বিজ্ঞাপন
default-image

ব্রিটেনের সানডে টাইমস ২০ জুন তাদের প্রথম পৃষ্ঠায় বাংলাদেশ নিয়ে পাঁচ কলামব্যাপী সংবাদ নিবন্ধ প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ যাঁকে যাঁকে বিপজ্জনক মনে করছে, তাঁদেরই হত্যা করছে। সাদা, ধূসর ও কালো—এ রকম তিনটি তালিকা সামরিক কর্তৃপক্ষ তৈরি করেছে। সাদা তালিকার লোকেরা বেকসুর। ধূসর তালিকার লোকেদের জেলে পোরার পরিকল্পনা হচ্ছে। আর কালো তালিকার মানুষদের হত্যা করা হবে। পত্রিকাটি লেখে, এই নীতির প্রয়োগ ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। নাৎসি গেস্টাপোর মতো পাকিস্তানি গোয়েন্দারা বাংলাদেশের বহু বিশিষ্ট ব্যক্তির বাড়িতে হানা দিয়ে ধরে নিয়ে গেছে। তাঁদের আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। বার্তা সংস্থা রয়টার্সও সানডে টাইমস–এর এই প্রতিবেদন উদ্ধৃত করে সংবাদ প্রচার করে।

বাংলাদেশের স্বীকৃতি বা পাকিস্তানে হামলা এখনই নয়

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কাশ্মীর সফর শেষে ২০ জুন দিল্লি ফেরার আগে বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশে হত্যাকাণ্ড থামালেই কেবল পাকিস্তানের সঙ্গে ভারত এ ব্যাপারে শীর্ষ পর্যায়ে আলোচনায় বসতে পারে। বাংলাদেশকে স্বীকৃতির প্রশ্নে তিনি বলেন, দেশের পক্ষে কী ভালো, সেটা বিবেচনা করে স্থির করবে সরকার। কিছু লোকের দাবিতে নীতি নির্ধারণ করা যায় না।

মার্ক্সবাদী নেতা জ্যোতি বসু ২০ জুন বলেন, বাংলাদেশের সমস্যা নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সশস্ত্র সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া তাঁর দল সমর্থন করে না। তাঁর দল মনে করে, আক্রমণ করলে পাকিস্তান ভারতে হামলা করার একটি অজুহাত পেয়ে যাবে।

নব কংগ্রেসের সভাপতি ভি সঞ্জিবায়া ইন্দোর প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ভারত যদি বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেয়, তাহলে যে ফাঁদ সে এড়াতে চায়, সেই ফাঁদেই সে পড়বে। শুধু ভারতের স্বীকৃতিতে কিছু হবে না। বৃহৎ শক্তিগুলো বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকার করলেই কেবল উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে।

দিল্লি সফররত বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী–শিক্ষাবিদ প্রতিনিধিদলের নেতা এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এ আর মল্লিক দিল্লিতে বলেন, পাকিস্তানের সামরিক সরকার শুধু বাংলাদেশের নয়, পাকিস্তানিদেরও শত্রু। তারা যেদিন এ কথা বুঝতে পারবে, সেদিন স্বাধীনতা, মানবাধিকার ও ন্যায়ের জন্য তারাও এদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামবে। তিনি বলেন, বৃহৎ শক্তিগুলো বাংলাদেশের জনগণের ওপর পাকিস্তানের বর্বর অত্যাচারে চোখ বুজে আছে। বিশ্বের জনগণ ও সরকারগুলো একদিন বুঝবে যে ন্যায় আমাদের পক্ষে।

ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম জলন্ধরে নৌবাহিনীর কর্মকর্তা ও সৈনিকদের উদ্দেশে বলেন, পাকিস্তান ভারতের পূর্বাঞ্চলে বারবার সীমান্ত লঙ্ঘন করছে। তাদের বেপরোয়া কর্মকাণ্ড মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

পাকিস্তানের সঙ্গে আপস নেই

যুক্তরাজ্যে সদ্য নিয়োগ পাওয়া বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এবং বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের বিশেষ দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ওয়েলসের কার্ডিফে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সমর্থনে আয়োজিত সভায় বলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের আপসের সম্ভাবনা আছে বলে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। এ গুজব পুরোপুরি ভিত্তিহীন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই এবং জনগণের প্রতিনিধিরাই দেশ শাসন করবেন।

লন্ডনে ঘোষণা করা হয়, ব্রিটেন থেকে একটি সংসদীয় প্রতিনিধিদল পূর্ব পাকিস্তানে ১০ দিন ধরে সফর করবেন। এ দলে কনজারভেটিভ ও লেবার পার্টি থেকে দুজন করে মোট চারজন এমপি থাকবেন। ২১ জুন তাঁরা যাত্রা করবেন। বিশ্বজনমতের চাপে পাকিস্তান সরকার তাদের পূর্ব পাকিস্তানে যাওয়ার অনুমতি দিতে বাধ্য হয়।

ফিলিপাইনের ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি একাত্মতা জানায়। তারা পাকিস্তানি বিমান ও জাহাজ থেকে মালামাল না নামানোর জন্য ফিলিপাইনের শ্রমিক সংগঠনগুলোকে আহ্বান করে। বাংলাদেশে গণহত্যার প্রতিবাদে সংগঠনটি ম্যানিলায় পাকিস্তান দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শনেরও ঘোষণা দেয়।

প্যারিসে ১৪ রাষ্ট্রের ভারত সহায়ক সমিতির প্রতিনিধিরা দুই দিনব্যাপী বৈঠক শেষে বাংলাদেশ থেকে বিপুলসংখ্যক শরণার্থী আসায় উদ্বেগ প্রকাশ করে। তাঁরা বলেন, শরণার্থীদের দেশে ফিরে যাওয়ার মতো অবস্থা সৃষ্টি করাই সমস্যার একমাত্র সমাধান।

পাকিস্তানে বিরোধিতা

রাওয়ালপিন্ডিতে এক সরকারি ঘোষণায় বলা হয়, সীমান্ত পেরিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে ঢুকে বিনা প্ররোচনায় গুলিবর্ষণের জন্য ভারতের বিরুদ্ধে তাদের হাইকমিশনে প্রতিবাদ পাঠানো হয়েছে। প্রতিবাদে বলা হয়েছে, এই সামরিক হস্তক্ষেপে প্রাণ ও সম্পদহানির জন্য পাকিস্তান ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারে।

লাহোরে এক সংবাদ সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির গোলাম আযম বলেন, পূর্ব পাকিস্তানিরা রাজনৈতিকভাবে অনুভব করেন, প্রশাসনে তাঁদের সমানাধিকারকে অস্বীকার করা হয়েছে। পাকিস্তান আদর্শের বিরোধীরা এই মনোভাবকে কাজে লাগিয়েছে। তিনি বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের বিচ্ছিন্ন হওয়ার ইচ্ছা ছিল, যদিও তিনি কখনো তা প্রকাশ করেননি।

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি: যুক্তরাজ্য, আবদুল মতিন, সাহিত্য প্রকাশ; ইত্তেফাক আজাদ, ২১ ও ২২ জুন ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা যুগান্তর, ভারত, ২১ ও ২২ জুন, ১৯৭১।

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান