বিজ্ঞাপন
default-image

যে পর্যায়ে আমি শিক্ষকতা করি, সেখানে ছাত্রছাত্রীদের উচ্চমাধ্যমিক পাস করে আসতে হয়। ফলে তাদের মধ্যে দেখা যায় অনেকেই আসন্ন নির্বাচনে প্রথমবারের মতো ভোটার হয়েছে এবং আমি জিজ্ঞেস করে জেনেছি, তারা প্রায় সবাই খুব উত্সাহের সঙ্গে ভোট দিতে যাবে বলে ঠিক করেছে। কেউ কেউ তো এ বিষয়টি নিয়ে রীতিমতো রোমাঞ্চিত মনে হলো। আমাদের পোড়-খাওয়া দীর্ঘ জীবনে ভোটের রাজনীতির যে অন্তর্নিহিত দুর্বলতা অতীতে আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে, সেই অভিজ্ঞতার কথা বলে এই উজ্জ্বল তরুণ-তরুণীদের উত্সাহ ম্লান করা যে কত বড় ভুল এবং অন্যায় হবে, তা নিমেষেই বুঝতে পারলাম। বরং বলতে দ্বিধা নেই, তাদের উত্সাহে একটা পরিবর্তনের আভাস পেয়ে যেন নিজেই উজ্জীবিত বোধ করলাম।

এ দেশের তরুণ সমাজ দেশটাকে দারুণ ভালোবাসে। অল্প কিছুসংখ্যক তরুণ-তরুণী স্বার্থান্বেষীদের খপ্পরে পড়ে বিভ্রান্ত হলেও তারা অধিকাংশই এ দেশের ভালো-মন্দে আনন্দ-বেদনা অনুভব করে। এ দেশের যা কিছু গৌরবের, তা নিয়ে তারা গৌরব করতে চায়। কিন্তু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশ তাদের সেই গৌরবগাথা জানানোর জন্য অনুকূল হতে পারছে না। তাদের মধ্যে অনেকেই কেবল ভাসা ভাসা জানে যে এ দেশে বায়ান্নতে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল, ঊনসত্তরে গণ-অভ্যুত্থান ঘটেছিল এবং একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল।

এ ছাড়া অতীতের আরও বহু গৌরবময় ও তাত্পর্যপূর্ণ ঘটনা সম্পর্কে অধিকাংশ তরুণ-তরুণীরই জানার সুযোগ তেমন নেই। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় যেমন এগুলো সম্পর্কে ছাত্রছাত্রীদের জানানোর বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পায় না, তেমনি পরিবার বা সমাজ থেকেও খুব অল্পসংখ্যক তরুণ-তরুণীই বিষয়গুলো সম্পর্কে যথাযথ ধারণা পেয়ে থাকে। ফলে এসব ঘটনার ব্যাপারে তাদের চিন্তা ও আবেগ-অনুভূতির মাত্রা দুঃখজনকভাবে খুবই সীমাবদ্ধ থেকে যায়।

ডিসেম্বর মাসকে আমরা বলে থাকি বিজয়ের মাস। কিন্তু এই বিজয়ের তাত্পর্য কী ছিল, কতটা আত্মত্যাগ করতে হয়েছিল এই জাতিকে সেই বিজয় অর্জনের জন্য, কতটা অযৌক্তিক, নৃশংস, নিষ্ঠুর ও উন্মত্ত ছিল পাকিস্তানি হানাদারেরা—সেই অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির খুব কম অংশই আমরা জানাতে বা বোঝাতে পেরেছি নতুন প্রজন্মকে। আমরা খুব কমই বোঝাতে পেরেছি কী পরিমাণ বর্বরতা, আক্রোশ ও দানবিক শক্তি নিয়ে একাত্তরের পঁচিশে মার্চের রাতে পাকিস্তানি সেনারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ঢাকাবাসীর ওপর। সেই অভিজ্ঞতার বর্ণনা আসলে খুব সহজও নয়। হত্যা, অগ্নিসংযোগে তছনছ ঢাকাকে বাধ্য হয়ে ২৯ মার্চ সপরিবারে ছেড়ে যাওয়ার সময় চারদিকে তাকিয়ে মনে হয়েছিল, বাল্যকাল থেকে এই শহরে বেড়ে ওঠা আমার পরিচিত ঢাকাকে আমি চিনি না। আমাদের রাজারবাগ পুলিশ লাইন পার হয়ে যেতে হয়েছিল, দেখে মনে হয়েছিল যেন হিরোশিমা কিংবা নাগাসাকির কোনো ধ্বংসপ্রাপ্ত এলাকা দেখছি।

মনে হয়েছিল, দেশের পুলিশ সদর দপ্তর এভাবে ধ্বংস করতে পারে যে দানবিক শক্তি, তারা তো আসলে দেশটাকেই ধ্বংস করতে চাইবে। ঢাকা থেকে ডেমরা গিয়েছিলাম বেবিট্যাক্সি করে—দুই ধারে অসংখ্য লাশ, রিকশার ওপর উপুড় হয়ে পড়ে থাকা লাশ, কাটা রাস্তার দুই ধারে পড়ে থাকা লাশ, মিলিটারির আগুন দেওয়া সম্পূর্ণ পুড়ে যাওয়া বস্তি, সামান্য সম্বল নিয়ে ঢাকা ছেড়ে যাওয়া অসংখ্য ভীতসন্ত্রস্ত মানুষ—এই দৃশ্য দেখতে দেখতে সেদিন পৌঁছে গিয়েছিলাম ডেমরায়, সঙ্গে আমার অসুস্থ শিশু, নদী পার করে দিল এক দরদি মাঝি, বিপন্ন মানুষকে নদী পার করে দেওয়া যেন মনে হলো সে ব্রত হিসেবে নিয়েছে। ওপার লোকে লোকারণ্য। তরুণেরা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়াচ্ছে। গাঢ় সবুজের মাঝে টকটকে লাল বৃত্ত, বৃত্তের মধ্যে বাংলাদেশের সোনালি মানচিত্র। এত পতাকা কখন বানাল তারা!

আমার প্রয়াত বাবার একটি গ্রিনার বন্দুক ছিল। উত্তরাধিকার সূত্রে সেটি তখন আমাদের পারিবারিক সম্পত্তি। রেডিওতে জোর প্রচার হচ্ছে, ‘যাঁদের আগ্নেয়াস্ত্র আছে, তা তাঁরা নিকটবর্তী থানায় জমা দিন।’ কারফিউয়ের বিরতিতে আমরা তখন তড়িঘড়ি ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছি, তাই আগ্নেয়াস্ত্র থানায় নিয়ে যাওয়ার মতো সময় আমাদের হাতে ছিল না। সে সময় যাত্রীদের হোল্ডঅল ব্যবহারের রেওয়াজ ছিল, আমরাও কিছু অতি প্রয়োজনীয় বস্তুর সঙ্গে হোল্ডঅলের মধ্যে বন্দুকটি ভরে নিলাম। হোল্ডঅলে বন্দুকটি পুরোপুরি ভরা যাচ্ছিল না, নলের কিছু অংশ দেখা যাচ্ছিল। বেবিট্যাক্সিতে পা রাখার জায়গায় আড়াআড়ি ফেলে রাখা হলো সেটি। আমরা নদী পার হওয়ার সময় ডেমরার বাওয়ানী জুট মিলে মিলিটারির পাহারা ছিল। ভাগ্যিস, তারা কিছুটা বের হয়ে থাকা আমার বন্দুকের নল দেখতে পায়নি। দেখতে পেলে হয়তো এখন আর এই লেখা লেখার মতো হায়াত আমি পেতাম না।

আমার বন্দুক দেখে ডেমরার ওপারে তারাব ঘাটের মানুষ বেজায় খুশি। তখন কাঁচপুর ব্রিজ হয়নি। নৌকা বা ফেরি ছাড়া নদী পার হওয়ার উপায় ছিল না। ফলে নদীর ওপারের মানুষ তখনই নিজেদের স্বাধীন বাংলার মানুষ হিসেবে গণ্য করছে। তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, পাকিস্তানি সেনাদের তারা নদী পার হতে দেবে না। আমার বন্দুক দেখে তাই তারা খুশি। ভাবখানা এই, একটা নতুন হাতিয়ার এল এপারে। কেউ কেউ বলল, ‘খুব ভালো কাজ করছেন, এইটা নিয়া আইছেন।’ তখন কি আমার বা তাদের কারও জানা ছিল যে শটগান দিয়ে মেশিনগানের বিরুদ্ধে লড়াই করা যায় না। পরে অবশ্য পাকিস্তানিদের কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়েই প্রথম পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছিল তরুণেরা। সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালি সদস্যরাও তখন বেশ কিছু অস্ত্রসহই চলে এসেছিলেন।

নদী পার হওয়া মানুষের তুলনায় ওপারে যানবাহন ছিল খুবই কম। যা-ই হোক, অনেক কষ্টেসৃষ্টে আমরা শেষ পর্যন্ত ঢাকা থেকে মাইল চল্লিশেক দূরে আমাদের গ্রামের বাড়িতে পৌঁছলাম। পথে পথে দেখেছি, মানুষ পাকিস্তানবিরোধী, ইয়াহিয়াবিরোধী, ভুট্টোবিরোধী স্লোগান দিচ্ছে। মনে হচ্ছিল যেন এ দেশ প্রকৃতই স্বাধীন হয়ে গেছে। পেশা, বিত্ত, শিক্ষা, সামাজিক মর্যাদানির্বিশেষে মানুষ একাত্ম। পাকিস্তানি শাসকদের প্রতি ক্ষোভ, ঘৃণা প্রকাশে নারী-পুরুষ-শিশু প্রায় সমান আগ্রহী। জাতীয় ঐক্যের সে এক অভূতপূর্বক্ষণ, একটা জাতির জীবনে এমন ক্ষণ খুব বেশি দেখা যায় না। গ্রামে পৌঁছে দেখি, থানার সব রাইফেল এলাকার তরুণদের হাতে, পুলিশ-জনগণ সব একাকার। তাদের দৃঢ়সংকল্প, পাকিস্তানিরা হামলা করলে রুখতে হবে। এই দৃশ্য দেখে এলাকার সব মানুষই দারুণ উজ্জীবিত। সামনে যত বড় আঘাত কিংবা যত বড় বিপদই আসুক, তারা ভীত নয়।

এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই পাকিস্তানিরা বিমান আক্রমণ শুরু করল। হাট-বাজার পুড়ে ছারখার হতে থাকল পাকিস্তানি বোমায়। মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও মনোবল হারাল না। বরং দেশের মানুষ অবাক হয়ে দেখল, বাঙালি সেনা, তত্কালীন ইপিআর সদস্য, পুলিশ, আনসাররা ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে অবিশ্বাস্য দ্রুততায়। বোঝা গেল, স্বাধীনতার স্পৃহায় তারা এত দিন গোপনে উজ্জীবিত হচ্ছিল। বাঙালি তরুণেরা যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে থাকল, হাতে তুলে নিল অস্ত্র। দেখা দেল তাদের সংগঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে অভিভাবক, মা-বোনেরাও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিল। পাকিস্তানিদের রুখতে যেকোনো আত্মত্যাগে প্রস্তুত সবাই। সেদিনের সেই আবেগ, সেই দেশপ্রেমের বন্যায় সৃষ্ট পরিস্থিতির বর্ণনা করা সত্যিই কঠিন। আমাদের কিছু লেখক-শিল্পী সেই চেষ্টা করেছেন, তাঁদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা। কিন্তু সেই চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। তদুপরি যেসব কাজ হয়েছে এই লক্ষ্যে, লেখায়, নাটকে, চলচ্চিত্রে, চিত্রে, ভাস্কর্যে—সেসবকে জাতির কাছে আরও বেশি প্রচার করতে হবে। আমরা সেই সৃষ্টিশীল প্রতিভার পদধ্বনির জন্য কান পেতে আছি, যিনি জাতির মুক্তি সংগ্রামের আদ্যোপান্ত ধারণ করবেন তাঁর সৃষ্টিতে, সেই সময়ে জাতির নিখাদ দেশপ্রেমের আবেগ-অনুভূতিকে সঞ্চারিত করবেন নতুন প্রজন্মের কাছে।

একাত্তরের মার্চ-এপ্রিলে ঢাকা ছেড়ে যাওয়া মানুষগুলো প্রায় এক-কাপড়ে অথবা সামান্য সম্বল নিয়ে দূর-দূরান্তের উদ্দেশে রওনা হয়েছিল সম্ভাব্য আশ্রয়ের সন্ধানে। তাদের মধ্যে অনেকে হয়তো কখনো ঢাকা ছেড়ে যায়নি। কারও কারও লক্ষ্য দীর্ঘদিন না-যাওয়া গ্রামের বাড়ি, কারও কারও গন্তব্য অজানা। এসব মানুষকে বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় দিয়েছে সমমর্মী স্থানীয়রা, দিয়েছে খাদ্য, চিকিত্সা। যানবাহন অপ্রতুল, অনেকেই বহুদূরের পথ হেঁটেই যেতে বাধ্য হয়েছে। অনেকের যাওয়ার কোনো জায়গাই ছিল না। ফলে অপরিচিত, অনাত্মীয়দের কাছেই তারা আশ্রয় নিয়েছে। সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষের বাড়িতেই মহিলার সন্তান প্রসরের ঘটনাও ঘটেছে। সে অবস্থায়ও দেশ স্বাধীন হলে সেই সন্তানের নাম ‘মুক্তি’ রাখার পরামর্শ দিয়েছে আনাড়ি হাতে প্রসবে সাহায্যকারী বাড়ির মেয়েরা।

বাঙালি সেনা, বিডিআর, পুলিশ, আনসার ও ট্রেনিংপ্রাপ্ত তরুণদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা খণ্ড খণ্ড মুক্তিযোদ্ধার দল স্বতঃস্ফূর্তভাবে নানা স্থানে পাকিস্তানি হানাদারদের রুখে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। আমাদের অঞ্চলেও একই ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এ যে অসম যুদ্ধ। আধুনিক অস্ত্রে সুসজ্জিত নিয়মিত পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে প্রধানত থ্রি নট থ্রি রাইফেল অথবা বন্দুক নিয়ে যুদ্ধ করে টিকতে পারেননি মুক্তিযোদ্ধারা। তাই প্রাথমিক পর্যায়ে পিছু হটতে হয়েছে তাঁদের। কিন্তু অপার দেশপ্রেমে উজ্জীবিত এ দেশের প্রতিটি মানুষই যে শেষ পর্যন্ত হয়ে গেলেন মুক্তিযোদ্ধা। এমন জাতিকে পরাজিত করার শক্তি কোথায় পাবে হানাদারেরা! তাই ইতিহাস যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। মিত্র বাহিনীর সহযোগিতা আমাদের বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছে এ কথা সত্যি, কিন্তু একাত্তরে বাংলাদেশকে যারা প্রত্যক্ষ করেছে, তাদের অন্তরে এবং মানশ্চক্ষে গেঁথে আছে সেই সময়ে বিপুল দানবিক শক্তি দ্বারা অত্যাচারিত, নির্যাতিত হয়েও বাঙালি জাতির স্বাধীনতার জন্য দুর্দমনীয় আকাঙ্ক্ষা। পাকিস্তানি হানাদার এবং মুষ্টিমেয় বাংলাভাষী বিশ্বাসঘাতকের সাধ্য ছিল না সেই আকাঙ্ক্ষাকে দমন করা। কাজেই তখনই বোঝা গিয়েছিল এ জাতির স্বাধীনতা সময়ের ব্যাপার মাত্র।

একাত্তরে আমি এবং আমার পরিবার যে এলাকায় ছিলাম, তা এক অর্থে ছিল মুক্তাঞ্চল। পাকিস্তানিরা সেখানে মাঝেমধ্যে হামলা চালালেও কখনো দীর্ঘ সময় অবস্থান করতে পারেনি। মুক্তিযোদ্ধারা প্রায় নয় মাসই সেখানে ছিল সক্রিয়। দুর্গম ছোট ছোট পাহাড় বা টিলা বেষ্টিত এলাকায় ছিল তাদের প্রধান ঘাঁটি। আমি অবাক বিস্ময়ে দেখেছি তাদের দ্রুত সংগঠিত হওয়ার তত্পরতা। আমার পৈতৃক বসতবাড়িটাকে তারা বেছে নিয়েছিল তাদের একটি ক্যাম্প স্থাপনের জন্য। আমার পরিবারও তাদের সঙ্গেই বসবাস করেছে, যদিও মাঝেমধ্যে ক্যাম্পে পাকিস্তানি বাহিনীর হামলার খবর পেয়ে আমার পরিবারের সদস্যদের আরও দূরে কোনো বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়েছে। সেই আশ্রয় কখনো কখনো ছিল অত্যন্ত দরিদ্র কৃষকের পর্ণকুটিরে। কিন্তু সেই কুঁড়েঘরের মাটির মেঝেতে মাদুরে শুয়েও মণ ভরে গেছে গরিব চাষি পরিবারের আন্তরিক আতিথেয়তায়। তাদের সর্বস্ব দিয়ে তারা আমাদের যত্নআত্তি করেছে। বুকে তাদেরও পাকিস্তানি হানাদারদের প্রতি ঘৃণার আগুন। আমাদের এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস চুরি-ডাকাতি ছিল না বললেই চলে। একসময় চোর হিসেবে কুখ্যাত ব্যক্তিটিকে মুক্তিযোদ্ধাদের পাচক হিসেবে দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছি। কী গভীর মমতায় যে সে খাবার পরিবেশন করত তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের!

আমাদের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের যে ক্যাম্পটি ছিল, তাতে স্থানীয় তরুণেরা ছাড়াও নানা অঞ্চল থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধারাও থাকতেন। এই দলে বরিশালের একটি ছেলেও ছিল। তার বাবা বরিশালের এক প্রয়াত বামপন্থী নেতা। নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে সে এই দলে এসে স্থিত হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ম অনুযায়ী একসময় স্থানীয় বিভিন্ন বাড়িতে তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। অর্থাত্ দলীয়ভাবে কাজ করলেও তাদের খাবারের দায়িত্ব নেয় স্থানীয় বিভিন্ন পরিবার। বাংলাদেশ যে তখন পুরোটাই যুদ্ধক্ষেত্র, মা-বোনসহ সবাই মুক্তিযোদ্ধা! আমাদের পরিবারে বরিশালের ছেলেটির খাওয়ার বরাদ্দ ছিল। যুদ্ধে অসম সাহসী হলেও দীর্ঘাঙ্গী সুগঠিত স্বাস্থ্যের তরুণটি ছিল স্বভাবে লাজুক। কোনো কোনো দিন দলের সঙ্গে অ্যাকশন শেষ করে ক্যাম্পে ফিরতে তার গভীর রাত হয়ে যেত। এদিকে তার খাবার নিয়ে আমার স্ত্রী এবং পরিবারের অন্য মেয়েরা উত্কণ্ঠিতভাবে অপেক্ষা করত। কিন্তু রাত বেশি হলে আমরা ঘুমিয়ে গেছি মনে করে সে আর আমাদের ঘরে আসত না। না খেয়েই রাত কাটিয়ে দিত। সকালে নাশতা খেতে এসে ছেলেটি সলজ্জভাবে তার রাতে না আসার কারণ বর্ণনা করত।

অপর একটি ঘটনা না বললেই নয়। একটু দূরের এলাকার একটি ছেলে ক্যাম্পে রাতে পাহারা দিত। এটাই ছিল তার ডিউটি। পাকিস্তানি মিলিটারি বা শত্রুর এজেন্টদের সম্পর্কে পুরো দলকে সতর্ক রাখা ছিল তার দায়িত্ব। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে প্রচণ্ড শীতে সে খড়ের গাদায় রাত কাটাত। একদিন গভীর রাতে চাপা কান্নার শব্দে আমার পরিবারের সদস্যরা সচকিত হয়ে ওঠে। পরে জানা যায়, উল্লিখিত ছেলেটির চাচা আগের দিন মারা যাওয়ার খবর পেয়েছিল সে। বাবা মারা যাওয়ার পর এই চাচার কাছেই মানুষ হয়েছিল সে। একসময় পালিয়ে যোগ দেয় মুক্তিযুদ্ধে। দুর্ভাগ্যক্রমে তার চাচা হয়ে যায় পাকিস্তানিদের দোসর এবং মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতেই প্রাণ হারায় সে। এই অবস্থায় রাজাকার চাচার জন্য শোক করা মুক্তিযোদ্ধার জন্য মানানসই নয় বিধায় সে সবার সামনে কাঁদেনি। কিন্তু গভীর রাতে সে আর কান্না চেপে রাখতে পারেনি। ছেলেটি অবশ্য তার সহযোদ্ধাদের কাছে চাচার উপযুক্ত শাস্তিই হয়েছে বলে মত প্রকাশ করে।

এই ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। এ যেন এক মহাকাব্য। আরেক মুক্তিযোদ্ধা হাবিলদারের কথা মনে পড়ে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ট্রেনে করে মুক্তিযুদ্ধের একেবারে প্রথম পর্যায়ে সেনা, পুলিশ, আনসারদের একটি দল এসে নরসিংদীতে ক্যাম্প করে। তখনো পাকিস্তানি সেনারা এখানে হামলা করেনি। আমি এবং আমার এক সঙ্গী সেই দলনেতা হাবিলদারকে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘আপনারা কোন পথে গিয়ে পাকিস্তানিদের প্রতিরোধ করবেন?’ আমাদের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে হাবিলদার সাহেব বলেছিলেন, ‘জেন্টেলম্যান দিস ইজ ওয়ার, দিস ইজ নট প্লে।’ তাঁর কথার সারমর্ম ছিল, এটা মুক্তিযুদ্ধ, এটা খেলা নয়। আমি বাঙালি হলেও আমার মতো অপরিচিত মানুষকে তিনি যুদ্ধকৌশল বলবেন না। তাঁর সেদিনের সেই কথায় আমি ক্ষুণ্ন হইনি, বরং যোদ্ধা হিসেবে তাঁর সিরিয়াজ মনোভাব দেখে খুশি হয়েছিলাম।

মুক্তিযোদ্ধারা সত্যিই তাঁদের অন্তর দিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন। তাঁদের অধিকাংশই পেশাদার যোদ্ধা ছিল না। তবে সাহস ও অনুপ্রেরণা জোগাতে সারা জাতি তাঁদের সঙ্গে ছিল।

মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সমাজের সব স্তরের মানুষের মিথস্ক্রিয়ার অনেক চমকপ্রদ ও মর্মস্পর্শী ঘটনার জন্ম হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে। বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় এ দেশের মা-বোনদের অবদান ও আত্মত্যাগ যেমন বিস্ময়কর, তেমনি চিরস্মরণীয়। খবর আদান-প্রদান, শত্রুপক্ষের শক্তি ও অবস্থান জেনে আসা ইত্যাদি ধরনের অতি প্রয়োজনীয় কাজগুলো করেছে এ দেশের অনেক বীর শিশু। পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে-শুনে তাদের ছোট্ট প্রাণেও দেশপ্রেমের আগুন জ্বলেছিল। এক কথায় মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের বাংলাদেশ অনেক সংগ্রামের ফসল হলেও এ ফসলের রূপ-রস-গন্ধ ছিল একেবারেই ভিন্ন। পৃথিবী অবাক বিস্ময়ে দেখেছে এক নতুন বাংলাদেশকে। স্বতঃস্ফূর্ত দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ, সাহস, ঐক্য, সংগ্রাম ও আবেগের সমন্বয়ে তা ছিল যেমন বজ্রকঠোর, তেমনি মানবিক ও আত্মবিশ্বাসী। তাই তো দেশে অল্পসংখ্যক বিশ্বাসঘাতক এবং বিদেশে পাকিস্তানি নির্মম শত্রুর কিছু শক্তিশালী দোসর থাকলেও বাংলার মানুষের বিজয় ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি তারা।

শত্রুর বিরুদ্ধে কেবল সামরিক বিজয় নয়, মুক্তিযুদ্ধ আমাদের উপহার দিয়েছিল পুরো জাতির মধ্যে এক অভূতপূর্ব মানবিক বন্ধন। সেই বন্ধন থেকে সৃষ্ট অনেক মর্মস্পর্শী কাহিনী, অনেক হূদয়বিদারক ঘটনা, অনেক ভালোবাসার গাথা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ধারণ করে আছে, আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি, তাদের পবিত্র দায়িত্ব সেগুলোকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া। মুক্তিযুদ্ধের আসল তাত্পর্য তাহলেই যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, তাদের কাছে স্পষ্ট হবে।

এই বিজয়ের মাস এবার ঘটনাক্রমে অত্যন্ত তাত্পর্যপূর্ণ একটি নির্বাচনের মাসেও পরিণত হয়েছে। নির্বাচনে এবার অনেক ভোটার থাকবে যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, যাদের কাছে একাত্তরের সেই নয় মাসের তেমন কোনো প্রামাণ্যচিত্র নেই। তাদের চোখের সামনে মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরার জন্য কেবল রাজনৈতিক ইতিহাসই যথেষ্ট নয়, নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের তাত্পর্যময় মানবিক ঘটনাবলিকেও উপস্থাপন করা একান্ত দরদার। বিজয়ের মাসে কিছুটা হলেও সেই প্রবণতা আমরা দেখতে পাই। কিন্তু তা আরও ব্যাপকভাবে হওয়া দরকার। সব দেশপ্রেমিক নাগরিকেরই উচিত, যার যার সাধ্যমতো এ ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করা। বিশেষ করে শিল্পী, সাহিত্যিক এবং গণমাধ্যমকর্মীদের এ ক্ষেত্রে কাজ করার সুযোগ সবচেয়ে বেশি। বিজয়ের মাসেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। কাজেই তরুণ ভোটারদের সামনে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক চিত্রটি তুলে ধরার দায়িত্ব পালনের এটাই সময়। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অশুভ শক্তির উপদ্রব কমিয়ে আনার ক্ষেত্রেও তা সহায়ক হবে আশা করা যায়।

সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০০৮ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত