বিজ্ঞাপন
default-image

তৎকালীন পাকিস্তানের সামরিক শাসক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১ মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। এই ঘোষণার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে পড়ে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ১ মার্চ থেকে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর লেলিয়ে দিয়ে ইয়াহিয়া ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় ঢাকা ত্যাগ করেন। মধ্যরাত থেকে ঢাকা শহরের শান্তিপ্রিয় জনগণের ওপর পরিচালনা করা হয় গণহত্যার পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি—অপারেশন সার্চলাইট। আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু করে ধ্বংসলীলা। এতে প্রতীয়মান হয় তাদের আলোচনার একমাত্র লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশে সামরিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য কালক্ষেপণ ও গণহত্যা পরিচালনার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা।

সেনাবাহিনী ঢাকার রাস্তায় তিন ব্যাটালিয়ন সেনা নামায়। এক ব্যাটালিয়ন বর্মাচ্ছাদিত, এক ব্যাটালিয়ন বিমান বিধ্বংসী অস্ত্রসজ্জিত এবং এক ব্যাটালিয়ন পদাতিক বাহিনী। তাদের প্রথম লক্ষ্য ছিল ছাত্ররা।এস-২৪ ট্যাংক নিয়ে একদল সেনা মধ্যরাতের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আক্রমণ করে। হঠাৎ আক্রমণে ইকবাল হলের অসংখ্য ছাত্র মৃত্যুবরণ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক মনিরুজ্জামান ও অধ্যাপক ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা সেনাবাহিনীর শিকার হন। তাঁরা ছাড়াও ভূবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মুক্তাদির, মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ফজলুর রহমান, ফলিত পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এ আর খান খাদিম, গণিত বিভাগের শিক্ষক শরাফত আলী নিহত হন।

জগন্নাথ হলও আক্রান্ত হয়। সেখানে অবস্থানরত ছাত্রদের গুলি করে হত্যা করা হয়। হলের সামনেই তাঁদের কবর দেওয়া হয়। এখানে হলের আট-নয়জন বেয়ারাকে কবর খুঁড়তে এবং নিহত শিক্ষক ও ছাত্রদের কবরে টেনে আনার কাজে লাগানো হয়। কাজ শেষ হলে তাঁদের কবরেরই ধারে সার বেঁধে বসিয়ে গুলি করা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে রেললাইন বরাবর বস্তি ছিল, সেগুলো ধ্বংস করে দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় হত্যা করা বহু মানুষের লাশ সেনাবাহিনী সরিয়ে ফেলে। কিছু লাশ গর্তে একসঙ্গে মাটিচাপা দেওয়া হয়।

সেনাবাহিনী একই সঙ্গে রাজারবাগ পুলিশ হেডকোয়ার্টার আক্রমণ করে। সেখানে কিছু পুলিশ সদস্য কয়েক ঘণ্টা ধরে আত্মরক্ষার জন্য যুদ্ধ করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁরা টিকে থাকতে পারেননি। এখানে অনেক পুলিশ সদস্য নিহত হন।

পিলখানায় ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস বাহিনীর (ইপিআর) সদর দপ্তর সেনাবাহিনী চারদিক থেকে একইভাবে আক্রমণ চালিয়ে শত শত বাঙালি ইপিআর সেনাকে হত্যা করে।

ইত্তেফাক পত্রিকা অফিসে ট্যাংক দিয়ে আক্রমণ করা হয়। অনেক মানুষ এখানে আশ্রয় নিয়েছিল। পুরো বাড়িটি সেনাবাহিনীর গোলাগুলিতে একেবারে ধ্বংস ও ভস্মীভূত হয়ে যায়। পরিবাগে ইংরেজি দ্য পিপল কার্যালয় একেবারে ধ্বংস করে দেওয়া হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজেও গুলিবর্ষণ করা হয়। সেখানে সেনাবাহিনী একটি বাজার মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়। প্রতিটি স্থানে ট্যাংক, মর্টার, মেশিনগান প্রভৃতি দিয়ে চারদিক থেকে আক্রমণ করা হয়।

সবচেয়ে ভয়ংকর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় পুরান ঢাকায়। এখানে বাড়িঘর জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়। তাঁতীবাজার ও শাঁখারীবাজার এলাকা ভস্মীভূত হয়। বাড়িগুলোর ওপর পেট্রল ছড়িয়ে দেওয়া হয়। তারপর তার ওপর ছুড়ে দেওয়া হয় ফ্লেম থ্রোয়ার। আগুন ও গোলা থেকে বাঁচার জন্য অসহায় নর–নারী, শিশু, বৃদ্ধারা যখন প্রাণ বাঁচানোর জন্য বেরিয়ে আসছিল, তখন গুলি করে তাদের হত্যা করা হয়। এসব এলাকা ছিল হিন্দু অধ্যুষিত। রমনা কালীবাড়িতে প্রায় ৩০০ লোক হত্যা করা হয়।

হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনের রাস্তায় ১৫ থেকে ২০ জন যুবক খালি হাতে দাঁড়িয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছিল। মেশিনগান নিয়ে একটি মিলিটারি জিপ তাঁদের কাছে হাজির হয়ে সোজা ঝাঁকের পর ঝাঁক গুলিবর্ষণ করে।

প্রথম চোটে ঢাকার কত লোককে হত্যা করা হয়েছে তার সংখ্যা কোনো দিনই জানা যাবে না। টেলিগ্রাফসহ বিদেশি প্রতিটি পত্রিকা এই মন্তব্যই করেছে। লাখ লাখ লোকে ঠাসা ঢাকায় যে ধরনের আক্রমণ চালানো হয়েছে, তাতে লাখের ওপর মানুষ মারা গেছে বলে সহজেই অনুমান করা চলে। সেই কথাই বলেছে ৩০ মার্চের নিউইয়র্ক টাইমস। তাদের মতে, কেবল ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সমগ্র বাংলাদেশে তিন লাখ লোককে হত্যা করা হয়েছে। এর অধিকাংশই যে ঢাকায়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

ঢাকার মতো বাংলাদেশের অন্য শহরেও সেনাবাহিনী নেমে পড়ে। ২৫ মার্চ চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী বহু লোককে বন্দর এলাকায় গুলি করে হত্যা করে।

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০১৯ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত