বিজ্ঞাপন
default-image

পঞ্চগড়ের তালমাপোরের টগবগে যুবক মতি, সাবেক মুজাহিদ সদস্য। রাজাকারে ভর্তি হওয়ার ডাক ও প্রলোভন এসেছিল, যায়নি। কেনো যাবে? সে তো জয় বাংলার লোক। আমাদের বিশ্বস্ত গাইড। রাতের আঁধারে ছেলেদের নিয়ে তার বাড়ির সামনে হাজির হলেই সে বের হয়ে আসত। মুখে সেই পরিচিত হাসি মাখিয়ে বলত, ‘মুই রেডি হয়্যা বসি আছো গে, কুনঠে যাবা হবে কহেন, কী নিবার হবে দ্যান।’ বলে সে এক্সপ্লোসিভ ও মাইনের বোঝা কাঁধে চাপিয়ে নিত। বলত, চলেন, এদিকটা আজ নিরাপদ, খান আসেনি।

এভাবে মতি প্রায় রাতেই আমাদের সঙ্গী হতো। তার বিশ্বাস, অপারেশন সফল হলেই জয় বাংলা কায়েম হবে। জয় বাংলা না হলে তার কী হবে? মাতবরের কাছে তার বাঁধা দেওয়া জমি উদ্ধার হবে না, হালের বলদ হবে না, ভেঙে পড়া ছনের ঘরের ছাউনি হবে না। প্রায় নিঃস্ব মতিকে আবার হয়তো ফিরে যেতে হবে তার পিতৃপুরুষের ফেলে আসা কুমিল্লা জেলায়। তাই মতি স্বাধীনতা চায়, খুব আন্তরিকভাবে জয় বাংলাকে পেতে চায়।

স্বাধীনতার বেশ কয়েক বছর পর মতির সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সেই খেটে খাওয়া মজুর মতি আজও তেমনই আছে। জয় বাংলা ঠিকই এসেছে। গামছায় চোখের পানি মুছতে মুছতে মতি বলে, আমার কিছু না হোক, জয় বাংলা তো হয়েছে।

করতোয়াপারের (বোদা, পঞ্চগড়) হাসান মাঝি ছিল ভারতীয় শরণার্থীশিবিরে। তার বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের হাইডআউট, খবর শুনেই সে থেকে ছুটে এসেছে। রাতে সে তার নৌকা নিয়ে বসে থাকে খেয়াপারে। অপারেশনে যাওয়ার সময় মুক্তিযোদ্ধাদের পার করে দেয়। আবার তারা ফিরে আসবে। রাতভর জেগে নৌকায় বসে থাকে।

এক রাতে মারেয়ায় ধুন্ধুমার যুদ্ধ শেষে ভোরে ভোরে আমরা শ্রান্ত-বিধ্বস্ত অবস্থায় ফিরছি। হাসান মাঝি তার খেয়ানৌকা নিয়ে বসে আছে। খুব আপন মনে হয় তাকে। উষ্ণ আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে সে। তখন মনে হয়, হাসানেরা আছে বলেই আমরা যুদ্ধ করছি। খেয়ানৌকার মাঝি হাসানের জন্যও তো স্বাধীনতা প্রয়োজন। তার বিশ্বাস, দেশ স্বাধীন হলে ওর সব দুঃখ-কষ্ট দূর হবে। করতোয়াপারের হাসান মাঝির দুচোখে তাই গভীর স্বপ্নাবেশ। সে জন্যই এ যুদ্ধ। এ যুদ্ধে সেও একজন সৈনিক। যুদ্ধের পরও হাসান তার খেয়ানৌকা চালিয়েছে। এখন তার ছেলে চালায়। অশীতিপর বৃদ্ধ জরাগ্রস্ত হাসান মাঝি এখনো ঘোরের মধ্যে তার স্বপ্নের জয় বাংলাকে খোঁজে। মুখে বলে, ‘কই কিছুই তো হইল না গে বা।’

