বিজ্ঞাপন
default-image

১১ মার্চ ২০১৭ জাতীয় সংসদের শীতকালীন অধিবেশনের শেষ কর্মদিবসে দীর্ঘ আলোচনা শেষে ২৫ মার্চ ‘জাতীয় গণহত্যা দিবস’ হিসেবে ঘোষিত হওয়া এক ঐতিহাসিক ক্ষণ হিসেবে গণ্য হওয়ার দাবি রাখে। গণহত্যা এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ আন্তর্জাতিক অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয় অর্থাৎ এই অপরাধ যে কালে যে ভূখণ্ডে সংঘটিত হোক না কেন, তা সর্বকালে সর্বস্থানে সর্বজনের বিরুদ্ধে তথা গোটা মানবসভ্যতার বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধ। ‘জেনোসাইড’ বলতে যে ভয়ংকর নৃশংসতা বোঝায়, তা মোকাবিলায় বিশ্বসমাজের অবস্থান প্রকাশ পায় আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের কঠোরতায়। আর তাই ২৫ মার্চ জাতীয়ভাবে গণহত্যা দিবস ঘোষিত হলেও এর রয়েছে আন্তর্জাতিক তাৎপর্য ও প্রাসঙ্গিকতা, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দিবসটি ঘিরে আয়োজন বহন করে বিশেষ গুরুত্ব। এখানে স্মর্তব্য, গণহত্যার শিকার মানুষদের স্মরণ ও গণহত্যা প্রতিরোধে জাতিসংঘ ২০১৫ সালে সর্বসম্মতভাবে প্রতিবছর ৯ ডিসেম্বর গণহত্যা স্মরণ দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ১৯৪৮ সালের এই দিনে জেনেভায় জেনোসাইড কনভেনশন গৃহীত হয়েছিল, একান্তভাবে সেই দিনটিকে তাই জাতিসংঘ বেছে নিয়েছে বিশ্বব্যাপী গণহত্যা স্মরণ ও প্রতিরোধের দিন হিসেবে। এর পাশাপাশি জাতীয়ভাবে গণহত্যা দিবস পালন করছে গণহত্যার শিকার কতক জাতি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সংঘটিত হলোকাস্ট, আর্মেনিয়া কিংবা রুয়ান্ডার গণহত্যা স্মরণে রয়েছে আলাদা জাতীয় দিবস। এক্ষণে বাংলাদেশও যুক্ত হলো এমনি আরও কতক জাতীয় উদ্যোগের সঙ্গে। আশা করা যায় জাতীয়ভাবে দিবসটি পালনের পাশাপাশি সবাই আবার একত্র হবে আন্তর্জাতিকভাবে গণহত্যা স্মরণ দিবস উদ্‌যাপনে।

জাতীয় গণহত্যা দিবস বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো পালিত হচ্ছে এ বছর। এমনই দিবস পালন ঘিরে বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে বিভিন্ন মহলে। স্বীকৃতি-অস্বীকৃতির বিষয়টি রাজনীতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যে গণহত্যা তথা বাঙালি জাতি ও হিন্দু ধর্মসম্প্রদায়ের মানুষদের নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে আক্রমণ পরিচালিত হয় সেটা নানাভাবে সামরিক অভিযানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রকাশ পেয়েছিল। গণহত্যার একেবারে সূচনায়, যখন এর লক্ষণগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি, সেই সময় ২৮ মার্চ ঢাকায় মার্কিন কনসাল আর্চার কে ব্লাড ওয়াশিংটনে প্রেরিত তাঁর গোপন বার্তার শিরোনাম দিয়েছিলেন ‘বেছে বেছে গণহত্যা’ বা ‘সিলেকটিভ জেনোসাইড’। মে মাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশের অধিকৃত অঞ্চল ঘুরে অ্যান্থনি মাসকারেনহাস বাস্তবের ভয়াবহতার যে ছবি মেলে ধরেছিলেন বিলেতের সানডে টাইমস পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতায় বিশাল হরফে সেই লেখার শিরোনাম দেওয়া হয়েছিল ‘জেনোসাইড’, যে প্রতিবেদন আলোড়ন তুলেছিল দুনিয়াব্যাপী। নয় মাসজুড়ে আরও অনেক প্রতিবেদনে গণহত্যার মর্মস্পর্শী বহু বিবরণ প্রকাশ পেয়েছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের সংবাদের সঙ্গে সঙ্গে পাওয়া গেল বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের মতো নিষ্ঠুরতার বিবরণ, যা ছিল জাতি ধ্বংসের লক্ষ্যে চূড়ান্ত আঘাত।

অজস্র তথ্য-প্রমাণ-সংবাদ রয়েছে বাংলাদেশের গণহত্যা ঘিরে, নানাভাবে আলোচিত হয়েছে এর নৃশংসতা। এই গণহত্যা অস্বীকারের কোনো উপায় ছিল না, তারপরও অস্বীকারের চেষ্টা নানাভাবে দেখা গিয়েছিল এবং এখনো তার দেখা মেলে। কিন্তু যেটা লক্ষণীয়, একাত্তরের বাংলাদেশ তৎকালীন বিশ্ব গণমাধ্যমে, সিনেটে পার্লামেন্টে, সভা-সমাবেশ-মিছিলে বড়ভাবে জায়গা পেলেও বিজয়ের পর খুব দ্রুতই আলোচনা থেকে হারিয়ে গেল বাংলাদেশ, গণহত্যা তলিয়ে গেল বিস্মৃতিতে।

২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস পালনের সুবাদে বিভিন্ন রাষ্ট্র, আন্তর্জাতিক সংস্থা, গবেষক-বিশ্লেষক—সবার স্মৃতিতে আবার ফিরিয়ে আনা যাবে একাত্তরের গণহত্যা, তেমন প্রত্যাশা এবার করা যেতে পারে। আন্তর্জাতিক লোকস্মৃতিতে একাত্তরের গণহত্যার পুনঃপ্রতিষ্ঠা খুব জরুরি, তবে তার চেয়ে গুরুত্ববহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায় স্মরণ করিয়ে দেওয়া।

এমন পটভূমিকায় জাতীয় সংসদের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তের সূত্রে আমাদের মনে পড়ে ১৯৭৩ সালের জুলাই মাসের আরেকটি ঐতিহাসিক ক্ষণ, যখন জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়েছিল ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনাল) অ্যাক্ট’, গণহত্যাকারীদের বিচারের জন্য প্রথম বিধিবদ্ধ আইন। সেদিন সংসদে প্রদত্ত সমাপনী ভাষণে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গুরুত্ব তুলে ধরে আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর বলেছিলেন, ‘আমরা এদের (যুদ্ধাপরাধীদের) মনে করি শুধু বাংলাদেশের শত্রু নয়, মানবতার শত্রু। সেই হিসেবে আমরা তাদের বিচার করতে যাচ্ছি। সেই দায়িত্ব শুধু বাংলাদেশের নয়, সমগ্র বিশ্বের সভ্য মানবসমাজের কর্তব্য এদের নিন্দা করা, ঘৃণা করা, ধিক্কার দেওয়া।’

default-image

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর অ্যাডহক ভিত্তিতে গঠিত দুই বিচারশালা, নুরেমবার্গ ও টোকিও আদালত ছিল মানবজাতি ও মানবসভ্যতার বিরুদ্ধে সংঘটিত ভয়াবহ ও ব্যাপক পাশবিকতার বিচারে অভিনব পদক্ষেপ, নতুন আইন ও নতুন ভিত্তিতে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচার ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় জাতিসমূহের মিলিত উদ্যোগ। এই অভিজ্ঞতার নির্যাস মেলে ১৯৪৮ সালের জেনোসাইড কনভেনশনে, যেখানে অপরাধসমূহ সংজ্ঞায়িত হয় জেনোসাইড, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ হিসেবে। আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত এই সংজ্ঞার ভিত্তিতে যথাযথ আইনি বিধি অনুসরণ করে প্রতিষ্ঠা পাবে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত—এমনটাই ছিল প্রত্যাশা। তবে সেই প্রত্যাশা-পূরণ আর ঘটেনি। স্নায়ুযুদ্ধে বিভাজিত পৃথিবীতে এমন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে মতৈক্যের ভিত্তিতে আইন প্রণয়ন ও আদালত প্রতিষ্ঠায় বিশ্বসমাজ ব্যর্থ হয়েছিল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের গণহত্যার বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে বিশ্বসমাজের করার কিছু ছিল না। সেই সময় গণহত্যা বিচারে না ছিল আইন, না ছিল আদালত, না ছিল গণহত্যা প্রতিরোধে জাতিসংঘের কোনো উদ্যোগ। আর তাই বাংলাদেশের দুর্যোগের রাজনৈতিক দিক নিয়ে জাতিসংঘে তুমুল বিতর্ক হয়েছে, শরণার্থী দুর্গতির মানবিক দিক নিয়ে ছিল আলোচনা ও উদ্যোগ, কিন্তু গণহত্যা ও তা প্রতিরোধ নিয়ে জাতিসংঘ ছিল নিশ্চুপ, একেবারে ঠুঁটো জগন্নাথ। এমন কৃষ্ণ-সময়ে সভ্যতার বিরুদ্ধে তামসিক নৃশংসতা, যেখানে হাজার হাজার মানুষ মৃত্যুর কৃষ্ণগহ্বরে পতিত হলো, তা মোকাবিলায় চরম ব্যর্থতা ও ক্লীবত্বের পরিচয় দিল বিশ্বসমাজ।

সেই সমূহ ব্যর্থতার মুখে তৃতীয় দুনিয়ার এক পশ্চাৎপদ দেশ, জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের চেতনায় বলীয়ান হয়ে পাকিস্তানের উপনিবেশিক রাষ্ট্রকাঠামো ভেঙে যার বিস্ময়কর আবির্ভাব, যে দেশ রক্তাক্ত, যুদ্ধবিধ্বস্ত, এমনকি জাতিসংঘ দ্বারাও স্বীকৃত নয়, সেই বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসাধারণ প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণ নেতৃত্বে নবনির্বাচিত জাতীয় সংসদে প্রণয়ন করল যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিধান, আন্তর্জাতিক অপরাধ (আদালত) আইন এবং শুরু করতে চাইল বিচারপ্রক্রিয়া, ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য সভ্যতার পক্ষ থেকে গৃহীত উদ্যোগ। এ ক্ষেত্রে স্মরণ করা যেতে পারে গণহত্যা অধ্যয়নে অগ্রণী অধ্যাপক অ্যাডাম জোন্সের উক্তি, যিনি দ্য স্কোর্জ অব জেনোসাইডসহ আরও বহু বইয়ের প্রণেতা, যা দেশে দেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মূল পাঠ্যপুস্তক হিসেবে স্বীকৃত। ২০১৪ সালে ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে প্রদত্ত বক্তৃতায় তিনি বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের গুরুত্ব মেলে ধরে বলেন, ‘এটা (আইসিটি-বিডি) ছিল গণহত্যার বিচারের বিধিবদ্ধ প্রয়াসে অগ্রগণ্য, ইতিহাসে প্রথম পদক্ষেপ যেখানে “জেনোসাইড” শব্দবন্ধ পালন করে মুখ্য ও কেন্দ্রীয় ভূমিকা।’ আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারে নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করে তিনি বলেন, ‘যুগোস্লাভিয়া, রুয়ান্ডা, কম্বোডিয়া ও সিয়েরা লিওনে প্রতিষ্ঠিত অ্যাডহক ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠার নিছক কয়েক বছর আগে নয়, কয়েক যুগ আগে বাংলাদেশ এমন পদক্ষেপ নিয়েছিল। তা সত্ত্বেও আইসিটি (বাংলাদেশ) খুব স্বল্পই পরিচিতি পেয়েছে এবং বাংলাদেশের গণহত্যা তুলনামূলক গণহত্যা অধ্যয়ন বিশেষজ্ঞ, বিশেষভাবে আইন বিশেষজ্ঞদের দ্বারা খুব সামান্যই বিবেচিত হয়েছে।’

বাংলাদেশের গণহত্যা যে বিশ্বজনীন স্বীকৃতি পায়নি, সেটা নিয়ে গণহত্যার শিকার জাতি হিসেবে আমাদের খেদ থাকাটা স্বাভাবিক। তবে এখানে স্মরণ করতে হবে এই সমস্যা যতটা না বাংলাদেশের তার চেয়ে বেশি মানবসভ্যতার। গণহত্যার শিকার মানুষদের প্রতি বিশ্বসমাজ দায়বদ্ধ, এই দায়মোচনে বিশ্বসমাজের ব্যর্থতার বিচার-বিশ্লেষণ এখন জরুরি। পাশ্চাত্যের অর্জন ও অর্থনৈতিক-সামরিক-প্রযুক্তিগত ক্ষমতা সভ্যতার জন্য বড় সংকটও তৈরি করেছে, জুগিয়েছে একধরনের দম্ভ ও গর্ব, আর তাই তৃতীয় দুনিয়ার সাবেক ঔপনিবেশিক পশ্চাৎপদ দরিদ্র দেশের জাগরণ ও শক্তিময়তা অনুধাবনে পশ্চিমের ঘাটতি রয়েছে সীমাহীন। পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রনৈতিক শক্তির বাধা মোকাবিলা করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অসাম্প্রদায়িক জাতিচেতনায় ঐক্যবদ্ধ বাঙালি প্রায় অসাধ্য সাধন করেছিল একাত্তরে, অর্জন করেছিল বিজয়। যুদ্ধ-পরবর্তী পরিস্থিতিতে পথচলায় সেই বিজয় জাতিকে জুগিয়েছিল আত্মশক্তিতে আস্থা, যা প্রকাশ পেয়েছে ১৯৭৩ সালের আইনে এবং আইনমন্ত্রীর ভাষণে। সেই যাত্রাবিন্দু হবে বাঙালির নতুন অভিযাত্রার প্রেরণা, গণহত্যার স্মৃতি ও তথ্যাদি নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশ হাজির হবে ঠিকই, তবে কোনো উচ্চ মহল বা সংস্থায় আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির দেন-দরবারের চেয়েও বড় দিক হলো বিশ্বসমাজকে তাদের দায় স্মরণ করিয়ে দেওয়া।

গণহত্যাকারীদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সুদীর্ঘ ব্যর্থতার অবসান ঘটেছে ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে। ট্রাইব্যুনালে আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বিধিবদ্ধভাবে একের পর এক বিচার সম্পন্ন এবং রায় কার্যকর হচ্ছে। প্রায় চার দশক পরে হলেও বিচার থেকে যুদ্ধাপরাধীদের অব্যাহতি লাভ—এর মধ্য দিয়ে অবসিত হলো এবং জাতীয়ভাবে আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারে বাংলাদেশ তৈরি করল উদাহরণ।

বাংলাদেশ বহু বাধা উজিয়ে ইতিহাসের সঙ্গে বোঝাপড়া সম্পন্ন করলেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ ক্ষেত্রে বহু পিছিয়ে রয়েছে। বাংলাদেশের বিচার গুরুত্বপূর্ণ হলেও এই বিচারের আওতামুক্ত রয়েছে পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীরা। যে ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দী যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে অভিযোগনামা তৈরি হয়েছিল তাদের ছাড়িয়ে নিতে প্রবল চাপ তৈরি করেছিল পশ্চিমা ক্ষমতাবান মহল, চীনা নেতৃত্ব ও মধ্যপ্রাচ্যের রক্ষণশীল রাজন্যবর্গ। বস্তুত তাদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল অশুভ আঁতাত। আর এর ফলে পার পেয়ে যায় গণহত্যাকারীরা। আজ তাই তলিয়ে দেখতে হবে কেন নয় মাসজুড়ে বাংলাদেশে অবাধে গণহত্যা পরিচালনা করতে পারল পাকিস্তানিরা, কেন পরাজিত হয়ে নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণের পরও গণহত্যাকারীদের বিচার করা গেল না। গণহত্যার বিচার যদি হয় বিশ্বসমাজের অঙ্গীকার তবে এ ক্ষেত্রে নতুন ভাবনা ও নতুন পদক্ষেপের প্রয়োজন রয়েছে।

কীভাবে হতে পারে পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সে প্রশ্নের কোনো সরল উত্তর নেই। ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত এর পূর্ববর্তী সময়ে সংঘটিত অপরাধ স্বীয় এখতিয়ারের বাইরে রেখেছেন। এটা তাই বোধগম্য যে একাত্তরের অপরাধ নিয়ে আইসিসি মাথা ঘামাবে না। তবে এ ক্ষেত্রে শেষ কথা বলে কিছু নেই। গণহত্যার অপরাধ বিশ্বজনীন বিচার-ধারণার আওতাভুক্ত, তাই আইনের পথ যেখানে মনে হয় রুদ্ধ সেখানে কোন কপাট কখন কোথায় খুলে যায় হঠাৎ করে—কেউ বলতে পারে না। চিলির প্রবল-প্রতাপশালী জেনারেল পিনোশে দেশের সিনেট থেকে আইন পাস করিয়েছিলেন মানবতাবিরোধী অপরাধ থেকে নিজেকে অব্যাহতি দিয়ে। অবসরজীবনে তিনি চিকিৎসার জন্য স্পেনে গেলে সেখানকার আদালতে মামলা দায়ের হয় কয়েকজন হিস্পানি তরুণকে অপহরণ ও গুম করার অভিযোগে। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বৃহত্তর পটভূমিতে সংঘটিত এই ঘটনার বিচারে আন্তর্জাতিক আইন দেশীয়ভাবে প্রয়োগের যথার্থতা উল্লিখিত হয়। জেনারেল পিনোশে স্পেন থেকে পালিয়ে ইংল্যান্ডে যান, সেখানেও আদালতের তাড়া খেয়ে ফেরেন স্বদেশ চিলিতে। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত চিলির সিনেট জেনারেলের অব্যাহতি বিলোপ করে এবং আদালতে তাঁর বিচার শুরু হয়। পাকিস্তানি গণহত্যাকারীরা বিচারের বাইরে থাকলেও তাদের অপরাধের বিবরণ তৈরি এবং তা নিয়ে আন্তর্জাতিক আলোচনা-পর্যালোচনা-পথানুসন্ধান এখন জোরদারভাবে শুরু করা দরকার। অপরাধী আইনের আওতার বাইরে থাকলেও অপরাধ যেন তাদের তাড়া করে ফেরে সদা-সর্বদা, তারা যেন চিহ্নিত হয় নিষ্ঠুর ঘাতকরূপে, সেটা নিশ্চিত করা দরকার।

আরও যে বিষয়টি গণহত্যার স্মৃতি উদ্ভাসনের সূত্রে জেগে উঠছে সেটা মার্কিন প্রশাসন তথা নিক্সন-কিসিঞ্জারের ভূমিকা। আমরা যদি অতীত থেকে শিক্ষা নিতে চাই তবে এই ভূমিকার আরও গভীর বিচার-বিশ্লেষণ প্রয়োজন হবে। দ্য ট্রায়াল অব হেনরি কিসিঞ্জার বইয়ে ক্রিস্টোফার হিচেন্স যেমন দেখিয়েছেন কিসিঞ্জারের হাতে কেবল বাংলাদেশের গণহত্যার রক্ত লেগে নেই, পূর্ব তিমুর, চিলি, আর্জেন্টিনাসহ কয়েকটি দেশের মানবতাবিরোধী নৃশংসতার পেছনেও কাজ করেছে তাঁর ইন্ধন ও মদদ।

২৫ মার্চ সন্ধ্যায় গণহত্যার শিকার মানুষদের স্মরণে লক্ষ প্রদীপ প্রজ্বলিত হয়েছে বাংলাদেশে। এই অগ্নিশিখা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দায়। আমাদের বিশেষ প্রত্যাশা, গণহত্যাকারীরা যেন পার পেয়ে না যায়, বিশ্বসম্প্রদায় যেন তাদের নিন্দাবাদে মুখর হয়, শেখে তাদের ঘৃণা করতে, জানাতে পারে তাদের প্রতি ধিক্কার।

মফিদুল হক: লেখক; অন্যতম ট্রাস্টি, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০১৭ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত