বিজ্ঞাপন
default-image

১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার শপথ নেয়। দেশে তখন অবিরাম যুদ্ধ, যোগাযোগব্যবস্থা বিপর্যস্ত। সে সময় মুজিবনগর সরকার একটি ডাকব্যবস্থা গড়ে তোলার গুরুত্ব উপলব্ধি করে এবং একটি কেন্দ্রীয় ডাকঘরসহ বেশ কিছু ফিল্ড পোস্ট অফিস স্থাপন করে। মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দেওয়ার জন্য এই ডাকব্যবস্থা অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করে। মুজিবনগর সরকার উপলব্ধি করে যে স্বাধীনতার স্বপক্ষে বিশ্বজনমত সৃষ্টির জন্য ডাকটিকিট একটি শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারে। তাই তারা বাংলাদেশ নামে ডাকটিকিট প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয়। বাংলাদেশ সরকার ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য ও ডাক বিভাগের পোস্টমাস্টার জেনারেল জন স্টোনহাউসকে এ ডাকটিকিট প্রকাশের দায়িত্ব দেয়।

জন স্টোনহাউস লন্ডনপ্রবাসী বাঙালি নকশা প্রণয়নকারী বিমান মল্লিককে বাংলাদেশের ডাকটিকিটের নকশা করার দায়িত্ব দেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ১৯৭১ সালের ২৬ জুলাই লন্ডনের হাউস অব কমনসে বিমান মল্লিকের নকশা করা আটটি ডাকটিকিট ও একটি উদ্বোধনী খাম প্রদর্শন করেন। পরদিন ফলাও করে লন্ডনের দ্য টাইমস, দ্য গার্ডিয়ান, দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ডাকটিকিটের সংবাদ প্রকাশিত হয়। ১৯৭১ সালের ২৯ জুলাই বাংলাদেশের প্রথম আটটি ডাকটিকিট প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে একযোগে মুজিবনগর, কলকাতার বাংলাদেশ মিশন ও লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়।

default-image

১৯৭১ সালের ১ আগস্ট ব্রিটেনের ট্রাফালগার স্কয়ারে বিমান মল্লিক বাংলাদেশের আটটি ডাকটিকিট জনসমক্ষে হাত উঁচিয়ে তুলে ধরেন। এ অনুষ্ঠানে জন স্টোনহাউসসহ অনেক গণ্যমান্য অতিথি, প্রবাসী বাঙালি ও ব্রিটিশ নাগরিকেরা উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার জন্য এই আটটি ডাকটিকিট বড় ভূমিকা পালন করে। মুক্তাঞ্চল থেকে পাঠানো অনেক চিঠিপত্রে এসব ডাকটিকিট ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশের প্রথম আটটি ডাকটিকিটের নকশা প্রণয়নকারী বিমান মল্লিক ছিলেন একাধারে গ্রাফিক্স ডিজাইনার, চিত্রকর, সমাজসচেতন মানুষ ও একজন ম্যারাথন দৌড়বিদ।

গত ২৭ মার্চ ২০১২ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখায় বিমান মল্লিককে মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা দেয়। সে সময় হোটেল রূপসী বাংলায় অবস্থানকালে বর্তমান লেখককে তিনি একটি সাক্ষাত্কার দেন। সে সাক্ষাত্কারের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো।

আনোয়ারুল কাদির: আপনি যখন জানতে পারলেন যে বাংলাদেশ সরকার আপনাকে ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ দিতে যাচ্ছে, তখন আপনার কেমন অনুভূতি হয়েছিল?

বিমান মল্লিক: আমি অভিভূত হয়েছি, খুশি হয়েছি। আমার স্ত্রী অপরাজিতাও খুশি হয়েছেন। আমার মেয়ে সান্দ্রা বলেছে, ‘বাবা, পুরস্কার তো তুমি আগেই পেয়ে গেছো। এমন একটি ঐতিহাসিক ডাকটিকিট ডিজাইনের সুযোগ পেয়েছিলে এবং সেটা করেছিলে, সেটাই তো তোমার বড় পুরস্কার।’

কাদির: ডাকটিকিট ডিজাইনে কীভাবে এলেন?

বিমান: ১৯৬৯ সালে ব্রিটিশ ডাকবিভাগ মহাত্মা গান্ধীর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ডাকটিকিট প্রকাশের জন্য নকশা আহ্বান করে। আমার নির্বাচিত নকশা দিয়ে ১৯৬৯ সালের ১৩ আগস্ট মহাত্মা গান্ধীকে নিয়ে ডাকটিকিট প্রকাশিত হয়। সে নকশার জন্য আমি স্বর্ণপদকও পাই। ব্রিটিশ ডাকবিভাগ সেবারই দেশের বাইরের কোনো ব্যক্তিত্বের ওপর প্রথম ডাকটিকিট প্রকাশ করে।

কাদির: বাংলাদেশের ডাকটিকিটের নকশা করার দায়িত্ব কীভাবে পেয়েছিলেন?

বিমান: মহাত্মা গান্ধীর ডাকটিকিট নকশা করার সময় ব্রিটিশ সাংসদ ও ব্রিটিশ ডাকবিভাগের তত্কালীন পোস্টমাস্টার জেনারেল জন স্টোনহাউসের সঙ্গে আমার টেলিফোনে যোগাযোগ হয়। ১৯৭১ সালের ২৯ এপ্রিল তিনি আমাকে বাংলাদেশের জন্য ডাকটিকিট নকশা করার অনুরোধ জানান। তাঁর সঙ্গে আমি দেখা করি ১৯৭১ সালের ৩ মে। ২৯ এপ্রিল থেকে ২৬ জুলাই পর্যন্ত জন স্টোনহাউসের সঙ্গে আমার অনেকবার সাক্ষাত্ হয়। তাঁর অনুরোধেই আমি বিনা পারিশ্রমিকে বাংলাদেশের ডাকটিকিটের নকশা করি।

কাদির: আপনাকে কয়টি এবং কত মূল্যমানের ডাকটিকিট নকশা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল?

বিমান: আমাকে নির্দিষ্টভাবে বলা হয়নি আমি কতগুলো বা কী মূল্যমানের ডাকটিকিট করব। ১৯৭১ সালে খবরের কাগজ ও টেলিভিশনের কল্যাণে পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি বেশ ভালো করে জানতাম। মনের মধ্যে বারুদ জমা হচ্ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটা অনুপ্রেরণার বারুদে অগ্নস্ফুিলিঙ্গের কাজ করেছিল। সেই ঘটনাকে উপলক্ষ করে সৃষ্টি করেছিলাম আটটি ডাকটিকিটের একটি সেট। ওই আটটি ডাকটিকিটের মধ্যে ‘ম্যাসাকার অ্যাট ঢাকা ইউনিভার্সিটি’ আমার সবচেয়ে প্রিয়। আমার শিল্পীজীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাংলাদেশের প্রথম ডাকটিকিট। ডাকটিকিটের মূল্যমান আমি এক পাউন্ডের সমমান ২১ রুপি ৮০ পয়সার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখি। মূল্যমান নির্ধারণ করি ১০ পয়সা, ২০ পয়সা, ৫০ পয়সা, ১ রুপি, ২ রুপি, ৩ রুপি, ৫ রুপি ও ১০ রুপি।

কাদির: আপনার নকশা করা ডাকটিকিটগুলো কীভাবে অনুমোদিত হয়?

বিমান: ১৯৭১ সালের ১৮ মে আমি আটটি ডাকটিকিটের নকশা জন স্টোনহাউস ও তত্কালীন মুজিবনগর সরকারের বিশেষ দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে দেখাই। নকশাগুলো তাঁরা অনুমোদন করলেন। এরপর স্টোনহাউস নকশাগুলোর ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদন নেয়। ২৬ জুলাই ডাকটিকিটের নকশাগুলো লন্ডনের হাউসেস অব পার্লামেন্টের হারকোর্ট রুমে বিশেষ অতিথি ও আমন্ত্রিত সাংবাদিকদের কাছে প্রথম প্রদর্শন করা হয়। ২৯ জুলাই ডাকটিকিটগুলো একই সঙ্গে লন্ডন ছাড়াও কলকাতা, বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, ইসরায়েল, অস্ট্রেলিয়া, জাপানসহ দূরপ্রাচ্যের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রকাশিত হয়। লন্ডনের অনুষ্ঠানটি হয়েছিল হাউসেস অব পার্লামেন্টের ৮ নম্বর কমিটি রুমে।

কাদির: ডাকটিকিটগুলোয় দেশের ও মুদ্রার নামে ব্যতিক্রম থাকার কারণ কী?

