বিজ্ঞাপন
default-image

৮ মে, ১৯৭১ সাল। বেলা প্রায় ১১টা। হঠাত্ গুলির শব্দ। এলাকার ফজলু মুন্সীর ছেলে লাল মিয়া কয়েকজন বিহারিকে নিয়ে হামলা চালায় ফরিদপুর সদরের কানাইপুর ইউনিয়নের জমিদারবাড়ী সিকদারবাড়ীতে। গুলির শব্দ শুনে অনেকে পেছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে পালিয়ে যায়। আমরা ছোট-বড়, নারী-শিশু-যুবক মিলিয়ে ২০ জন সিকদারবাড়ীর মধ্যে ধরা পড়ে যাই বিহারিদের হাতে।

দুপুর দুইটার দিকে বিহারিরা আমাদের জমিদারবাড়ীর ভেতরে আমার এক দাদু বটা সিকদারের বাড়ির উঠানে জড়ো করে। গণহত্যার আয়োজন চলে। বিহারিরা সিদ্ধান্ত নেয় নারী ও শিশুদের বাদ দিয়ে সব পুরুষ সদস্যকে হত্যা করার। কিন্তু বাদ সাধেন আমার এক কাকা ধোপাডাঙ্গা চানপুর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দীনেশ সিকদার। লাল মিয়া তাঁরই ছাত্র। কাকা শর্ত জুড়ে দেন। হত্যা করতে হলে নারী-শিশু বাদ দেওয়া যাবে না। সবাইকেই একসঙ্গে হত্যা করতে হবে। শিক্ষক কাকার আবেদন বিনা বাক্য ব্যয়ে বাধ্য ছাত্রের মতো মেনে নেয় লাল মিয়া।

উঠানে আমাদের দুই সারিতে দাঁড় করানো হয়। আমরা যারা ছোট ছিলাম, বড়রা আমাদের বুক বরাবর উঁচু করে ধরেন। যাতে গুলি সবার বুকে একসঙ্গে লাগে। উদ্ধত বন্দুকের সামনে কেউ কান্নাকাটি করেননি। কিংবা জীবন বাঁচানোর জন্য জানাননি আকুতি-মিনতি। আমার মনে হয়েছিল, আমাদের সামনে রাইফেল নয়, যেন ধরা হয়েছে ক্যামেরা। আমরা সবাই ভাবলেশহীনভাবে দাঁড়িয়ে আছি, ছবি তোলার জন্য।

এভাবে পাঁচ-ছয় মিনিট কেটে যায়। এমন সময় সেখানে এসে আপত্তি জানান রুস্তম খাঁ নামের এক ব্যক্তি। নারী ও শিশু হত্যা নাজায়েজ। তিনি ফতোয়া দেন, ‘নারী ও শিশুদের হত্যা করা যাবে না।’

এই ফতোয়ার পর আমাকেসহ সব শিশু ও নারীদের লাইন থেকে বের করে দেওয়া হয়। পুরুষ সদস্যদের ধাক্কা মেরে মেরে উঠানের এক কোণে তুলসী গাছতলায় নিয়ে যাওয়া হয়। নারী-শিশুসহ আমাকে বসিয়ে রাখা হয় বটা সিকদারের রান্নাঘরের বারান্দায়।

নারী ও শিশুদের মধ্যে সেখানে আমরা প্রায় ১২-১৪ জন ছিলাম। ছিলেন আমার ঠাকুরমা নির্মলা বালা সিকদার, আমার মা দুর্গা রানী সিকদার, আমার ছোট দুই ভাই সুবীর সিকদার ও পীযূষ সিকদার এবং দুই বোন দেবী সিকদার ও দীপ্তি সিকদার। ছোট ভাই পীযূষের বয়স তখন ছিল মাত্র ছয় মাস।

সলিম শেখ নামের এক গাছি হত্যাকাণ্ড শুরু করে তার হাতের বড় একটি রামদা দিয়ে। প্রথমে কোপ মারা হয় আমার কাকা দীনেশ সিকদারকে। তিনি কোপ খেয়ে ‘মা আমি গেলাম’ বলে বারান্দায় বসা আমার গায়ের ওপর পড়ে যান। আমার পরনের জামা রক্তে ভিজে যায়। পরে তাকে টেনেহিঁচড়ে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। কাকা যেতে যেতে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘মনে রাখিস, দেশ স্বাধীন হবে।’

এ দৃশ্য দেখে আমরা শিশু ও নারীরা যারা বারান্দায় বসে ছিলাম, তারা কান্না শুরু করলাম। কিন্তু দুই বিহারি বেয়নেট খুলে আমাদের চোখের সামনে তাক করে ধরে থাকে। একবার বেয়নেট ধরে আমার চোখে, তারপর মায়ের চোখে, আবার ঘুরিয়ে ঠাকুরমার চোখে, অন্য ভাইবোনদের চোখে। আমাদের কান্না থেমে যায়।

রামদা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করার পাশাপাশি রড দিয়ে আঘাত করা, ছুরি ঢুকিয়ে দেওয়া, যে যেভাবে পেরেছে আমাদের ছয় স্বজনকে হত্যা করেছে। হত্যাযজ্ঞ যখন ঘটছিল, তখন এলাকার তিন-চার শ লোক জড়ো হয়ে সে দৃশ্য দেখতে থাকে। সবাই যেন ভাবলেশহীন, নির্লিপ্ত। প্রায় আধঘণ্টা ধরে চলে এ হত্যাযজ্ঞ। সবশেষে সিকদারবাড়ীর একটি ঘরে লুকিয়ে থাকা সিকদারবাড়ীর ওই সময়ের মূল অভিভাবক আমার তালুই অজিত সিকদারকে (৬৫) ধরে আনা হয়। তাঁকে প্রথমে সবার লাশ দেখানো হয়। রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত লাশ দেখে তিনি আর্তনাদ করে উঠলে এক বিহারি তাঁকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়। তাঁর দুই হাত ও দুই পা ধরে রাখে দুই বিহারি। এরপর অজিত সিকদারের গলায় চালানো হয় ছুরি। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে। গাছি সলিম শেখ সে রক্ত পান করে। এই বীভত্স দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে আমরা যারা বারান্দায় বসে ছিলাম, সমস্বরে অর্তনাদ করে উঠি। পরে আমাদের সবাইকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে অজিত সিকদারের ঘরে আটকে রাখা হয়। এরপর চলে লুটতরাজ।

সেদিন আমাদের সামনে হত্যা করা হয় কাকা দীনেশ সিকদার, তাঁর ভাই জীবেশ সিকদার, কাকা দুলাল চন্দ্র সিকদার, তাঁর ভাই বিভূতিভূষণ সিকদার, আমার মামা আনন্দ কুমার পোদ্দার ও তালুই অজিত সিকদারকে।

সারা রাত, পরের দিন সকালেও আমাদের আটকে রাখা হয়। আশপাশের কেউ কেউ খাবার নিয়ে এসেছিল। কিন্তু তাদের আমাদের ধারেকাছেও ঘেঁষতে দেওয়া হয়নি।

আমার কাকা দীনেশ সিকদার সে সময় ধোপাডাঙ্গা চানপুর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। ওই স্কুলের ব্যবস্থাপান কমিটির সভাপতি আবদুর রাজ্জাক আমাদের খোঁজ নিতে দফাদারকে পাঠান। ৯ মে সন্ধ্যার দিকে আমরা বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাই। ঘর থেকে বের হয়ে ওই তুলসীতলায় আমরা কোনো মৃতদেহ দেখতে পাইনি। শুধু দেখেছি রক্তের ধারা, যা ঘিরে রেখেছে লাখ লাখ পিঁপড়া। এলাকাবাসী আমাদের জানিয়েছে, মৃতদেহগুলো জমিদারবাড়ীর কুয়োর মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।

আজ আমি আর আমার বাবার বধ্যভূমির সন্ধান করি না। ৫৫ হাজার ৫৯৮ বর্গকিলোমিটারের এ স্বাধীন বাংলাদেশের সব জমিই যেন আমার বাবার বধ্যভূমি। আমি বাংলাদেশের মানচিত্রের মধ্যেই আমার বাবাকে খুঁজে পাই।

অনুলিখন: পান্না বালা, ফরিদপুর