বিজ্ঞাপন
default-image

বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণটি বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশের ইতিহাসে অনির্বাণ-শিখার মতো। ৪০ বছরের ব্যবধানে এটি আজও তাজা, প্রাসঙ্গিক এবং একইভাবে উদ্দীপনাময়। এটি এমন এক অমর-কথা, যার ভূমিকা ও অবদান জাতির জীবনে এখনো ফুরোয়নি। যেন এটি এক কল্পতরু—জাতির প্রয়োজনে সংগ্রামের প্রেরণা-পুষ্টি জোগাতে সদাই প্রস্ত্তত, সদাই সক্ষম।

এই ভাষণটি শোনা যেকোনো বাঙালির জীবনে অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। যার মধ্যে বাঙালিত্বের ছিটেফোঁটা হলেও আছে, সে যে বয়সেরই হোক, এই ভাষণ তাকে আলোড়িত করবে, অনুপ্রাণিত করবে। দেশ, মানুষ ও ইতিহাসের প্রতি তার অঙ্গীকারকে এ ভাষণ নবজীবন দেবে। আর তাই আজ ৪০ বছরের অভিজ্ঞতায় বলা যায়, এটি কালোত্তীর্ণ মহান শিল্পকর্ম, যা আজও সমানভাবে প্রেরণাদায়ী।

এই শিল্পিত ভাষণটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এক তারে বাঁধা ছিল, যেন বজ্রকণ্ঠের লক্ষ্যভেদী শব্দায়ুধ প্রতিপক্ষের সব বাধা ছিন্নভিন্ন করে জাতিকে স্বাধীনতার ঘাটে পৌঁছে দেবেই। এটা সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধুর বাগ্মিতার জাদুতে—বক্তব্যে সমালোচনা, অভিযোগ, ক্ষোভের প্রকাশ তো ছিলই; কিন্তু তাতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা ও চূড়ান্ত ঘোষণার গুরুত্ব চাপা পড়েনি। বক্তৃতায় মূল অভীষ্ট সাধনে ভুল হয়নি।

ভাষণটি কেবল বুদ্ধির নির্মাণ নয়, ভালোবাসার আবেগে জীবন্ত। এটির আবেদন যুগপৎ বুদ্ধি ও হৃদয়বৃত্তির কাছে। তাই অনুপ্রাণিত এক বক্তা সেদিন তাঁর মুখাপেক্ষী জনতাকেই জীবনের সবচেয়ে বড় ব্রত সাধনের আবাহন করেছিলেন। তাঁর ডাক মানুষের অন্তরে পৌঁছেছিল।

এক তারে বাঁধা ভাষণটির পাঁচটি বাঁক ফেরা লক্ষ করা যাবে। শুরুটা করেছেন সারা দেশে মানুষের আত্মত্যাগ স্মরণ করে এবং নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতি তাঁর ও বাঙালির সহজাত পক্ষপাতের কথা দিয়ে। তারপরই কিন্তু সুর চড়িয়ে পাকিস্তানি শাসকদের কাছে পাওয়া বঞ্চনা-নির্যাতন-প্রতারণার প্রসঙ্গ টেনে সত্তরের নির্বাচনের পরও তাঁর সমঝোতার ইচ্ছাকে উপেক্ষার কথা তুললেন। একই সূত্রে চলে এল ভুট্টোর ভূমিকা, বিশেষত, ষড়যন্ত্রকারী ভুট্টোকে ছেড়ে আওয়ামী লীগ, তিনি নিজে এবং বাংলাদেশের মানুষকে অভিযুক্ত করার জন্য পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে নালিশ জানিয়ে রাখলেন জনতার দরবারে। এরপর ছোট্ট একটা বাঁক নিলেন—তিনি যাদের এবং তাঁর নিজের যারা ভরসা, সেই জনমানুষের কাছে খুলে বললেন শান্তিপূর্ণ সংগ্রাম সত্ত্বেও ইয়াহিয়ার আক্রমণাত্মক ভূমিকা ও ষড়যন্ত্রের কথা। জবাব দিলেন সব অভিযোগের আর প্রতিবাদ জানালেন হত্যা ও নির্যাতনের। নেতা ও জনতার ঐক্য তাতে যেন গাঢ় হয়ে উঠল। এবার জননায়ক স্বৈরাচার ও ষড়যন্ত্রকারীদের পেছনে ফেলে আত্মবিশ্বাস ও সৎসাহসে ভর করে মুখোমুখি তাঁর দেশবাসীর। দ্বিধাহীন স্পষ্ট ভাষায় দৃঢ় কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন সরকারের জন্য শর্ত, আর জনগণের জন্য দিলেন নির্দেশনা। সরকারকে দিলেন হুঁশিয়ারি, জনগণকে করলেন সতর্ক। তারপর জনগণকে চরম সংগ্রামের জন্য প্রস্ত্ততি নিতে বললেন, নিজে নিলেন বিকল্প সরকারের ভূমিকা। করণীয় জানালেন। না, করণীয় সম্পর্কে বলতেও ভুললেন না।

শেষে টানটান উত্তেজনার মধ্যে যেন জ্যা-মুক্ত করলেন ধনুকের তীর—এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম; এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।

মুক্তিপাগল যে জাতি স্বাধীনতার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য অধীর প্রতীক্ষায় ছিল, তারা এই ভাষণের মাধ্যমে সেই সংকেতটি পেয়েছিল। এই ভাষণ ঘরকুনো নিতান্ত ছাপোষা বাঙালিকে রূপান্তরিত করেছিল বীরের জাতিতে।

এই ভাষণের পর যে কারও মনের সামান্য দ্বিধা ও দ্বন্দ্ব দূর হয়ে গেল। স্বভাবত বিভক্ত, কলহপ্রিয় মানুষগুলো সব ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রেরণা পেল এ থেকে। এই ঐক্য কোনো সীমা মানেনি, জাত মানেনি—সব বাংলা ভাষাভাষীকে এক করে দিয়েছিল। ব্যক্তিগত জীবন, সংসার, পরিবার, নিজেদের নৈমিত্তিক কাজগুলো বড্ড ছোট অকিঞ্চিৎকর মনে হতে থাকল। এই একটি ভাষণ সবার অন্তরের রুদ্ধ কপাটগুলো খুলে দিয়ে সব ক্ষুদ্র ভাবনা দূর করে তাদের নিয়ে এল জাতীয় জীবনের ঘটমান ইতিহাসের মহা রণাঙ্গনে।

রমনার রেসকোর্স ময়দানে সেদিন অপরাহ্নের এক অলৌকিক ভাষণে অবগাহন করে একটি জাতি নবজন্ম লাভ করেছিল।

সাতই মার্চের ভাষণটি ধর্ম-বর্ণ-বয়স-লিঙ্গনির্বিশেষে সব বাঙালিকে জয়বাংলার সৈনিকে রূপান্তরিত করেছিল।

বাঙালিকে এমন মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল এই ভাষণ, যে তার পক্ষে যুদ্ধ ও স্বাধীনতা এবং ত্যাগ ও বীরত্বের কমে আর কোনো বিষয় নিয়ে ভাবা সম্ভব ছিল না।

একটি ভাষণ পুরো জাতিকে এক ধ্যানে মহান ব্রতে উদ্দীপ্ত করেছিল।

নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে জয়বাংলা ছিল রণধ্বনি, মুজিব ছিলেন মহানায়ক আর সাতই মার্চের ভাষণ ছিল অনুপ্রেরণার অফুরন্ত উৎস।

সাতই মার্চের ভাষণ কেবল অবিস্মরণীয় নয়, বাঙালির জন্য অনিঃশেষ এর প্রেরণা। এটি রাজনীতির চিরায়ত এক ভাষ্য, ধ্রুপদি সৃষ্টি।

১৭ মার্চ ২০১১, চট্টগ্রাম