বিমান: হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন। দেশের নাম আলাদা দুটি বাংলা শব্দে ‘বাংলা’ ও ‘দেশ’ এবং ইংরেজিতে ‘Bangla Desh’ আর মুদ্রার নাম রুপি লেখা হয়। তখনো আসলে ধারণা ছিল না দেশের নাম কীভাবে লেখা হবে, মুদ্রার নাম কী হবে। আমি জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের বাংলা ভাষার অভিধান-এ ‘বাঙ্গালা দেশ’-এর অনুসরণে দেশের নামে দুটি আলাদা শব্দ ব্যবহার করি এবং পাক-ভারত উপমহাদেশের অনুসরণে মুদ্রার নাম রুপি লিখি। ডাকটিকিটগুলো এভাবেই অনুমোদন করা হয়েছিল।

কাদির: ‘বাংলাদেশের মুক্তি’ ওভারপ্রিন্ট ডাকটিকিট সম্পর্কে কিছু বলুন।

বিমান: ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর। সে দিন ছিল আমার ৩৮তম জন্মদিন। সকালবেলা জন স্টোনহাউস টেলিফোনে জানালেন, ‘জানো, গতকাল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যৌথবাহিনীর সেনাপতি জগজিত্ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। সংবাদটি আমার কাছে জন্মদিনের সবচেয়ে বড় উপহার হিসেবে মনে হলো। তিনি আরও বললেন, ঘটনাটিকে স্ট্যাম্পের মাধ্যমে উদ্যাপন করা দরকার। সুতরাং ‘বাংলাদেশ লিবারেটেড’ ওভারপ্রিন্ট করে অবিলম্বে কিছু স্ট্যাম্প প্রকাশ করতে চাই। আনন্দে আমার মন ভরে গেল। আমি তাঁকে বললাম, ‘বাংলাদেশ লিবারেটেড’ কথাটার বাংলাও থাকা দরকার। ‘বাংলাদেশ মুক্ত’, ‘মুক্ত বাংলাদেশ’ নাকি ‘বাংলাদেশের মুক্তি’—কোনটা যে উপযুক্ত বাংলা হবে, বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এবার আমি আমার স্ত্রী অপরাজিতার আশ্রয় নিলাম। অপরাজিতার উত্তর ছিল, তিনটাই তো ঠিক। তবে ‘বাংলাদেশের মুক্তি’ কথাটার মধ্যে ব্যঞ্জনা বেশি। তবে এ বিষয়ে মনে হয় দ্বিতীয় একটি মত নিতে পারলে ভালো হয়। হঠাত্ মনে হলো, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সঙ্গে আলোচনা করা যায়। তখন বাংলা বিভাগের প্রধান তারাপদ মুখ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বললেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তি’ ঠিক আছে। এরপর ২০ ডিসেম্বর আমার নকশা করা আটটি ডাকটিকিটের মধ্যে ১০ পয়সা, ৫ রুপি ও ১০ রুপি মূল্যমানের তিনটিতে ‘বাংলাদেশের মুক্তি’ কথাটি ওভারপ্রিন্ট করে প্রকাশ করা হয়। ‘বাংলাদেশের মুক্তি’ কথাটি আমার হাতের লেখা দিয়েই করা হয়। এ এক অসাধারণ ঘটনা।

কাদির: আপনার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কিছু বলুন।

বিমান: ১৯৩৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর অবিভক্ত ভারতের হাওড়ায় আমার জন্ম। আমার পুরো নাম বিমানচাঁদ মল্লিক। বাবা অজিত কুমার ছিলেন ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামে গান্ধীজির স্নেহধন্য সহযোগী। ছেলেবেলায় বাড়িতে সব সময় স্বাধীনতার কথা শুনেছি। চিরকাল নিজেকে ভারতীয় ও বাঙালি বলে জেনেছি। বাংলাদেশ সরকার আমাকে ভিনদেশি বন্ধু হিসেবে পুরস্কৃত করেছে। নিজেকে ভিনদেশি হিসেবে মেনে নিতে ইচ্ছে করে না। আমি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্কটিশ চার্চ কলেজে সাহিত্যে পড়াশোনা করি। তবে চিত্রকলায় আমার আগ্রহ ছিল বেশি। ভারতের আন্তবিশ্ববিদ্যালয় চিত্রকলা প্রদর্শনীতে অংশ নিয়ে আমি চারুকলা বিভাগে পুরস্কারও পাই। পরে ১৯৬০ সালে আমি বিজ্ঞাপনী নকশার ওপর পড়াশোনার জন্য লন্ডন চলে আসি। সেই থেকে ইংল্যান্ডেই থাকছি। আমার স্ত্রী অপরাজিতা, একমাত্র মেয়ে সান্দ্রা।

সূত্র: ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত