পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন বাঁচানোর জন্য ১২ আগস্ট বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলোর কাছে আবেদন জানান বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর বিচার করার আইনগত, সাংবিধানিক বা অন্য কোনো অধিকার প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের নেই। শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, পুরো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শান্তির জন্যই বঙ্গবন্ধুকে বাঁচানো দরকার।
জাতিসংঘের একজন মুখপাত্র এই দিন নিউইয়র্কে বলেন, শেখ মুজিবের বিচার সম্পর্কে মহাসচিব উ থান্ট নেপথ্যে কূটনৈতিক আলোচনা চালাচ্ছেন। তিনি এ নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনায় অনিচ্ছুক। মুখপাত্র বলেন, ভারতীয় রাষ্ট্রদূত সমর সেন ১১ আগস্ট রাতে উ থান্টের হাতে শেখ মুজিবের বিচার প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর একটি পত্র দিয়েছেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দেশটির সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় বলেন, শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সামরিক সরকার কোনো ব্যবস্থা নিলে তার প্রতিক্রিয়া শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা পৃথিবীতেই হবে। তাঁর নিরাপত্তার জন্য ভারত বিশ্বের অনেকগুলো দেশকে অনুরোধ করেছে। কয়েকটি দেশ কাজও করছে।
ভারতে সফররত যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের শরণার্থীবিষয়ক সাব-কমিটির চেয়ারম্যান সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি এদিন আগরতলায় বলেন, পাকিস্তানের একটি বিশেষ আদালতে গোপন বিচারের সম্মুখীন শেখ মুজিবের জীবন রক্ষার জন্য সব চেষ্টা করা হবে।
ভারতে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত কেনেথ কিটিং দিল্লিতে এক বিবৃতিতে আশা প্রকাশ করেন, শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র সরকার যে চেষ্টা করছে, তার সদর্থক প্রভাব ঘটবে। তিনি বলেন, শেখ মুজিবের ব্যাপারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্স ব্যক্তিগতভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করে ওয়াশিংটনে নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত আগা হিলালিকে ডেকে নিয়ে বলেছেন, গোপনে বিচারে শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রাণদণ্ড দেওয়া হলে পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন হারানোর ঝুঁকি নিতে হবে।
ভারতের কাশ্মীরের নেতা শেখ আবদুল্লাহ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে পাঠানো এক টেলিগ্রামে বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার করা হলে সমস্যার সমাধান তো হবেই না, বরং পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলবে। তিনি ইয়াহিয়াকে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নেওয়ার এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি রাজনৈতিক সমাধানে আসার আবেদন জানান।
পাকিস্তানি জাহাজের বিরুদ্ধে নৌ-অবরোধ
আল আহমদি নামের পাকিস্তানি একটি মালবাহী জাহাজের ১২ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায় ভেড়ার কথা ছিল। কিন্তু একটি অহিংস সত্যাগ্রহের জন্য জাহাজটি গতি পরিবর্তন করে বাল্টিমোরের দিকে পাড়ি জমাতে বাধ্য হয়। সত্যাগ্রহের আয়োজন করেন ফিলাডেলফিয়ার বাংলাদেশ সমর্থক এক দল লোক। তাঁরা অনেকগুলো ক্ষুদ্র নৌকা নিয়ে এক অহিংস বহর তৈরি করে বন্দর আর মোহনা অবরোধ করে রাখেন।
জাহাজটির এজেন্ট ফারনেস অ্যান্ড উইলি কোম্পানি ১১ আগস্ট রাতে বন্দর কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেয়, জাহাজটি বন্দরে ভিড়বে না। ফিলাডেলফিয়ার পূর্ববঙ্গ মৈত্রী সমিতির সদস্যরা জাহাজ থেকে মাল খালাসে বাধা সৃষ্টি করতে পারেন, এমন আশঙ্কা থেকে জাহাজটিকে অন্যত্র চলে যেতে বলা হয়। জাহাজযোগে পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহের ঘোর বিরোধী স্থানীয় শান্তি গোষ্ঠীর প্রায় ৫০ জন সদস্য এই বিচিত্র সত্যাগ্রহে যোগ দেন। দলের নেতা ৩৮ বছর বয়স্ক শিক্ষক বিল ময়ার এই নৌবহরকে অহিংস বলে অভিহিত করেন। গোষ্ঠীর সদস্যরা বন্দরে ইশতেহার বিলি করে সবাইকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি জানান। বন্দরের কর্মীরা বলেন, তাঁরা পাকিস্তানি জাহাজ থেকে কিছুতেই মাল খালাস করবেন না।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর এদিন জানায়, গত মার্চে অস্ত্র সরবরাহে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলেও জাহাজযোগে পাকিস্তানে আরও প্রায় তিন কোটি টাকার সমরাস্ত্র পাঠানো হতে পারে। নতুন করে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সরবরাহের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির আগে বেসরকারি রপ্তানিকারকদের যে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল, তার অধীনে এ অস্ত্র পাঠানো হবে।
ভারত ও পাকিস্তানে
ভারতীয় জনসংঘ দলের সভাপতি অটল বিহারি বাজপেয়ি এই দিন বাংলাদেশকে স্বীকৃতির দাবিতে দিল্লিতে আয়োজিত প্রায় পাঁচ লাখ কর্মীর সমাবেশে বলেন, ভারত-সোভিয়েত যুক্ত বিবৃতিতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্রের আভাস আছে। যুক্ত বিবৃতিতে বাংলাদেশ বা পূর্ববঙ্গের নাম নেই। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার চাপে ভারত সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে ভয় পাচ্ছে।
ভারতীয় সংসদের ২০ জন মুসলমান সদস্য এক যুক্ত বিবৃতিতে পাকিস্তানের সামরিক চক্রের ইসলামিক আদর্শবিরোধী গুরুতর কার্যকলাপের বিরুদ্ধে বিশ্বের মুসলমানদের প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠার জন্য আবেদন জানান। তাঁরা বলেন, পাকিস্তানের সামরিক চক্রের নিষ্ঠুর ও বর্বরোচিত অত্যাচারের বিরুদ্ধে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর নীরব থাকার অর্থ, পাকিস্তানের কার্যকলাপের প্রতি তাদের সমর্থন জানানো।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র ইসলামাবাদে রুশ-ভারত যুক্ত ইশতেহারের বিরুদ্ধে তীব্র আপত্তি জানিয়ে বলেন, ওই ইশতেহারে নিষ্প্রয়োজনে পাকিস্তানকে অযাচিত কিছু বাড়তি উপদেশ দেওয়া হয়েছে।
সূত্র: দৈনিক পাকিস্তান, ১৩ আগস্ট ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা ও যুগান্তর, ভারত, ১৩ ও ১৪ আগস্ট ১৯৭১।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান