১৯ নভেম্বর ভারতের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ৵সভায় বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি এবং মুক্তিবাহিনীকে যথাসম্ভব সাহায্যের জন্য নতুন করে আবার দাবি জানানো হয়। রাজ্যসভায় সিপিআই সদস্য জি এম সরদেশাই বাংলাদেশ সমস্যা পর্যালোচনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের একটি কমিশন গঠন করার প্রস্তাবসংক্রান্ত একটি খবরের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে সরকারের উদ্দেশে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের কমিশন পাঠানোর প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন হলো শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য ইয়াহিয়াকে চাপ দেওয়া।
রাজ্যসভায় এসএসপির সদস্য রাজনারায়ণ অভিযোগ করেন, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর চাপে বাংলাদেশ উপদেষ্টা কমিটিতে কমিউনিস্টদের গ্রহণ করা হয়েছে। এর উত্তরে সরদেশাই বলেন, এই ধরনের বিবৃতি ওয়াশিংটন ও ইসলামাবাদ পছন্দ করবে। রাজ্যসভায় এ নিয়ে বিতর্ক হয়।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং রাজ্যসভায় বলেন, বাংলাদেশ সমস্যা পর্যালোচনা করার জন্য কমিশন গঠন করার অধিকার কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের থাকতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্র সরকার ভারতের কাছে কখনোই এখানে এমন কোনো কমিশন পাঠানোর কথা চিন্তা করছে বলে জানায়নি।
পরে সরদার শরণ সিং লোকসভায় এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, বাংলাদেশ সম্পকে৴ ভারতের নীতি ব্যাখ্যা করার জন্য চীনে ভারতীয় প্রতিনিধিদল পাঠানোর অভিপ্রায় সরকারের নেই। বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের মনোভাব চীনের উচ্চপর্যায়ে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
শ্রীলঙ্কা সরকারের পাকিস্তানকে তাদের দেশ হয়ে পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র ও সেনা পরিবহনের সুযোগ-সুবিধা দিতে অস্বীকার করার সাম্প্রতিক একটি খবরকে সরদার শরণ সিং রাজ্যসভায় স্বাগত জানান।
বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিবাহিনী
বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দেশবাসীকে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশে সবাই একসঙ্গে ঈদ উদ্যাপন করার দিন খুবই কাছে।
২ নম্বর সেক্টরে ঢাকা নগরীতে অভিযান পরিচালনার বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত গেরিলাযোদ্ধাদের একটি দল সাদেক হোসেন খোকার (স্বাধীনতার পর বিএনপি নেতা ও ঢাকার মেয়র) নেতৃত্বে শান্তিনগরে পাকিস্তান সরকারের চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা বিভাগের অফিসে বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। গেরিলাদের এই দলে আরও ছিলেন রফিকুল হক নান্টু, ইকবাল আহমেদ সুফি ও আমসল লস্কর।
ঢাকার গেরিলাদের আরেকটি দল পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের অনুগতদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টির লক্ষ্যে মতিঝিলে বোমা বিস্ফোরণ ঘটালে বেশ কয়েকটি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অন্য আরেকটি দল ডেমরায় পাকিস্তানি অনুগত ব্যক্তির মালিকানাধীন একটি প্যাকেজিং কারখানায় বোমা হামলা চালায়।
এই সেক্টরের অন্য একদল মুক্তিযোদ্ধা কুমিল্লার রাজনগরে সেনা ও রাজাকারদের সমন্বয়ে গড়া পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর হামলা করলে দুজন হতাহত হয় এবং পাঁচ রাজাকার বন্দী হয়।
৬ নম্বর সেক্টরের লেফটেন্যান্ট আশফাকুস সামাদ ও লেফটেন্যান্ট আবদুল্লাহ ২৫ মাইল রেঞ্জের ওয়্যারলেস হাতে দুই গ্রুপ কমান্ডো নিয়ে সন্ধ্যায় কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীর পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত ঘাঁটি রায়গঞ্জ দখলের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। তাঁর দলের সামাদের গ্রুপে ছিলেন কমান্ডো মাহবুব, কাসেমসহ কয়েকজন এবং আবদুল্লাহর গ্রুপে ছিলেন ১৫ জন। দুই গ্রুপ রায়গঞ্জে প্রতিরক্ষা অবস্থানে থাকা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টকে লক্ষ্য করে দুই দিক থেকে যাত্রা শুরু করে। রায়গঞ্জ সেতুর কাছে পৌঁছে সামাদের গ্রুপ বুঝতে পারে, তাঁরা ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ফাঁদে পড়েছেন। সামাদ সবাইকে শুয়ে পড়তে বলেন। পাকিস্তানিরা ইতিমধ্যে গুলি শুরু করে। চলতে থাকে মরণপণ যুদ্ধ।
এই সেক্টরের পাটগ্রাম সাবসেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা বড়খাতায় পাকিস্তানিদের সুদৃঢ় ঘাঁটি আক্রমণ করেন। আক্রমণের মুখে পাকিস্তানিরা হাতীবান্ধায় পিছু হটে। বড়খাতা পাকিস্তানি মুক্ত হয়।
ইয়াহিয়া-নুরুল আমিন সলাপরামর্শ
পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রধান নুরুল আমিন রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করে সরকার গঠনের ব্যাপারে সলাপরামর্শ করেন।
নুরুল আমিনসহ দক্ষিণপন্থী সাত দলের যুক্তফ্রন্টের নেতারা এক যুক্ত বিবৃতিতে আগের দিন বলেন, জাতীয় পরিষদে সংখ্যাধিক্য দলকে যদি সরকার গঠন করতে বলা হয়, তাহলে তাকে চ্যালেঞ্জ করার কোনো অধিকার কারও নেই। এই সরকারকে কাজ করতে দেওয়া হবে না, এমন হুমকি দেওয়ার অধিকারও কারও নেই। বিবৃতিতে স্পষ্ট যে ভুট্টোর ঘোষণার জবাবেই এ কথা বলা হয়েছে।
সূত্র: ইত্তেফাক, ঢাকা, ২০ নভেম্বর ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ভারত, ২০ ও ২১ নভেম্বর ১৯৭১
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান