনায় নানা প্রসঙ্গ এলেও বেশি প্রাধান্য পায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের বিভিন্ন দিক এই আলোচনায় উঠে আসে।

প্রায় দুই ঘণ্টার আলোচনার বেশির ভাগ সময় তাঁদের সঙ্গে অন্য কোনো প্রতিনিধি ছিলেন না। পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সরবরাহ, অর্থ সাহায্য এবং বাংলাদেশ পরিস্থিতির ওপর তার প্রভাব আলোচনায় গুরুত্ব পায়।

ওয়াকিবহাল মহল জানায়, প্রেসিডেন্ট নিক্সন ইন্দিরা গান্ধীকে বলেছেন, শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাণরক্ষা এবং একটি রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছাতে বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা শুরুর জন্য তাঁরা ইয়াহিয়াকে যথাসম্ভব চাপ দিচ্ছেন।

অন্যদিকে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, পাকিস্তানকে দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রেই বাঙালি-হনন চলছে। শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি এবং তাঁর সঙ্গে কথা বলার জন্য ইয়াহিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ দেওয়া উচিত। বাংলাদেশের ঘটনা ভারত-পাকিস্তান সমস্যা নয়। এটা বাংলাদেশবাসী ও ইসলামাবাদের সামরিক শাসকদের বিরোধ। সমাধান তাদেরই খুঁজতে হবে। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, ভারত যুদ্ধ চায় না। তবে পাকিস্তানের যুদ্ধংদেহী মনোভাব উপেক্ষা করে ভারতের পক্ষে সেনা প্রত্যাহার করা কঠিন।

ইন্দিরা গান্ধী এ দিন যুক্তরাষ্ট্র সফররত অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম ম্যাকমোহনের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশদভাবে জানান।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর জানায়, সিনেট বৈদেশিক সাহায্য বিল বন্ধ করে দেওয়ায় আশঙ্কা করা হচ্ছে যে বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ত্রাণ পুরোপুরি বন্ধ হতে চলেছে।

আন্তর্জাতিক একটি বার্তা সংস্থা ওয়াশিংটন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দাদের অভিমত নিয়ে খবর পরিবেশন করে। খবরে বলা হয়, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বেড়ে যাওয়ায় পাকিস্তান অস্ত্র সংগ্রহের জন্য চীন ও রোমানিয়ায় জাহাজ পাঠিয়েছে।

পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি

৪ নভেম্বর পাকিস্তানের ৪২ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি অবিলম্বে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেওয়ার জন্য ইয়াহিয়া খানের কাছে আবেদন জানান। ডিসেম্বর ১৯৭১-এর সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে সরকার গঠনের জন্যও তাঁরা অনুরোধ করেন। লাহোরে এই বিবৃতি প্রচার করা হয়। ইয়াহিয়া এ দিনই তিন দিনের সফরে লাহোরে আসেন।

বিবৃতিদাতারা বলেন, পাকিস্তানের উদ্ভূত তীব্র রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট দূর করার সেরা পথ গণতান্ত্রিক সরকার গঠন। শেখ মুজিবকে মুক্তি দিলে তা ন্যায়বিচারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান, কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, পাকিস্তান টাইমস-এর সাবেক সম্পাদক মাজহার আলী খান প্রমুখ এতে স্বাক্ষর করেন।

যুক্তরাজ্যে সংগীতায়োজন

কলকাতায় এ দিন জানানো হয়, বাংলাদেশি শরণার্থীদের সাহায্যার্থে যুক্তরাজ্যের নানা অঞ্চলে ‘কনসার্ট ইন সিমপ্যাথি’ শিরোনামে বাংলা গানের অনুষ্ঠান হবে। লন্ডনের স্যাডলার্স ওয়েলস থিয়েটারে ১৪ নভেম্বর এ অনুষ্ঠান শুরু হবে। ইউরোপের কয়েকটি শহরেও সংগীতের আয়োজন করা হচ্ছে। এ সফর হবে চার সপ্তাহব্যাপী। অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন নির্মলেন্দু চৌধুরী, রুমা গুহঠাকুরতা, মোশাদ আলী, শাহ আলী সরকারসহ দুই বাংলার শিল্পীরা। শিল্পীরা ৬ নভেম্বর লন্ডন যাত্রা করবেন।

বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিবাহিনী

বাংলাদেশ সরকার এ দিন দিল্লির পাকিস্তান হাইকমিশনে আটক বাঙালি কর্মী হোসেন আলী ও তাঁর পরিবারের মুক্তির জন্য জাতিসংঘের মহাসচিব, আন্তর্জাতিক রেডক্রসের চেয়ারম্যান এবং দিল্লির কূটনৈতিক কোরের ডিনের কাছে হস্তক্ষেপের অনুরোধ জানায়।

২ নম্বর সেক্টরে ঢাকা শহরের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি দল বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালায়। একটি দল সন্ধ্যায় ধানমন্ডিতে মুসলিম লীগ নেতা খান এ সবুরের বাসায় হামলা করে। দ্বিতীয় দল শান্তিবাগে পাকিস্তানের আরেক সক্রিয় সহযোগীর বাড়িতে অভিযান চালায়। এ অভিযানে চারজন নিহত হয়। তৃতীয় দল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের পাঁচতলায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়।

১১ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি দল ভোরে একসঙ্গে নেত্রকোনার দুর্গাপুরের আড়পাড়া সীমান্তঘাঁটিতে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানে আক্রমণ চালায়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি দল সহায়তা করে। এ যুদ্ধে কয়েকজন সেনা ও মিলিশিয়া হতাহত হয়। কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাও হতাহত হন।

এই সেক্টরে আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা রাতে নেত্রকোনার বারহাট্টায় হামলা করেন। স্থানীয় মানুষও তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন। পুলিশ ও রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করলে থানা মুক্ত হয়। পরে পাকিস্তানি বাহিনীর নতুন একটি দল এসে থানা পুনর্দখল করে।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর এগারো; ইত্তেফাক, ঢাকা, ৫ নভেম্বর ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত, ৫ ও ৬ নভেম্বর ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান