বিজ্ঞাপন
default-image

পাকিস্তান সরকার এদিন পূর্ব পাকিস্তান সংকট নিয়ে মিথ্যা ও অতিরঞ্জিত তথ্য সাজিয়ে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করে। এতে সবকিছুর জন্য বাঙালিদের দায়ী করা হয়। শ্বেতপত্রে বলা হয়, সংবিধান প্রণয়ন সম্পর্কে আলোচনাকালে শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের জন্য প্রকারান্তরে স্বাধীনতা আদায়ের চেষ্টা করে। তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেলে তারা সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের পরিকল্পনা করে।

রাওয়ালপিন্ডি থেকে প্রকাশিত এই শ্বেতপত্রে বলা হয়: এক. ১ থেকে ২৫ মার্চের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ লাখখানেক নরনারী–শিশুকে হত্যা করে। দুই. ২৬ মার্চ সকালে আওয়ামী লীগ সশস্ত্র অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা তৈরি করে। তিন. আওয়ামী লীগ ভারতের সঙ্গে গোপনে পরামর্শ করে এবং ভারত বিদ্রোহীদের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়। চার. পরিকল্পনা হয় যে আওয়ামী লীগের নির্দেশে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ঢাকা ও চট্টগ্রাম দখল করে পাকিস্তানি সেনাদের পূর্ব পাকিস্তানে অবতরণ প্রতিহত করবে। একই সঙ্গে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ও পুলিশ বাহিনী বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্ট দখল করে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীকে খতম করবে। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী সেনারা গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলো দখল করার পর ভারতীয় সৈন্যরা তাদের সাহায্যার্থে সীমান্ত পেরিয়ে ঢুকবে। পাঁচ. ২৫ মার্চ শেখ মুজিব কর্নেল ওসমানীকে বিপ্লবী সেনাবাহিনীর কমান্ডার পদে নিয়োগ দেন।

পাকিস্তান সরকার এই শ্বেতপত্র প্রকাশ করে বাংলাদেশে তাদের সামরিক বাহিনীর সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে এবং আওয়ামী লীগ ও ভারতের ওপর সব দোষ চাপানোর চেষ্টা করে। তবে আন্তর্জাতিক তথ্যমাধ্যমে শ্বেতপত্রের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়।

নিক্সনের সমালোচনা

যুক্তরাষ্ট্রের দুজন সিনেটর ৫ আগস্ট বাংলাদেশ প্রশ্নে দেশটির প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের মন্তব্যের সমালোচনা করেন। সিনেটের শরণার্থী–সংক্রান্ত বিচারবিষয়ক উপকমিটির চেয়ারম্যান সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি ওয়াশিংটনে সংবাদ সম্মেলনে নিক্সন সরকারকে অভিযুক্ত করে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীর সংকটে নিক্সন প্রশাসন রাজনীতিমুখী এবং কাণ্ডজ্ঞানহীন নীতি অনুসরণ করছে। পাকিস্তান সরকারকে সামরিক সাহায্য
দেওয়া অব্যাহত রেখে শরণার্থীর সমস্যা সৃষ্টি করে তাদের সাহায্যার্থে লাখ লাখ ডলার ব্যয় করা অর্থহীন। পাকিস্তান সরকারকে অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য বন্ধ রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদে গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের ৪ আগস্টের সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে কেনেডি এই মন্তব্য করেন।

সিনেটের পররাষ্ট্র সম্পর্কবিষয়ক কমিটির সদস্য ও ডেমোক্র্যাট দলীয় সিনেটর ফ্রাঙ্ক চার্চ সিনেটে অভিযোগ করেন, নিক্সন প্রশাসন পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক সরকারের হত্যাযজ্ঞে মদদ জোগাচ্ছে। তিনি বলেন, পাকিস্তানে ১ কোটি ৮০ লাখ ডলার মূল্যের অস্ত্র পাঠানোর তোড়জোড়ের কথা প্রেসিডেন্ট নিক্সন ভুলে গেছেন। নিক্সনের বক্তব্যে ইয়াহিয়া হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার উৎসাহ পেয়েছেন

যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে হোয়াইট হাউসের উল্টো দিকে মার্কিন নাগরিকেরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। তাঁরা প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে ইয়াহিয়ার প্রতি তাঁর সমর্থন তুলে নেওয়ার দাবি জানান। তাঁদের হাতে থাকা পোস্টারে লেখা ছিল, নিক্সন পাকিস্তানি গণহত্যা সমর্থন করছেন।

জাতিসংঘের মহাসচিবের একজন মুখপাত্র নিউইয়র্কে সাংবাদিকদের জানান, ভারতের প্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও মহাসচিব উ থান্ট সীমান্তের দুই দিকে জাতিসংঘ প্রতিনিধি মোতায়েনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবেন।

বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য

যুক্তরাজ্যের হাউস অব কমন্সে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য চাপ সৃষ্টি করতে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জন স্টোনহাউস একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। প্রস্তাবে তিনি বলেন, শেখ মুজিবকে মুক্তি দিলে পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক মীমাংসার পথ সুগম হবে। এ জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে বৈঠকের অনুরোধ জানান।

প্রধানমন্ত্রী হিথ প্রস্তাবটি অগ্রাহ্য করে বলেন, শেখ মুজিবকে আটক রাখার সিদ্ধান্ত পাকিস্তানের। তবে তিনি বলেন, যুক্তরাজ্য এ ব্যাপারে নিবিড় যোগাযোগ রাখছে। হাউস অব কমন্সের দর্শক গ্যালারিতে তিনজন তরুণ বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাজ্যের মনোভাবের বিরুদ্ধে স্লোগান দেন। গ্যালারি থেকে তাঁদের বের করে দেওয়া হয়।

লন্ডনের পাকিস্তান হাইকমিশনের অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস ডিরেক্টর এমডি আকবর লুৎফুল মতিন এদিন পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন।

যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী লন্ডন থেকে অধ্যাপক ড্রেপারকেসহ জেনেভায় পৌঁছান। ড্রেপার আনুষ্ঠানিকভাবে রেডক্রসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার ব্যাপারে আলোচনা এবং বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে সঠিক সংবাদ সংগ্রহের জন্য অনুরোধ জানান। রেডক্রস কর্তৃপক্ষ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা এবং ফলাফল যথাসময়ে জানানোর আশ্বাস দেন। বিচারপতি চৌধুরী এরপর ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্টসের অফিসে গিয়ে মহাসচিব নীল ম্যাকডারমেটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ম্যাকডারমেট তাঁকে সব ধরনের সাহায্যের আশ্বাস দেন। তিনি ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি সার্ভিসেসের অফিসে গিয়ে মহাসচিব চিদামবরা নাথানের সঙ্গে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন।

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি: যুক্তরাজ্য, আবদুল মতিন, সাহিত্য প্রকাশ; দ্য টাইমস ও দ্য গার্ডিয়ান, ব্রিটেন, ৬ আগস্ট, ১৯৭১; ইত্তেফাক, ৬ ও ৭ আগস্ট ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা, ভারত, ৬ ও ৭ আগস্ট ১৯৭১

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান