বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল এক রক্তক্ষয়ী সর্বাত্মক জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। কিন্তু এ লড়াই, এ বিপুল আত্মত্যাগ নিছকই একটা ভূখণ্ড বা মানচিত্রের জন্য ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জাতি হিসেবে আমরা নিজেদের জন্য এমন একটি রাষ্ট্রকাঠামো পেতে চেয়েছিলাম, যা কতগুলো সুনির্দিষ্ট আদর্শ ও মূল্যবোধকে ধারণ করবে। নাগরিকদের মধ্যে সেগুলো নির্বিঘ্ন চর্চার পরিসর তৈরি করবে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে সেসব আদর্শ ও স্বপ্নের বাস্তবায়ন সম্ভব ছিল না।
মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামে সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাঙালি জনগোষ্ঠী তার ইতিহাসে একটি অনন্য ও অভিনব বাস্তবতা তৈরি করে। মুক্তিযুদ্ধের সাফল্য একদিকে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীকে একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে অভিষিক্ত করে, অন্যদিকে নতুন রাষ্ট্রকাঠামোর ভেতরে দীর্ঘ সংগ্রামের ফসল হিসেবে পাওয়া সেসব আদর্শ ও মূল্যবোধ চর্চার এক কঠোর দায় আরোপ করে এবং অবারিত সম্ভাবনার সুযোগ করে দেয়। মুক্তিযুদ্ধ তাই একাধারে এক দীর্ঘ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের সমাপ্তি এবং আরেকটি দীর্ঘ লড়াইয়ের সূচনা।
স্বাধীনতার পর প্রায় অর্ধশতক পথ আমরা পাড়ি দিয়ে এলাম। আর তিন বছর পর এর স্বর্ণজয়ন্তী। এখন তাই আমাদের সময় হয়েছে, মুক্তি ও স্বাধীনতাসংগ্রামের মধ্য দিয়ে পাওয়া সেসব আদর্শ ও স্বপ্নের দিকে আরেকবার ফিরে তাকানোর, তার কতটা আমরা পূরণ করতে পারলাম বা পারলাম না—তার হিসাব কষে দেখার।
সে হিসাব করার আগে আমাদের বুঝে নিতে হবে, কী ছিল সেসব আদর্শ ও মূল্যবোধ, যার জন্য আমরা আন্দোলন করেছি, জীবন বাজি রেখে অস্ত্র ধরেছি, অকাতরে অজস্র প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছি। আমাদের ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ সালের দুই দশকের আন্দোলনের দাবিগুলোর মধ্যে, যুদ্ধদিনে আত্মোৎসর্গের পেছনের অমর স্বপ্নের মধ্যে নিহিত হয়ে আছে সেসব আদর্শ, মূল্যবোধ আর স্বপ্ন। মুক্তির লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে পাওয়া সে ভাবটিকে আমরা পরম মমতায় ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ বলে অনুভব করি। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র মধ্যে সেসব আদর্শ, মূল্যবোধ আর স্বপ্ন মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে।
‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ নিয়ে যত পর্যালোচনা আমরা করব, সেটি ততই আমাদের কাছে স্পষ্টতর হয়ে উঠতে থাকবে। প্রথম আলোর এই ক্রোড়পত্রে আপাতত এর বিশেষ কিছু উপাদানের দিকে ফিরে তাকাতে চাই। আমরা বলতে পারি, সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতার পটভূমিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বুঝে নেওয়ার ও পর্যালোচনা করার এটি প্রাথমিক ধাপ। আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যে আদর্শগুলো ধারণ করে আছে, তার শুরুর দিকেই আসে মুক্তি, বাঙালিত্ব, গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, সাম্য ও মানবাধিকার। আমরা দ্রুত এসব আদর্শের পটভূমি বুঝে আসি।
মুক্তি
১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান ভাগ হওয়ার কিছুদিন যেতে না-যেতেই বাঙালির মোহভঙ্গ হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পেছনে মূল শক্তি ছিল পূর্ব বাংলার বাঙালি মুসলমানের জনসমর্থন। নব্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামোর ভেতরে শুরু থেকেই তারা অপরিসীম বঞ্চনার শিকার হলো। এই বঞ্চনাবোধের প্রথম প্রকাশ ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে। সেই যে আন্দোলনে সম্পৃক্ত হলো সাধারণ মানুষ, তা আর ছিন্ন হলো না। ১৯৫০-এর দশক থেকে ’৬০-এর দশক পর্যন্ত মুহুর্মুহু আন্দোলনে এক মুক্তির আকাঙ্ক্ষা গেড়ে বসতে লাগল মানুষের মনে। শুরুতে উঠল স্বাধিকারের দাবি। অচিরেই সেটি ধাবিত হলো স্বাধীনতার দাবির দিকে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, পেয়েছি সার্বভৌম একটি রাষ্ট্রও। মুক্তিযুদ্ধের সেটি মহত্তম অর্জন। কিন্তু ১৯৭১ সালের জনযুদ্ধকে ভালোবেসে আমরা নাম দিয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধ। কারণ, সে জনযুদ্ধে স্বাধীনতার দাবির পরিসর আরও বেড়ে গিয়েছিল। ধারণা হিসেবে ‘মুক্তি’ শব্দটির ভাব আরও ব্যাপক। মুক্তি মানে মানুষের সার্বিক বিকাশের মুক্তি।
বাঙালিত্ব
দেশভাগের আগ পর্যন্ত নানা কূট রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ‘বাঙালি’ ধারণাটির সঙ্গে পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের যোগসূত্র স্থাপিত হতে পারেনি। অথচ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপর পূর্ব বাংলার সেই জনগোষ্ঠীই তার রাজনৈতিক লড়াইয়ের অংশ হিসেবে বাঙালিত্বের ধারণাটিকে আত্মপরিচয়ের কেন্দ্র করে তুলল। রক্ত দিয়ে তারা প্রতিষ্ঠা করল বাংলা ভাষার দাবি। ১৯৬০-এর দশকজুড়ে রাজনীতির পাশাপাশি যেসব সাংস্কৃতিক সংগ্রাম চলল, তাতে অনেক কঠিন পথে আমরা বাঙালিত্বকে প্রতিষ্ঠা করলাম। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয় বাঙালিত্বের সেই জাতিগত প্রস্তাব সম্পূর্ণতা পেল। কিন্তু স্বাধীন দেশের মাটিতে বিভিন্ন ধর্মীয় ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তার উপাদানের সঙ্গে এই ধারণার স্বাস্থ্যকর মীমাংসা হলো না। তার জের চলল নানা সময়ে বিস্ফোরিত রাজনৈতিক সহিংসতায়। এ নিয়ে আমাদের আরও বহু পথ যাওয়া বাকি।
গণতন্ত্র
পাকিস্তানের প্রায় পুরোটা সময়জুড়ে আমাদের সব সংগ্রামের পেছনে ছিল মূলত গণতান্ত্রিক অধিকার পাওয়ার তৃষ্ণা। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফাতে এসেছিল সেই ঘোষণা। বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয় ১৯৭০ সালের নির্বাচনের কথা। নির্বাচনে ভূমিধস জয় পাওয়া সত্ত্বেও নানা ছলে আওয়ামী লীগকে সরকার পরিচালনার প্রাপ্য গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করল পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী। সেই গণতান্ত্রিক অধিকার পাওয়ার জন্য আমাদের বুকের রক্ত ঢেলে দিতে হলো। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য এই নির্বাচনী বিজয়ই আমাদের দিয়েছিল এক অনন্য নৈতিক ভিত্তি।
অসাম্প্রদায়িকতা
উপমহাদেশ ভাগ হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভিত্তি ছিল ধর্ম—রাজনীতিতে সংকীর্ণ অর্থে ব্যবহৃত ইসলাম। কিন্তু দ্রুতই আমরা পাকিস্তান রাষ্ট্রধারণার বিপরীতে ধর্মীয় সীমারেখার বাইরে ভাষানির্ভর একটি অসাম্প্রদায়িক জনঐক্য গড়ে তুললাম। ১৯৬০-এর দশকের ব্যাপক সাংস্কৃতিক আন্দোলন অসাম্প্রদায়িকতাকে আমাদের চেতনার অবিচ্ছেদ্য অংশ করে তুলল। পাকিস্তান যে এই মূল্যবোধের কত বিপরীতে ছিল, তার প্রমাণ মুক্তিযুদ্ধে ব্যাপক হিন্দুনিধন। মুক্তিযুদ্ধ সব ধর্মের মানুষের মধ্যে এক অভূতপূর্ব ঐক্য স্থাপন করল।
বৈষম্যবিলোপ
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এর পশ্চিম ও পূর্ব অংশের মধ্যে নানা বৈষম্য স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করে। এই দুই অংশে খুব স্পষ্টভাবে দুই বিপরীতমুখী অর্থনৈতিক কর্মসূচি অনুসরণ করা হয়। রপ্তানিতে এগিয়ে থাকা সত্ত্বেও দেশের পূর্ব অংশে বিনিয়োগ হলো কম। বড় ও ভারী শিল্পকারখানা প্রায় সবই গড়ে তোলা হলো পশ্চিম অংশে। পূর্ব অংশের ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে অর্থনীতির সার্বিক নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখল পশ্চিমের অল্প কয়েকটি ধনাঢ্য পরিবার। সরকারি চাকরি ও সামরিক বাহিনীতে দেখা দিল কোটার ব্যাপক বৈষম্য। এই পরিস্থিতির প্রকাশ ঘটল দুই অর্থনীতির তত্ত্বে। অতি দ্রুত বাঙালিদের স্বপ্নভঙ্গ ঘটতে শুরু করল। এর রাজনৈতিক প্রতিফলন দেখা দিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের দেওয়া ছয় দফায়। ছাত্রদের ১১ দফা দাবিতে এই বৈষম্য ঘোচানোর দাবি আরও স্পষ্ট রূপ পেল। স্বাধীনতার দাবির সঙ্গে মিলেমিশে গেল বৈষম্যবিলোপের আকাঙ্ক্ষা।
মানবাধিকার
১৯৭১ সাল পর্যন্ত গড়িয়ে আসা লড়াই ও মুক্তিযুদ্ধের পুরোটাই এক অর্থে মানবাধিকার অর্জনের সংগ্রাম—যার যার রাজনৈতিক আদর্শ ও সাংস্কৃতিক সত্তা চর্চার অধিকার, ধর্মপালনের অধিকার, মত পোষণ ও প্রকাশের অধিকার। রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান আগাগোড়াই এর বিরোধী ছিল। তবে মুক্তিযুদ্ধে ঘটে এর হিংস্রতম প্রকাশ। পুরো নয় মাস ধরে অত্যন্ত প্রকটভাবে মানবাধিকার পদদলিত করা হয়। আর্চার ব্লাডের ভাষায়, যুদ্ধের সময় তারা চালিয়েছিল ‘নির্বাচিত গণহত্যা’—শুধু রাজনৈতিক মতাদর্শ লালনের জন্য আওয়ামী লীগ-সমর্থক ও কমিউনিস্টদের এবং ধর্মবিশ্বাসের কারণে হিন্দুদের ওপর।
এসব মূল্যবোধ মানবসভ্যতার মহাযাত্রা থেকে সারা পৃথিবীর মানুষের সম্মিলিত উত্তরাধিকার। কিন্তু এর বাইরেও আশ্চর্য রকমভাবে এসব মূল্যবোধ আমরা অর্জন করেছি আমাদের রাজনৈতিক সংগ্রামের অনন্য পথে—আমাদের মুক্তিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে, বুকের রক্ত ইতিহাসের রাজপথে ঢেলে। এগুলো মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামের মধ্য থেকে পাওয়া জাতি হিসেবে আমাদের জন্য ভবিষ্যৎ পথনির্দেশনা।
ইতিহাসের যেকোনো বড় ঘটনার মহত্ত্ব এই যে তা নতুন বাস্তবতায় নতুনতর তাৎপর্যে আমাদের পথ দেখাতে পারে। প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযুদ্ধ এমন এক বিশাল গ্রন্থ, নতুনতর বাস্তবতায় যা আমাদের বারবার পাঠ করে আমাদের পথের দিশা ঠিক করে নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। গত চার দশকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিপুল উত্থান-পতন ঘটে গেছে। সে অভিজ্ঞতার পটভূমিতে এসব আদর্শ ও মূল্যবোধের ধারণায় নতুন নতুন উপাদান যুক্ত হয়েছে। অনেক ধারণার খোলনলচেও ব্যাপকভাবে পাল্টে গেছে। বর্তমান পৃথিবীতে এসব নতুন নিরিখে নিজেদের অর্জন-বিসর্জনের পর্যালোচনা না করে জাতি হিসেবে আমাদের এগোনোর উপায় নেই।
আমাদের এই ক্রোড়পত্র তারই এক বিনয়ী প্রচেষ্টা। এ অন্বেষণে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান ও আজিজুর রহমান খান, জ্যেষ্ঠ শিক্ষাবিদ ও ভাবুক আনিসুজ্জামান, প্রথিতযশা গবেষক গোলাম মুরশিদ, যশস্বী সম্পাদক মাহফুজ আনাম ও মানবাধিকার নেত্রী সুলতানা কামাল। তাঁরা এ দেশের অগ্রণী নাগরিক। অনেকে জনস্বার্থে স্ফুরিত বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দোলনে সরাসরি জড়িত ছিলেন ও আছেন। তাঁদের সম্পৃক্ত করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নিরিখে আমরা নিজেদের বুঝতে চেয়েছি। খুঁজে পেতে চেয়েছি বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য কিছু আলোকরেখা।
মতিউর রহমানপ্রথম আলোরসম্পাদক।