মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখা
গণহত্যার আগে পাকিস্তানি জেনারেলদের প্রতারণা
অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহানের আত্মজীবনী উতল রোমন্থন: পূর্ণতার সেই বছরগুলো। এতে উঠে এসেছে পূর্ব পাকিস্তান থেকে স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ হয়ে ওঠার ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বইটি থেকে নির্বাচিত কিছু অংশ ধারাবাহিকভাবে ছাপা হয়েছে। আজ শেষ কিস্তি।
বঙ্গবন্ধু ও তাঁর দল তত দিনে রাজনীতির আঙিনায় সব ধরনের জয় অর্জন করেছে এবং বাংলাদেশের মানুষকে এমন এক বিন্দুতে পৌঁছে দিয়েছে, যেখানে তারা শান্তিপূর্ণভাবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পুরো বাংলাদেশে তাদের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। তিনি বিশ্বাস করতেন, স্বায়ত্তশাসনের জন্য যে অভূতপূর্ব সমর্থন বাঙালি প্রকাশ্যে দেখিয়েছে, সেটাই যেমন ইয়াহিয়াকে শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজতে বাধ্য করবে, তেমনই বাংলাদেশের স্বার্থের প্রতি বিশ্বের সম্মান ও সহানুভূতি অর্জনে সহায়ক হবে। তাঁর কৌশলের এই পরবর্তী অংশ সত্যি কাজে দিয়েছিল এবং আমাদের সংগ্রামের জন্য সকল পর্যায়ের বিশ্ব জনমত গড়ে উঠেছিল। গোটা বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ ভাবত, বাঙালিদের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে হতোদ্যম করার জন্য তাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের ওপর চাপিয়ে দেওয়া গণহত্যার বলি বাঙালিরা।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এই আন্তর্জাতিক সমবেদনা বহুমূল্যে বাঙালি জীবনের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল। আধুনিক ইতিহাসের এক সর্বাঙ্গীণ গণতান্ত্রিক সংহতির মাধ্যমে ইয়াহিয়াকে চাপ দেওয়ার যে পথ বঙ্গবন্ধু নিয়েছিলেন, তা নিষ্ফল প্রমাণিত হয়েছিল। বাঙালির বিপুল রক্তস্রোত বইয়ে দিতে কোনো অনুশোচনা ইয়াহিয়ার হয়নি, কারণ তিনি ও তাঁর সেনাবাহিনী আমাদের বিদেশি শত্রু ভেবেছে, সহনাগরিক ভাবেনি। ইয়াহিয়াকে আরও বোঝানো হয়েছিল, বাঙালিরা বেশি প্রতিরোধ গড়তে পারবে না বা গড়বে না, যার ফলে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর আন্দোলনকে খুব সহজেই চূর্ণ করা যাবে এবং আপসরফায় আসতে বাধ্য করা যাবে। যখন পাকিস্তানি সেনাদের প্রাথমিক ত্রাস বাঙালিদের ভয় দেখিয়ে আপস করাতে ব্যর্থ হয় এবং তার পরিবর্তে গণপ্রতিরোধ গড়ে ওঠে, তখনই পূর্ণাঙ্গ মাত্রার গণহত্যা শুরু হলো। আজ অনেকে প্রশ্ন তুলতে পারেন, আমাদের জাতিসত্তা সে ক্ষেত্রে কম রক্তপাতের বিনিময়ে অর্জিত হতো কি না। এমন যুগান্তকারী ঘটনাপ্রবাহ থেকে দূরে এবং নিরাপদ দূরত্বে থেকে যেকোনো ঐতিহাসিক অতীতকে স্বাধীনভাবে বিচার করতে পারেন। কিন্তু ভাগ্যবিধাতার লেখার আঙুল লিখে চলে গেছে এবং পৃথিবীর সব সম্পদ তার একটি ছত্রও আর ফিরিয়ে আনতে পারে না।
আগেই উল্লেখ করেছি, আলোচনা চলার সময় আমি আহমেদুল কবিরের বাড়িতে এনডব্লিউএফপির আবদুল ওয়ালি খান এবং বেলুচিস্তানের গাউস বক্স বিজেনজোর মতো পশ্চিম পাকিস্তানের কিছু ন্যাপ নেতার সঙ্গে দেখা করছিলাম। ওয়ালি খান এবং বিজেনজো দুজনেই তাঁদের আশঙ্কা আমাকে ব্যক্ত করেছিলেন যে ইয়াহিয়া, মুজিব ও ভুট্টোর মধ্যকার আলোচনা সম্ভবত পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষুদ্রতর রাজ্যগুলোর স্বার্থ উপেক্ষা করবে। পাঠান ও বালুচদের আশঙ্কা ছিল, আলোচনায় অংশ নিতে করাচি থেকে ভুট্টো চলে এসেছেন যাতে পাঞ্জাব ও সিন্ধুতে তাঁর নির্বাচনী সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে একচ্ছত্র ক্ষমতার দাবিদার হতে পারেন। তাঁর বিখ্যাত প্রকাশ্য উক্তি ‘ইধার হাম, উধার তুম’ (এদিকে আমরা শাসন করব, ওদিকে তোমরা শাসন করো), যার মাধ্যমে তিনি মুজিবের সঙ্গে রফার প্রস্তাব রেখেছিলেন, সেটাই বালুচ ও পাঠানদের আশঙ্কাকে জোরদার করে।
গণহত্যার আগে
পাকিস্তানি জেনারেলদের প্রতারণা আমি পরে উপলব্ধি করতে পারি, তাদের আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল আসলে বাংলাদেশে তাদের সামরিক বাহিনীর শক্তি বাড়ানোর জন্য সময় নেওয়া। ২৪ মার্চ ন্যাপ নেতারা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য ছোট দলের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা ঢাকা ছাড়েন। তাঁরা রওনা হওয়ার ঠিক আগে যখন আমি তাঁদের সঙ্গে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে দেখা করি, তখন তাঁরা আমায় জানিয়েছিলেন যে ইয়াহিয়া তাঁদের এই নির্দেশ দিয়েছেন এবং সামরিক আগ্রাসন আসন্ন।
২৫ মার্চের আগে মাজহার আলী খান লাহোর থেকে ঢাকায় আসেন। সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ আসন্ন এবং এর ফলে যে রক্তস্নান হবে, এই চিন্তায় তিনি এবং তাহিরা অত্যন্ত বিষণ্ন ছিলেন। মাজহারের মনে হয়েছিল যে এই ট্র্যাজেডি এড়াতে তখন ঢাকায় উপস্থিত পিপিপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের সংযোগ তৈরির একটি শেষ চেষ্টা তিনি করতে চান, পিপিপিতে তাঁর যোগসূত্রকে কাজে লাগিয়ে। মাজহার ঢাকায় এসে আমাদের বাড়িতেই উঠলেন এবং আমি তাঁকে আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য নিয়ে যাই।
দিন যত চলে যেতে থাকে, আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা এবং বাঙালিদের ওপর পূর্ণমাত্রায় সামরিক আঘাত নেমে আসার আশঙ্কায় ততই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন মাজহার। এই শেষ দিনগুলোতে তাঁকে বঙ্গবন্ধুর কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাকে তিনি জোর করতে থাকেন। সংযুক্ত পাকিস্তানের অন্তিম লগ্ন ২৫ মার্চ কালরাতের বিকেল পাঁচটার আগে এই সাক্ষাৎকার সম্ভব হয়নি, যখন ধানমন্ডি ৩২-এ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমরা দেখা করতে পারলাম। তখন বাড়িটা দখল নিয়েছেন সাংবাদিকেরা, যাঁরা সম্ভবত বুঝতে পেরেছিলেন যে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ আসন্ন। বহু আওয়ামী লীগ সমর্থক, কর্মী সেই সঙ্গে গুপ্তচর সংস্থার সদস্যরা জড়ো হয়ে ৩২ নম্বরে ভিড় উপচে পড়ছিল।
মাজহার যখন মিয়া ইফতেখারুদ্দিনের কাগজ পাকিস্তান টাইমস-এর সম্পাদক, তখন থেকে বঙ্গবন্ধু তাঁকে চিনতেন। তাঁরা একই প্রতিনিধিদলের অংশ হিসেবে বিপ্লবোত্তর চীন সফরে যান ১৯৫৪ সালে। তিনি মাজহারকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়ে ঘর খালি করে দিলেন, যার ফলে আমরা মাত্র দুজন তাঁর সঙ্গে থাকলাম। বঙ্গবন্ধু বললেন, ইয়াহিয়া স্থির করেছেন তিনি যুদ্ধের পথে যাবেন। তিনি বলেন এবং আমি স্মৃতি থেকে উদ্ধৃত করছি, ‘ইয়াহিয়া ভাবছে সে আমাকে খুন করে এই আন্দোলন গুঁড়িয়ে দেবে। কিন্তু সে ভুল বুঝেছে। আমার কবরের ওপর স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে উঠবে।’ বঙ্গবন্ধুকে দেখে মনে হচ্ছিল, তিনি কিছুটা দৈববাদী হয়ে নিজের মৃত্যু আসন্ন মেনে নিয়েছেন। তিনি বলেন, এক নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ এগিয়ে নিয়ে যাবে।
Also Read: বঙ্গবন্ধুর প্রতি সরকারি প্রশাসনের আনুগত্য
তাঁর সবচেয়ে মারাত্মক ভয় এবার নিশ্চিত হয়ে যাওয়ায় পিপিপি নেতাদের কয়েকজন আসন্ন রক্তস্নান সম্পর্কে কী ভাবছেন, তার খবর নিতে চাইলেন মাজহার আলী খান। ৩২ নম্বর রোড থেকে গাড়িতে করে সরাসরি মাজহারকে নিয়ে গেলাম ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে তাঁর পরিচিত পিপিপি নেতাদের সঙ্গে দেখা করাতে। সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, সামরিক কর্মী এবং সাধারণ বাসিন্দা—সব মিলিয়ে হোটেল ছিল ভরপুর। মনে আছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মুখ্য জনসংযোগ কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিকীর সঙ্গে এক ঝলক দেখা হলো, যার সঙ্গে আগে আমার দেখা হয়েছে ফোরামের পক্ষ থেকে। সিদ্দিকী আমায় এড়াতে চাইছিলেন। হোটেল লবিতে আমাদের সংক্ষিপ্ত সাক্ষাতে তাঁকে অন্যমনস্ক এবং কিছুটা মদ্যপ মনে হয়েছিল।
মাজহার এবং আমি হোটেলের সবচেয়ে ওপরের ফ্লোরে যাই বিশেষ বন্ধু কাসুরির সঙ্গে দেখা করতে। তাঁর স্বভাবসিদ্ধ বাজখাঁই গলায় কাসুরি প্রথমেই এই অভিযোগ দিয়ে আমাকে সম্ভাষণ জানান, ‘মনে হচ্ছে আওয়ামী লীগ সমাধান চায় না।’ আমি যেহেতু জানতাম একটা খসড়া চুক্তি ইতিমধ্যেই করা হয়েছে এবং সেটা প্রেসের কাছে ঘোষণার অপেক্ষায় রয়েছে, তাই তাঁকে প্রশ্ন করি, কোথা থেকে তিনি এ কথা শুনলেন। তিনি জানান, জেনারেল পীরজাদা তাঁকে এ কথা জানিয়েছেন। ঢাকার আলাপ-আলোচনার মূল চরিত্র সেই পীরজাদার কথা আবারও এসে পড়ায় বোঝা গেল, ওরা পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের বিভিন্ন গল্প শোনাচ্ছে আক্রমণের অজুহাত তৈরি করতে। কাসুরি বলতে থাকেন যে দেশের অখণ্ডতা বিপন্ন এবং দরকার পড়লে রক্ত ঝরাতে হবে—ঠিক যেভাবে লিঙ্কন গৃহযুদ্ধ লড়েছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অখণ্ডতা বজায় রাখতে। মার্কিন ইতিহাসের এই অপ্রয়োজনীয় এবং রাজনৈতিকভাবে অসত্য উল্লেখ কাসুরির উৎকট দেশপ্রেমী চেহারা স্পষ্ট করে দেয়। আমি কাসুরির কাছ থেকে বিদায় নিই এই বলে যে তিনি একজন বিশিষ্ট আইনজীবী বার্ট্রান্ড রাসেলের ওয়ার ক্রাইমস ট্রাইব্যুনালে ভিয়েতনামে মার্কিন গণহত্যা প্রকাশ করতে যিনি কাজ করেছেন। যেহেতু পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালি গণহত্যা শুরু করতে চলেছে, আমি আশা করব তিনি ভিয়েতনামের মানুষের জন্য যেভাবে প্রতিবাদী হয়েছিলেন, ঠিক একইভাবে এবারও প্রতিবাদ জানাবেন।
Also Read: মুক্তিযুদ্ধে সাংবাদিকেরা আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন
পাকিস্তানি জেনারেলদের এই শঠতা প্রতিপন্ন হলে আমি মাজহারকে নিয়ে সার্কিট হাউস রোডে কামাল হোসেনের বাড়িতে গেলাম এই খবর দিতে যে পীরজাদা নিশ্চিতভাবে পিপিপি কর্মীদের ঢাকা আলোচনা সম্পর্কে গাঁজাখুরি গল্প শুনিয়েছেন এবং যুদ্ধের ক্ষেত্র তৈরি হয়ে গেছে। কামালকে দেখে মনে হলো, খবরটায় তিনিও খুব অবাক হয়েছেন। আলাপ-আলোচনা থেকে সমাধানের বিষয়ে কিছুটা আশাবাদী হয়ে আমরা মাজহারের জন্য আমাদের গুলশানের বাড়িতে নৈশভোজের পরিকল্পনা করেছিলাম, যেখানে কামাল ও হামিদা হোসেন, লায়লা এবং আহমেদুল কবিরের আসার কথা ছিল। এই নৈশভোজ বাতিল করতে হলো এবং রাস্তা বন্ধ হওয়ার আগে গাড়ি চালিয়ে মাজহারকে বাড়িতে নিয়ে যেতে হলো। কিছু কিছু রাস্তায় আওয়ামী
লীগ স্বেচ্ছাসেবীদের অস্থায়ী ব্যারিকেড তোলা দেখে আসন্ন সেনা অভিযানের খবরের সারবত্তা বোঝা গেল।
অন্ধকার, জনহীন রাস্তায় দ্রুত গাড়ি চালিয়ে গুলশানের বাড়ির দিকে ফেরার সময় আমি মাজহারকে বলি, আমরা একটা বিরাট ট্র্যাজেডির সাক্ষী হতে চলেছি, যেখানে পাকিস্তানি সেনা বাঙালি জাতির ওপর গণহত্যার আগ্রাসী যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। কখন এবং কতটা মূল্যের বিনিময়ে বাংলাদেশ তার সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করবে, সে মুহূর্তে তা ধারণাতীত ছিল।
UNTRANQUIL RECOLLECTIONS: The Years of Fulfilment
বাংলা অনুবাদ: উতল রোমন্থন: পূর্ণতার সেই বছরগুলো। সেজ পাবলিকেশন, ভারত। ২০১৮
Also Read
-
আওয়ামী লীগের তৈরি আইনেই এগোচ্ছে ট্রাইব্যুনাল
-
জয়পুরহাটে খাদেম হতে চেয়ে ‘পীর’ হয়ে উঠেছিলেন আওয়ামী গডফাদার স্বপন
-
সিনওয়ার হত্যা গাজা যুদ্ধের শেষের শুরু: নেতানিয়াহু
-
এনসিসি ব্যাংকের পরিচালক পদ হারালেন ঋণখেলাপি বাবা-ছেলে
-
সাকিব আসলে কার কাছে হেরে গেলেন