বিজ্ঞাপন
default-image

পৃথিবীর অন্যান্য জাতীয় দিবসের মতোই ২৬ মার্চ বাংলাদেশের অনুভূতিতে স্মৃতির ঝড় বয়ে নিয়ে আসে। অশ্রু, হাহাকার, ব্যথার ঢেউ ও ঘৃণিত আর্তনাদের সঙ্গে তা জাগিয়ে তোলে প্রতিশোধস্পৃহা। পাকিস্তান আর পাঞ্জাবি—এই শব্দ দুটি এসব স্মৃতিকে বারবার অনুরণিত করে। এর সঙ্গে আমি নিজেও সম্পৃক্ত।

আমি পাঞ্জাবি—এ কথা অস্বীকার করার কোনো অবকাশ নেই। কেননা, আমার সারা জীবন নিজেকে পাঞ্জাবি হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়াসেই কেটেছে। আবার পাকিস্তানি পাঞ্জাবি হওয়ায় বহুবার আমাকে লজ্জিতও হতে হয়েছে। কারণ হিসেবে বলা যায়, পাকিস্তানি পাঞ্জাবিরা অন্য জাতির ওপর নির্মম অত্যাচার ও নিপীড়নের কারণে অভিসম্পাত পেয়েছে। এই দৃশ্যপটে তারা রক্তপিপাসু কসাই ও নারকীয় হন্তারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। পাঞ্জাবিদের এই পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে প্রথমে বাঙালি, সিন্ধি ও বেলুচরা প্রতিবাদ জানায়। পাঠানরাও এখন এই যাত্রায় সংযুক্ত হয়েছে।

পাঞ্জাবিদের নির্বুদ্ধিতা কখনো কখনো আমাকে শঙ্কিত ও রাগান্বিত করে। কেউ তাদের পাঞ্জাবি বলে কটাক্ষ করলে আমি মোটেও বিচলিত হই না। স্বজাতির প্রতি এই অভিমানের কারণ হলো, পাকিস্তানি পাঞ্জাবিরা নিজেদের জাতিগত পরিচয় দিতে সংকোচ বোধ করে। এটি তাদের জন্য লজ্জা ও গ্লানির প্রতীক।

আগে পাকিস্তানে বসবাসরত কোনো বাঙালিকে যদি প্রশ্ন করা হতো, তিনি কে? তাঁর জবাব কী হতো? মাথা ঝুঁকিয়ে আত্মপরিচয় দিতেন, তিনি বাঙালি এবং বাংলা তাঁর মাতৃভাষা। কখনোই বলতেন না তিনি পাকিস্তানি ও উর্দুভাষী। এখনো সিন্ধু প্রদেশজাত কোনো ব্যক্তিকে এ প্রশ্ন করা হলে তিনি সানন্দে বলবেন, আমি সিন্ধি! সিন্ধি আমার মাতৃভাষা। অর্থাৎ, পাকিস্তানের অন্য প্রদেশগুলোতে বসবাসরত যাঁকেই এ প্রশ্ন করা হোক না কেন, তিনি নিজের পরিচয়ে জাতীয়তা ও মাতৃভাষার কথাই বলবেন। কিন্তু এ প্রশ্ন কোনো নির্বোধ পাঞ্জাবিকে করা হলে নিজেকে তিনি পাকিস্তানি ও উর্দুভাষী বলেই পরিচয় দেবেন। কেউ যদি তাঁকে পাঞ্জাবি ও পাঞ্জাবিভাষী বলে স্মরণ করিয়ে দেন, তখন তিনি নিজেকে বাঁচানোর জন্য কাচুমাচু করতে থাকবেন।

প্রতিবছর লাহোর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে এ কথার সত্যতা পাওয়া যায়। এই দিনটি ১৯৫২ সালে ঘটে যাওয়া মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার্থে বাঙালি ছাত্রদের জীবন বিসর্জনের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বিশ্বব্যাপী উদ্‌যাপন করা হয়। এই দিনটিতে পাঞ্জাব ও লাহোরে বসবাসরত পাঞ্জাবি, যার সংখ্যা ১ কোটির বেশি এবং পাকিস্তানের বাদবাকি অংশে বসবাসরত কিছু পাঞ্জাবি—যারা নিজেদের পাঞ্জাবি বলে পরিচয় দেয়—তারা পাঞ্জাবিকে নিজেদের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জোর দাবি জানায়। অবশ্য এই দাবিদারদের সংখ্যা নিতান্তই নগণ্য। এ সময় তাদের আশপাশে হাজারো লোক উপস্থিত থাকে, কিন্তু বিক্ষোভকারীদের দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না। কোনো পথচারী যদি কাউকে এই গণজমায়েতের কারণ জানতে এ প্রশ্ন করে, ‘আপনি জানেন, কেন তারা বিক্ষোভ করছে?’ জবাবে সবাই অবজ্ঞা প্রকাশ করে। যদি পাঞ্জাবি হিসেবে কাউকে এই বিক্ষোভে শামিল হওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়, তখন তারা বিদ্রূপপূর্ণ হাসি হাসে। তারপর এমন প্রত্যুত্তর দেয়, যার মানে দাঁড়ায় যেন তাকে কেউ পাগলের দলে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আমন্ত্রণ জানাচ্ছে।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া নাৎসি নারকীয়তাকেও হার মানানো হত্যাযজ্ঞ এবং পাকিস্তানে সংঘটিত হওয়া সব নাশকতার দায় এই পাঞ্জাবিদেরই। প্রশ্ন হলো, ওরা কি সত্যিকার অর্থেই পাঞ্জাবি? অবয়ব দেখে পাঞ্জাবি বংশোদ্ভূত মনে হলেও বাস্তবিক অর্থে তারা পাঞ্জাবি নয়। আবার কেউ কেউ আসল পাঞ্জাবি হলেও এ পরিচয়ে পরিচিত হতে নারাজ। তারা নিজেদের পাকিস্তানি বলে পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। কিন্তু এ পরিচয় তো কৃত্রিম। কেননা, এই পরিচয়ের ভিত্তি কোনো ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ভাষার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। এই আত্মপরিচয়হীন ও মগজধোলাই করা সাদা চামড়ার পাকিস্তানি পাঞ্জাবিরা নিজেদের পরিচয় একধরনের ধর্মীয় রূপে দেয়। এই রূপটি এখন কট্টরপন্থার অবয়ব। এই উগ্রবাদ শুধু তাদেরই অন্ধ করে দেয়নি; বরং বিপুল ফ্যাসিবাদীর জন্ম দিয়েছে। পাঞ্জাবিদের পরে এই দলের দ্বিতীয় বড় অংশীদার হচ্ছে উর্দুভাষী অভিবাসীরা, যারা ভারত ভাগের সময় পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছে। কেননা, তারাও আত্মপরিচয়হীন; তাদেরও কোনো জাতি ও সংস্কৃতিগত পরিচয় নেই। এই দলে অন্যান্য সম্প্রদায়ের আরও অনেক লোক অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

১৯৭১ সালের আগে এই দলে পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসরতদের মধ্যেও একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাদের মধ্যে এখনো কিছু লোক ওই দলভুক্ত। তারা বর্তমান সময়টিকে পেছন দিকে পাল্টে দিয়ে বাংলাদেশকে আবারও পশ্চিম পাকিস্তানে পরিণত করতে চায়। এরা নিঃসন্দেহে জাতির শত্রু, রোবটরূপী পাকিস্তানি দোসর। পাকিস্তানি মতাদর্শের নামে তাদের যে নির্দেশই দেওয়া হোক না কেন, অবনত চিত্তে তারা তা-ই বাস্তব বলে মেনে নেয়। তাদের বলা যায় বাংলাদেশে বাঙালি গাদ্দার। পাকিস্তানেও তাদের দোসররা রয়েছে। তাদের সামনে টিক্কা খানকে এই সংগ্রামের নায়ক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, যাতে তারা পাকিস্তানি শাসকদের অনুশাসন ও মতাদর্শ মেনে নিতে বাধ্য হয়।

এই পরিচয়হীন পাঞ্জাবি রোবট দল মূলত ১৮৪৯ সালে ইংরেজ কর্তৃক পাঞ্জাব দখল করার পর তৈরি হয়েছে। আত্মপরিচয়হীন শ্রেণি তৈরির প্রয়াসে তাদের মাতৃভাষা পাঞ্জাবিকে ছিনিয়ে নিয়ে তাদের ওপর উর্দু চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই শ্রেণিকেই তারা তাদের দাসানুদাস কর্মচারী, অনুচর ও সৈনিক হিসেবে নিয়োগ করত। পাকিস্তান সৃষ্টির পর এই আত্মপরিচয়হীন পাঞ্জাবি রোবটদের পাকিস্তান পেয়েছে উত্তরাধিকার সূত্রে।

বাহুবল প্রয়োগ করে পাকিস্তানি জঙ্গিশাহী ষড়যন্ত্রের কালো নীলনকশা প্রণয়ন করে। পাকিস্তানের কোনো নাগরিক এই শ্রেণির মতাদর্শের অনুসারী না হলে তাকে ‘কাফের’ ও ‘গাদ্দার’ বলে চিহ্নিত করে জিহাদের নামে পৈশাচিকভাবে হত্যা করা হয়। এ থেকে কেউই পরিত্রাণ পায় না। ১৯৪৭ থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত পাকিস্তানে সংঘটিত সব নাশকতা ও পৈশাচিকতার দায় এই গোষ্ঠীটিরই।

যখনই ১৯৭১-পূর্ববর্তী পাকিস্তানের আলোচনা হয়, তখন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান বৈষম্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সেটি আসলে ছিল একটি নীতিগত ভুল সিদ্ধান্ত। পূর্ব পাকিস্তান মূলত বাঙালি পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানকে পাঞ্জাবি, সিন্ধি, বেলুচি, পশতুন পাকিস্তান হিসেবে নামকরণ করা হয়। ১৯৭১ সালে বাঙালিদের প্রতি যারা পূর্বাপর বিদ্বিষ্ট মনোভাব পোষণ করেছে, তারা পাকিস্তানি কিংবা পূর্ব পাকিস্তানি ছিল না; বরং ছিল এই উগ্রবাদী দলের অন্তর্ভুক্ত। তাদের মধ্যে উর্দুভাষী অভিবাসী, পাঠান ও বাঙালি রাজাকাররা উল্লেখযোগ্য নির্মম সত্য হচ্ছে, এই উগ্রপন্থী দলটিও এখন করুণ দশাগ্রস্ত।

ইসলামি মতাদর্শের নামে সৃষ্ট পাকিস্তানি মতাদর্শ অনুসারী এই আত্মপরিচয়হীন পাঞ্জাবি রোবট দল ও উর্দুভাষী অভিবাসীরা মূলত জাতিগত পরিচয়হীন। তাদের তোতা পাখির মতো শেখানো বুলি আওড়াতে হয় এবং সব অনুশাসন মানতে হয়। এই মতাদর্শ অনুসারী ও ইসলামি জঙ্গিদের মধ্যে তেমন কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই। দুটি দলই মগজ ধোলাইয়ের শিকার।

১৯৪৭ নিয়ে আমি বহুবার ভেবেছি। ষড়যন্ত্রমূলক কালো নীলনকশায় যদি পাকিস্তানের স্বাধীনতা না আসত এবং জাতিসত্তা ও মাতৃভাষার গুরুত্ব প্রদানকারী গোষ্ঠীর নেতৃত্ব যদি তৎকালীন পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ বাঙালিদের হাতেই থাকত, তাহলে তারা পাকিস্তানি মতাদর্শ ও ইসলামের নামে সৃষ্ট ফ্যাসিবাদী ও কট্টরপন্থী গোষ্ঠীর লাগাম টেনে ধরত। সে ক্ষেত্রে পাকিস্তান বিভক্তির প্রয়োজনই হতো না। আমাদের ইতিহাসও অন্য রকম হতো।

উর্দু থেকে অনুবাদ ফারহানা মিষ্টি

সৈয়দ আসিফ শাহকার: ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি; সে সময়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় কারা-নির্যাতিত।

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০১৭ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত