আমার বাবার নাম সুরেশচন্দ্র মণ্ডল। স্বামী রাজেন্দ্রনাথ বিশ্বাস। আমার স্বামীকে পাকিস্তানি বাহিনী হত্যা করেছে। আমার পৈতৃক ঠিকানা পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি উপজেলার গণপতিকাঠি গ্রামে। ১৯৭১ সালে আমার বয়স ছিল ১৯ বছর।
বাংলা সনের ১৭ বৈশাখ আমার স্বামীকে পাকিস্তানি বাহিনী হত্যা করে। সেদিন আরও বহু লোককে ডেকে নিয়ে তারা নরেরকাঠির একটা খালের পাড়ে তাদের একত্রে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মারে। আমার স্বামী শহীদ হওয়ার পর আমি প্রায় উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলাম। এর প্রতিশোধ নিতেই পরে আমি মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করি।
সিরাজ শিকদার ছিলেন এই এলাকার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার। তিনিই আমাকে ট্রেনিং দিয়েছেন এবং বুঝিয়ে-শুনিয়ে মুক্তিবাহিনীতে নেন। সেখানে তিনি ছেলেমেয়েদের ট্রেনিং দিতেন এবং বিভিন্ন জায়গায় তাদের অপারেশন করতে পাঠাতেন।
আমরা ১৮ জন পুরুষ ও চারজন মহিলা তাঁর কাছে প্রশিক্ষণ নিই। প্রশিক্ষণের পর যখন আমরা খবর পেতাম যে পাকিস্তানি সেনা আসছে, তখনই আমরা সেখানে গিয়ে ঝোপঝাড়ের ভেতর, রাস্তার ধারে, গাছের আড়ালে বা পেয়ারাবাগান থেকে তাদের আক্রমণ করার চেষ্টা করতাম।
পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর প্রথম আক্রমণ করা হয় কুরিয়ানা গ্রামের একটু নামায়। সেদিন একটা স্পিডবোটে চারজন পাকিস্তানি সেনা অরুণ চক্রবর্তীর বাড়ি থেকে একটি মেয়েকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। তখন বেলা তিন-সাড়ে তিনটা বাজে। আমি গ্রেনেড নিক্ষেপ করি সেই স্পিডবোটের ওপর। তখন বোটটা ডুবে যায়। মেয়েটা সাঁতরে কূলে ওঠে। পাকিস্তানি সেনারা হাবুডুবু খাচ্ছিল। আরও লোকজন আমার সঙ্গে ছিল, তারা ওদের ধরে ফেলে এবং বেয়নেট ও ছোরা দিয়ে কইচ্চা (কেটে) নদীতে ফেলে দেয়। তারপর আক্রমণ করেছি গরাঙ্গলে। সেখানে একটা ছোট লঞ্চে পাকিস্তানি সেনারা যাচ্ছিল। সেটা আক্রমণ করার পর পেছন থেকে তিনখানা গানবোট আসায় আমরা পিছিয়ে যাই। তখন কতজন মারা গেছে, তা বলতে পারব না, তবে মারা গেছে।
এই আক্রমণে আমাদের নেতৃত্বে ছিলেন কবি হুমায়ুন কবিরের ভাই মুক্তিযোদ্ধা ফিরোজ কবির। তাঁর নেতৃত্বে আমরা এই অপারেশনটা করি।
আমাদের এর পরের অপারেশন ছিল সাইচকায়। সেখানে এক বাড়িতে সাত-আটজন পাকিস্তানি সেনা ছিল। ওখানে এসে তারা আর যেতে পারেনি। রাতে তারা আগুন জ্বালিয়ে সেখানে অবস্থান করছিল। আমরা তাদের চারদিক দিয়ে বেড় দিয়ে সবাইকেই মেরে ফেলতে সক্ষম হয়েছিলাম। ওখানে অপারেশনটা করার পর বহু সেনা এসে অনেক বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। এরপর আমরা সাইচকা থেকে দশমহলে চলে যাই। দশমহল থেকে বলদিয়ায় ফিরে এসে ওখানে আমার ঠিক নদীটির নাম মনে নেই, সেই নদীতে পাকিস্তানি সেনার ওপর আক্রমণ করি। আমরা দুজন সেনাকে রেখে দিতে সক্ষম হয়েছিলাম।
হয়েছিলাম। আর বাকি সবাইকে মেরে ফেলেছি। আমরা যাদের ধরতাম, তাদের আর ছাড়তাম না। দশমহল থেকে আমরা আবার যখন গরাঙ্গলে ফিরে আসি, তখন পান্না মিয়ার শ্যালক আমাদের পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেয়। আমাদের সঙ্গে ফিরোজ কবির এবং ঢাকা ইউনিভার্সিটির একজন ছাত্র ছিলেন। তাঁর নামটা সঠিক মনে নেই। আরেকজন ছিলেন মজিবর রহমান, বাড়ি ঝালকাঠি। এই তিনজনকে ওরা মেরে ফেলে। আমাকে আর মনিকাকে বরিশাল জেলখানায় পাঠায়। সেখানে একটা সেলের ভেতর আমাদের দুজনকে আটকে রাখে। এই সেলে আমি আর মনিকা ১৭ দিন ছিলাম। তারা যখন আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে, আমরা বলেছি যে আমরা এসএসসি পরীক্ষার্থী। তখন তারা প্রিন্সিপ্যাল এনায়েত করিমকে টেলিফোন করে। প্রিন্সিপ্যাল নাকি বলেছিলেন, ‘আমার কলেজের ছাত্রী তো অনেক। সবাইকে চিনি না। তারা যখন বলছে, নিশ্চয় তারা আমারই ছাত্রী। পাঠিয়ে দিন।’ এরপর পাকিস্তানি সেনা আমাদের দুজনকে চাখারে একজন অধ্যাপকের জিম্মায় দেয়। তারপর আবারও অস্ত্র হাতে তুলে নিই।
সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০১০ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত