বিজ্ঞাপন
default-image

মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা টাঙ্গাইল শহরের আকুরটাকুর পাড়ায় ভাড়া বাসায় থাকতাম। আমরা সাত ভাই তিন বোনের মধ্যে সালাউদ্দিনের অবস্থান ছিল ছয়। তখন সে করটিয়া সরকারি সা’দত কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে একাদশ শ্রেণীর ছাত্র ছিল। স্কুল জীবন থেকেই ছিল ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই শহরের বাসায় অবস্থান করলেও সালাউদ্দিন নিয়মিত যোগাযোগ রাখত মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে। মে-জুন মাসের দিকে টাঙ্গাইলের পাহাড়ি এলাকায় কাদেরীয়া বাহিনী সংগঠিত হওয়ার পর সালাউদ্দিন কিছুদিনের জন্য নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। ১০-১৫ দিন পর বাসায় ফিরে আসে। পরে জানতে পারি তখন সে পাহাড়ি এলাকায় গিয়ে গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছে। জুন মাসের পর থেকেই শহরে অবস্থানরত সহকর্মী স্মৃতি, ছবুর, লোটনসহ সালাউদ্দিনরা বেশ কয়েকজন মিলে শহরে চোরাগোপ্তা হামলা শুরু করে।

পাকিস্তানি বাহিনীকে আতঙ্কে রাখতে তারা শহরের বিভিন্ন এলাকায় বিস্ফোরণ ঘটাত। তাদের তত্পরতার ফলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় সহযোগী রাজাকার-আলবদরদের শহরে স্বাভাবিক চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। জুন মাস থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সালাউদ্দিনদের এই তত্পরতা অব্যাহত ছিল। এদিকে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ভেদ করে কারা শহরে বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে তা জানার জন্য পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা তত্পর হয়ে ওঠে। নভেম্বরের শুরুতে সালাউদ্দিনের এক সহযোদ্ধা ধরা পড়ে যায়। তাকে অত্যাচার করে তার কাছ জেনে নেয় সালাউদ্দিনের নাম। তারপর একাত্তর সালের ১০ নভেম্বর রাত একটার দিকে আমাদের আকুরটাকুর পাড়ার বাসা ঘেরাও করে সেনাবাহিনী ও রাজাকাররা। তারা অস্ত্রের খোঁজে পুরো বাড়ি তল্লাশি চালাল। আমরা সবাই অনুনয়-বিনয় করলাম। আম্মা কান্নাকাটি করে হাতে-পায়ে ধরল। কিন্তু কিছুতেই কোনো কাজ হলো না। তারা সালাউদ্দিনকে আটক করে নিয়ে গেল। পরদিন আমরা জানতে পারলাম সালাউদ্দিনকে টাঙ্গাইল সার্কিট হাউসের সেনা ক্যাম্পে আটকে রাখা হয়েছে।

হয়েছে। আমাদের বাবা আইনউদ্দিন ছিলেন সরকারি এতিমখানার তত্ত্বাবধায়ক। রাজা নামের তার এক প্রাক্তন ছাত্র কাজ করত সার্কিট হাউসে। তার মাধ্যমে আমরা খবর পেতাম ধরে নেওয়ার পর থেকেই সালাউদ্দিনের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হতো। এদিকে আব্বা সালাউদ্দিনকে ছাড়ানোর জন্য বিভিন্ন লোকের কাছে ধরনা দিতেন। এক রাজাকার আব্বাকে বলেছিল, তিন হাজার টাকা দিলে সে ছাড়ানোর চেষ্টা করে দেখতে পারে। এর মধ্যে ২৫ নভেম্বর সকাল ১১টার দিকে আমাদের বাসায় এল আব্বার সেই প্রাক্তন ছাত্র রাজা। সে জানাল, আগের দিন রাত ১১টার দিকে সালাউদ্দিনকে সার্কিট হাউসের নির্যাতন কেন্দ্র থেকে জেলা সদরের পানির ট্যাঙ্কের পাশের বধ্যভূমিতে গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে মাটিচাপা দিয়েছে। আমরা লাশটা উদ্ধারের চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হই।

অনুলিখন: কামনাশীষ শেখর, টাঙ্গাইল

সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০১০ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত