বিজ্ঞাপন
default-image

পাকিস্তানের জন্মের পর যখন প্রচণ্ড শক্তিতে সমাজের ভেতর থেকে নতুন বাঙালি মধ্যশ্রেণী একটা অসম্ভব টানে জনগণের মধ্যে শেকড়বাকড় রেখে উঠে আসতে চাইল, তখন সেই শ্রেণীর দর্শন, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ জুগিয়ে দিয়েছিল এ দেশের বুদ্ধিজীবীদের একটি বড় অংশ। নিজেদের দেশটাকে পাকিস্তানের নতুন ধরনের উপনিবেশ বলে মেনে না নেওয়ার ব্যাপারটা একেবারেই আবেগের ব্যাপার ছিল না, ছিল অস্তিত্ব টেকা না টেকার ব্যাপার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের পৃথিবীতে কোনো দেশই উপনিবেশ হয়ে থাকতে চায়নি। নিজের ভেতরের শক্তিটাকে চেনার চেষ্টা করেছে, সে সম্বন্ধে তীব্র সচেতন হয়ে উঠেছে, তার পরই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এ তো ইতিহাসেরই প্রক্রিয়া যে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে উপনিবেশের উচ্ছেদ ঘটানোর চেষ্টা করতে হলেও যাকে বলে বর্শার মাথা, সেই বর্শার মাথা হিসেবে মধ্যশ্রেণী সামনে চলে আসে।

তাদের বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা তখনই জরুরি হয়ে ওঠে। একাত্তরের আগের ২০ বছরে, নতুন রাজনীতি, সংস্কৃতি, আদর্শ ও লক্ষ্য নির্মাণে তারা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন, তা বোঝা যায় পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিহিংসায়। একাত্তরের আগেও সেই প্রতিহিংসার শিকার বুদ্ধিজীবীরা হয়েছিলেন; আবার পাক ওয়াতনের সেবা করার মাধ্যমে প্রকাশ্যে ও গোপনে তোফা ইনামধন্যও হয়েছেন একটি অংশ। সেই পদলেহীরা বেঁচে গেছেন, কিন্তু শহীদ হয়েছেন সেই সব মানুষ, যাঁদের মনে ও মস্তিষ্কে রয়ে গিয়েছিল স্পর্ধার বীজ। সেই বীজকে হত্যার জন্যই, সেই বীজ থেকে যাতে নতুন কোনো চারা না জন্মায় তার জন্যই ঘটানো হয়েছিল বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড। এটা ছিল একটি প্রগতিশীল রাষ্ট্র ও গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বীজতলাকে বিলীন করার ফ্যাসিস্ট প্রকল্প।

একাত্তর-পূর্ব সেই সময়টা নির্মাণ ও সৃষ্টির সময়। বাংলাদেশে মধ্যশ্রেণী নির্মাণের ও সৃষ্টির প্রচণ্ড টান যখন দেখা দেয়, তখন তার মধ্যে নিজেকে সার্থক দেখতে পাওয়া বুদ্ধিজীবী কোনো বাধাকেই তোয়াক্কা করেনি। পাঁচ বছর আগে পর্যন্ত মুসলমান জাতির জন্য করা সংগ্রাম পরিত্যাগ ও অস্বীকার করতে তাঁর একটুও সময় লাগে না। মুসলিম জাতিত্ব তিনি খোলসের মতোই নির্দ্বিধায় ত্যাগ করেন। সেই প্রয়োজনেই বাঙালিত্বের পরিচয়টাকে তাঁকে তুলে ধরতে হয়, আপন অস্তিত্বের নতুন নির্মাণের জন্য বুদ্ধিজীবীরা পালন করেন এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব। যাঁরা করেন না, তাঁরা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে চলে যান। একটা কারখানায় মূল পণ্যের সঙ্গে যেমন উপজাত নানা পণ্য উৎপাদিত হয়, ধর্ম-পরিচয়ের বিপরীতে বাঙালিত্বের পরিচয়ে গর্বিত মধ্যশ্রেণীর সঙ্গে সঙ্গে নানা উপজাত সামগ্রীও আমাদের হাতে চলে আসে। সেসব হলো বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য, বাংলার শিল্প, সংগীত, অসাম্প্রদায়িকতার ঝোঁক, ধর্মের খাঁচা থেকে বেরিয়ে আসা মুক্তি, আধুনিক জগতের হাওয়ায় নিঃশ্বাস নেওয়া। এসব অর্জনের জন্য বুদ্ধিজীবীদের কৃতিত্ব অস্বীকারের পথ নেই। এই কৃতিত্বের জন্যই পাকিস্তান রাষ্ট্রের খুনে বাহিনীর আক্রোশের শিকার তাঁরা হয়েছিলেন। কেবল বাঙালি হিসেবেই নয়, বাঙালির মন-মগজ-মন্ত্রদাতা হিসেবেই তাঁদের শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। নিশ্চিত পরাজয়ের মুখেও এই প্রতিহিংসা নিতে তারা যে ভোলেনি, তা থেকেই প্রমাণিত হয় সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধার মতো চিন্তার অস্ত্রে শাণিত বুদ্ধিজীবীদের তারা কতটা ঘৃণা করত, কতটা দায়ী করত তাদের পরাজয়ের জন্য।

বাংলাদেশের জন্মের পর এবং সমাজের ভয়ানক পার্শ্বপরিবর্তনের ফলে এই লড়াইগুলো অনেকটা ভোঁতা হয়ে গেছে। কিন্তু লড়াইগুলোর কোনোটাই শেষ হয়নি, শুধু বাংলাদেশের বাস্তবতায় তাদের ধার মরে গেছে। সে জন্যই হাঁটুপানিতে প্রবল বিক্রমে সাঁতার কাটা ছাড়া আজকের বুদ্ধিজীবীরা আর কিছুই করছেন না। সব মিলিয়ে বাঙালি বুদ্ধিজীবীর হাত, পা, মাথা, মুখ বাঁধা পড়ে গেছে। পরিপ্রেক্ষিত বদলে যাওয়ায় আর নতুন কাজের সন্ধানে পথ না খোঁজায় বুদ্ধিজীবীদের বড় অংশের পক্ষে বারবার ফেটানো একই কথার ধুলো না উড়িয়ে উপায়ও নেই।

মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস আমি দেশের মধ্যেই আটকা পড়েছিলাম, এদিক-ওদিক সরে যেতে গিয়ে বুঝতে পারি কী ভীষণ নিষ্ঠুর সর্বাত্মক মারণযজ্ঞের পাকা ব্যবস্থা হয়ে রয়েছে দেশের মধ্যে। দখলদার পাকিস্তানিরা দেশের সমস্ত শেয়াল কুকুর হায়েনাদের জড়ো করেছে, শকুনরা চক্কর দিচ্ছে মাথার ওপর। শিগগির আমি বুঝতে পারি, ছোটাছুটি করে হঠাৎ মৃত্যুর মুখে না পড়ে বরং স্থির সংকল্প নিয়ে তার মুখোমুখি হওয়াই ভালো।

তখনই মনে হয়, বাছাই করা একটা তালিকা তারা ঠান্ডা মাথায় তৈরি করছিল। এ কথাটি আমার পরে নয়, তখনই মনে হয়েছিল। মৃত্যুসংবাদ আসত, তা থেকে হত্যাতালিকার একটা নকশাও আন্দাজ করতাম।

তারা ঠিকই বুঝতে পেরেছে, যারা চিন্তা করে, ভাবুক, যাদের সমাজ চালানোর নৈপুণ্য আছে, তাদের হত্যা করলে একটা জাতিকে স্থায়ীভাবে পঙ্গু করা যায়। এসব ভাবলে বুকে জ্বালা ধরে। তিক্ত লাগে, অসহায় লাগে। সাত কোটি মানুষ এখন ১৬ কোটি মানুষে পরিণত হয়েছে। মানুষ বেড়েছে, হাতও বেড়েছে, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র আসেনি। সেটা অস্ত্র বা স্লোগান দিয়ে হয় না। কিন্তু সফল রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের সম্ভাবনা ১০০ ভাগ। সেই সম্ভাবনা নষ্ট হচ্ছে। এটাও সুচিন্তিতভাবেই করা হচ্ছে। সবাই সবকিছু বোঝে। আমরা যা কর্ম করেছি, তেমন ফলই পাব। বীজ যদি বিষের হয়, তবে গাছটা বিষবৃক্ষই হবে। সেই বিষবৃক্ষের তলায় আমরা কেবল বচন ছড়িয়ে যাচ্ছি, অথচ বচন দিয়ে কিছু হয় না।

১৮ মার্চ ২০১১, রাজশাহী