কালা হাজি (ভিতরগড়ের) মকতুকে দিয়ে দেন মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে গাইড হিসেবে। সে বলে, ‘লন, যাইগা।’ কালো শরীর যেন গ্রানাইট পাথরের তৈরি। অন্ধকারে তার সাদা দাঁত চকচক করে ওঠে। বলি, তুমি আমাদের শালমারা ব্রিজ পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারবে? অন্ধকারে দাঁতের ঝিলিক দেওয়া হাসি দিয়ে সে বলে, ‘পারমু, এই এলাকা আমার কাছে ঝকঝকা কাচের মতো পরিষ্কার।’

পথ ছেড়ে ধানখেত, তারপর জলাভূমি। ভূতের মতো মকতু সামনে এগোয়, যেন দৌড়ে চলে, তার সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে আমরা হাঁপিয়ে উঠি। বলি, আর কত দূর মকতু? এ কাছেই, বলে মকতু উদ্ভ্রান্তের মতো হাঁটিয়ে নিয়ে যায়। রাতের আঁধারে আমরা কোনো দিশদিশা পাই না। শত্রু এলাকায় এসে দিগ্ভ্রান্ত হলেই বিপদ। আর মকতু যদি পাকিস্তানি চর হয়, তাহলে আমাদের কয়েকজন যুবককে সে নিয়ে তুলবে একেবারে শত্রু পাকিস্তানি ঘাঁটিতে। কিন্তু এখন এই মুহূর্তে ওকে বিশ্বাস করা ছাড়া উপায় নেই। খেতবাড়ি, জলাভূমি, আলপথ, ধানখেত, ঝোপঝাড়, জঙ্গলের ভেতর দিয়ে মকতু আমাদের নিয়ে হাজির করে শালমারা ব্রিজের মুখে। পাকিস্তানি সেনাদের কোনো অবস্থান আছে কি না নিজেই সে দেখে আসে আগ বাড়িয়ে। না, ওরা নেই। আমরা শালমারা ব্রিজের রেকির কাজ সেরে নিই।

এবার মকতু বলে, চলেন, মুসলিম লীগ শান্তি কমিটির সদস্য শামসু মেম্বারকে ঠান্ডা করে দিয়ে আসি। আবার তাকে আগের মতো অন্ধ অনুসরণ। পথ ছেড়ে অপথ, মহারাজার দীঘিরপাড় ঘেঁষে পাটখেত, ধানখেত, বুকসমান-কোমরসমান পানি পেরিয়ে শামসু মেম্বারের বাড়ি। ধমাধম গ্রেনেডের বিস্ফোরণ। প্রথম দিনের সফল অপারেশনের গাইড মকতু মিয়া এর পর হয়ে যায় আমাদের স্থায়ী গাইড। তালমা ব্রিজে, জগদল হাটে, চৈতন্যপাড়া ব্রিজে—এমন বহু অপারেশনে আমাদের পথ দেখায় সে। কখনো তার কাঁধে কোদাল, কখনো কাঁধে বিস্ফোরকের বোঝা, কখনো গুলির বাক্স। প্রায় প্রতিটি যুদ্ধে মকতু আমাদের ছায়াসঙ্গী, বিশ্বস্ত বন্ধু, গাইড। কথা সে খুব কম বলে। যখন বলে, বলে একদম খাঁটি কথা। তাকে বলি, প্রতি রাতে তুমি আমাদের সঙ্গী হও কেন? জবাবে সে বলে, ‘কেন হমু না, জয় বাংলা খালি তোমারলাক লাগিবে, হামার লাগিবে নাই?’ দিনমজুর, কিষান, প্রায় ভেঙে পড়া ছনের ঘর নিয়ে সংসারযুদ্ধে টিকে থাকা মকতু মিয়া স্বপ্ন দেখে, মুক্তিদের সঙ্গে থাকলে, প্রতিটি যুদ্ধে থাকলে জয় বাংলা ত্বরান্বিত হবে। সংসারযুদ্ধে ক্লান্ত মকতু মিয়ার যে জয় বাংলার খুবই দরকার। জয় বাংলা হলে তার সব অভাব ঘুচে যাবে। শান্তি ফিরে আসবে তার সংসারে। মকতু যুদ্ধের পর কিছুদিন হাটে-বাজারে ওষুধ ফেরি করেছে। এখন শনির আখড়ায় ভিক্ষা করে। চোখে দেখে না, প্রায় অন্ধই হয়ে গেছে।

জিপগাড়িটি আটকাতে হবে

প্রতিদিন ভোর ভোর সময়ে একটি জিপগাড়ি পঞ্চগড় থেকে অমরখানা ঘাঁটিতে যায়। তাতে থাকে রেশন-সামগ্রী, গোলাবারুদ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। রাতের যুদ্ধে আহত-নিহত সৈনিকদের নিয়ে জিপটি আবার ফিরে যায় পঞ্চগড় গ্যারিসনে। গাড়িটা ধরতে হবে, এই মিশন নিয়ে আমরা হাজির হয়েছি চৈতন্যপাড়ায় পাকা সড়কের পাশে। জগদলহাট, অমরখানা পাকিস্তানি ঘাঁটির মাঝামাঝি জায়গায় এটির অবস্থান। শত্রুপুরীর মাঝামাঝি, খুবই বিপজ্জনক এলাকা। চিহ্নিত হয়ে গেলে পুরো দলই একেবারে শেষ হয়ে যাবে। উপায় নেই, জিপগাড়িটি ধরতে হলে এমন কৌশলগত সুবিধাজনক জায়গা ধারেকাছে আর কোথাও নেই।

সন্ধ্যায় মুষলধারে বৃষ্টির আবরণ নিয়ে আমরা এখানে পৌঁছেছি। দলকে তিন ভাগে বিন্যাস করে পাকা সড়কের ধারে পজিশন নিয়েছি পরিত্যক্ত বাড়িঘরগুলোর পেছনে বাড়ন্ত কচুগাছ, বুনো ঘাস আর ঝোপঝাড়ের ভেতর। কাছেই একটা কাঁচা ল্যাট্রিন। বর্ষার পানিতে ময়লা ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। দুর্গন্ধে নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে আসতে চায়। উপায় নেই, এ অবস্থান ছাড়া যাবে না। সকালে পাকিস্তানি সেনাদের জিপগাড়িটি আসবে, সেটা আটক করতে হবে। বৃষ্টির বেগ বেড়ে চলে, মনে হয় আকাশ থেকে বালতি বালতি পানি ঢালছে কেউ। সারা শরীর ভিজে চলেছে, কাদাপানিতে সবকিছু সয়লাব। শরীরজুড়ে হিম ঠান্ডা, এর মধ্যে দাঁতে দাঁত চেপে গাড়ি ধরার লক্ষ্যটা সামনে রেখে অদম্য জেদ নিয়ে সবাই মিলে রাইফেল, এলএমজি তাক করে শুয়ে থাকি।

একসময় ভোর হয়, পেছনে খসখসে আওয়াজ। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসে এক লোক। মধ্যবয়সী, হালকা-পাতলা গড়নের মানুষ। বলে, ‘আমার নাম হজরত আলী, খানসেনাদের অত্যাচারে বাড়িঘর ছাড়ি দিছি, আপনাদের খবর পেয়ে আসলাম। কহেন কী করিবা হবে?’ বলি, ছেলেদের জন্য কিছু খাবার জোগাড় করতে পারবেন? ‘বাড়িতে তো পরিবার-পরিজন কেহ নাই, দেখি কী করিবা পারি।’ বলে হজরত আলী চলে যায়। কিছুক্ষণ পর সে গামছায় করে সের খানেক চাল ভাজা নিয়ে আসে, সঙ্গে লবণ। সেই চাল ভাজা সবাইকে মুঠি মুঠি করে দেওয়া হয়। হজরত আলীকে বলি, এই বিপদের মধ্যে আপনি কষ্ট করলেন? ‘কষ্ট আর কী, তুমরা যুদ্ধ করেছেন, জয় বাংলা কী হামার লাগিবে নাই।’ ওর উত্তর। তাই তো হজরতেরও জয় বাংলা লাগবে। স্বাধীনতা লাগবে। জানি না, এই অপারেশন শেষে আমরা চলে গেলে হজরত আর তার বাড়িঘরের কী হাল করবে পাকিস্তানি হায়েনার পাল। কিন্তু তাতে কী? এই যুদ্ধের একজন শরিকদার হয়ে সে থেকে যায় আমাদের সঙ্গে।

অপেক্ষার পালা শেষ হয়। প্রথমে ভোঁ শব্দ, তারপর গাড়ি। সামনের একরামুলের দল ফায়ার ওপেন করে, সেই সঙ্গে পেছনে সামসুদ্দিনও। গাড়ি আটকে যায়। ‘চার্জ’, বলে সবাইকে নিয়ে গুলি ছুড়তে ছুড়তে এগিয়ে যাই। পাকিস্তানি সেনারা পাল্টা জবাব দেওয়ার চেষ্টা করে। ধমাধম গ্রেনেড ছুটে যায় গাড়ির দিকে। বিস্ফোরণের পর বিস্ফোরণ ওদের থামিয়ে দেয়। গাড়ি আমাদের দখলে এসে যায়। ড্রাইভারসহ তিনজন খানসেনা মৃত, একজন আহত অবস্থায় পালিয়ে গেছে। ওদের হাতিয়ারপত্র, গোলাবারুদ আমাদের দখলে আসে। এরপর চার্জ লাগিয়ে আমরা সরে পড়ি। প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটে। গাড়ি উড়ে যায়। হজরত আলী হাততালি দিয়ে বলে ওঠে, ‘শাবাশ বাবাজিরা! এবার হামার জয় বাংলা কে আটকাতে পারে দেখি!’ তাকে সাবধানে থাকতে বলে ক্লান্ত পায়ে আমরা নিজেদের আশ্রয়ে ফিরে আসি। একেবারে বাঘের গুহার মুখে বসে হজরত আলীর সেদিনের সাহস আর সাহায্যের কথা ভোলা যায় না। দেশ স্বাধীন হওয়ার বেশ কিছুদিন পর হজরত আলীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। কেমন বুড়িয়ে গেছে, বাড়িঘরের জীর্ণ দশা। না, সে আমাদের কাছে কিছু চায়নি, শুধু বলেছে, ‘আসবেন মাঝেমধ্যে, সেদিন সবাই কষ্ট করেছি বলেই না দেশ আজ স্বাধীন।’

কহেন তো জয়বাংলা কবে হবে?

এ জেলারই গুয়াবাড়ির জোনাব আলীকে খুব দরকার। আজকের রাতের অপারেশনে সে আমাদের গাইড। তার বাবা বললেন, ‘সে তো বাড়িতে নাই।’ কোথায় পাওয়া যাবে, জিজ্ঞাসার উত্তরে তিনি বলেন, ‘খানে গো ভয়ে কোথায় থাকে, লুকাইয়া লুকাইয়া বেড়ায়, থাকনের ঠিক নাই, খাওনের ঠিক নাই, একেবারে শিয়াল-কুত্তার জীবনযাপন এখন জোনাব আলীর।’ চারদিকের অবস্থা ভালো নয়। পাকিস্তানি সেনারা নিয়মিত টহল দিচ্ছে। একে ধরে, ওকে মারে, সন্দেহভাজনদের ধরে নিয়ে যায়, তাদের মধ্যে কেউ ফেরে, কেউ ফেরে না। হাঁস-মুরগি, গরু-বকরি নিয়ে যায়। মেয়েদের খোঁজে। কী দিনকাল! অন্যদিকে অভাবের করাল গ্রাস। গৃহস্থ পরিবার, বাড়িঘর ফেলে ভারতে শরণার্থীও হয়ে যাওয়া যায় না। জোনাব আলী মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাজ করে বলে সে শত্রুদের কাছে চিহ্নিত হয়ে পড়েছে, ধরা পড়লেই বিপদ। এদিকে অভাবের করাল গ্রাস। হাটবাজার বন্ধ, জরুরি ক্রয়-বিক্রয় করতে হলে যেতে হয় শত্রুকবলিত এলাকাগুলোয়। জোনাব আলীও বাড়িতে থেকে সংসার দেখাশোনা করতে পারে না। ভেঙে পড়া মানুষের মতো জোনাব আলীর বাবা দুঃখের পাঁচালি গেয়ে যান। হতাশা ভরা কণ্ঠে তিনি জানতে চান, ‘বাবারা, তুমরা তো যুদ্ধ করেছেন, কহেন দি, কবে জয় বাংলা হবে?’

কবে জয় বাংলা হবে, সে তো আমরাও জানি না; আদৌ হবে কি না, তাও বলতে পারি না। সীমিত শক্তি আর অস্ত্রবল নিয়ে আমাদের গেরিলাযুদ্ধ। রাতের অন্ধকারে ভূতের মতো চলাফেরা। আচম্বিতে শত্রুঘাঁটিতে আঘাত করে পালিয়ে আসা, যেটাকে বলে হিট অ্যান্ড রান। এই করে একটি নিয়মিত দুর্ধর্ষ শত্রুসেনা দলকে পরাজিত করা সে তো অলীক স্বপ্নের মতো। সময় লাগবে, অনেক সময়, শক্তি আর অস্ত্রবল লাগবে অনেক বেশি। এখন চলছে শত্রুকে পেছন থেকে আঘাতের পর আঘাত করে তাদের দুর্বল করে দেওয়ার কৌশল। তারপর একদিন সম্মিলিতভাবে চূড়ান্ত হানা হবে। তখন তাদের সব প্রতিরোধ হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে। তার জন্য সময় আর প্রস্তুতি নিতে হবে। কিন্তু অসহায়, ভেঙে পড়া মানুষ এখনই জয় বাংলা চায়।

তাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। বাইরের চত্বরে বসে আমরা বৃদ্ধের কথা শুনি আর পরিশ্রান্ত শরীরকে বিশ্রাম দিই। এমন সময় একটি ছেলে এসে বলে, ‘আপনাকে ভাবি ডাকে।’ ভাবি মানে? জোনাব আলী ভাইয়ের স্ত্রী। ছেলেটার সঙ্গে আন্দরমহলে যাই। এঘর-ওঘরের পাশ দিয়ে সে নিয়ে গিয়ে হাজির হয় একেবারে রান্নাঘরে। কম বয়সী এক রমণী, আগুনের মতো চেহারা তার, চুলোর আলোয় বড় স্পষ্ট করে দেখা যায় তার রূপের আভা। কিছুটা ধাক্কা খেতে হয়। মনে হয়, কেন জোনাব আলী মহিলাকে অরক্ষিত অবস্থায় বাড়িতে রেখেছে? খানসেনারা জানতে পারলে যেকোনো সময় বিপদ ঘটবে। মহিলা বলেন, ‘চা-নাশতা হচ্ছে, খেয়ে যাবেন।’ বলি, আবার চা-নাশতা কেন? এমনিতেই তো আপনাদের দিনকাল ভালো যাচ্ছে না। ‘তাতে কী হইছে, আপনারা ক্লান্ত হয়ে এসেছেন।’ বলি, এ জন্যই ডেকেছিলেন? ‘না, তেনার খবর আছে। মানুষটার শান্তি নাই, সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকে, খালি আমাকেই জানাইয়া যায় তার ঠিকানা, মুক্তিরা আইলে আমি যেন তাগো জানাইতে পারি।’ কী বলে মহিলা? কিছুটা স্তম্ভিত হয়ে যাই। আমাদের অন্তঃপুরের মেয়েরা কীভাবে নিজেদের তৈরি করেছে! আসার সময় মহিলা জোনাব আলীর ঠিকানা জানায় আর বলেন, ‘আমাদের খুব তাড়াতাড়ি জয় বাংলা লাগবে, এটা যেমন করি হোক আপনারা করি দ্যান।’

ফিরে আসি দহলিজে। চা-নাশতা আসে। সুস্বাদু চিঁড়া ভাজা আর গুড়ের চা। খেতে খেতে ভাবি, ঘরের ভেতরে-বাইরে নারী-পুরুষ তৈরি হচ্ছে। এভাবে চললে জয় বাংলা হতে কি আর বেশি দিন লাগবে? লাগবে না। তিন যুগ পর মহিলার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সংসারে দারিদ্র্যের আাাঘাত, চেহারা-শরীর ভেঙে গেছে। কিন্তু সেদিনের মতোই বলে ওঠেন, জয় বাংলা তো হলো, কিন্তু এত দিন পর দেখতে এলেন? তার কথার কোনো উত্তর দেওয়া যায় না।

ধনা দাস লোকজন নিয়ে রাস্তার মুখে পাহারা বসিয়েছে। সদর থানার হিন্দুপাড়া বারাথান। এ এলাকায় একটিই হিন্দুপাড়া। এ জন্য পাকিস্তানি সেনাদের অন্যতম টার্গেট এটা। পরিবার-পরিজন সব ভারতে, শরণার্থীশিবিরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ধনা দাসের নেতৃত্বে কয়েকজন পুরুষ রয়ে গেছে পাহারায়। বাড়িঘর পরিত্যক্ত অবস্থায় ছেড়ে গেলে কিছুই থাকবে না, দুই দিনেই সব লুটপাট করে নিয়ে যাবে সুযোগসন্ধানী মানুষ। বর্বর পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল বর্ডার পর্যন্ত এসে গেছে। যেকোনো সময় বারাথান গ্রাম আক্রান্ত হতে পারে। পাশাপাশি শুরু হয়েছে ডাকাতের উত্পাত। জনজীবনে শান্তি-স্বস্তি কিছুই নেই। হিন্দুপাড়ায় শঙ্কা আর ভয় অনেক বেশি।

মধ্যরাতে মুক্তিযোদ্ধাদের দলটিকে ধনা দাস তার দলবল নিয়ে আটকে দেয়। হাতে দা, লাঠি, তীর-ধনুক, বল্লমজাতীয় অস্ত্র। সেই অস্ত্র হাতে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের চ্যালেঞ্জ করে বসে। মুক্তিযোদ্ধারা হাতিয়ার হাতে খটাখাট তৈরি। না, গোলাগুলি রক্তপাত হয় না। মুক্তিফৌজ পরিচয় পেয়ে ধনা দাস তাদের সাদরে গ্রহণ করে এবং বাড়িতে নিয়ে যায়। সেখানেই গড়ে ওঠে মুক্তিযোদ্ধাদের হাইডআউট। ধনা দাস সব সময় আশপাশে থাকে, হাতিয়ারপত্র দেখে। শত কৌতূহল তার চোখে-মুখে। মুক্তিরা আসায় তার মনে হয়, জয় বাংলা বুঝি হয়েই গেল। নির্দিষ্ট অপারেশন শেষে বারাথান গ্রাম ছেড়ে আসার সময় ধরা দাসের কণ্ঠে হাহাকার, ‘তুমরা চলে যাছেন, তাইলে আমাদের জয় বাংলা কি হবে না?’ স্বাধীন দেশে ধনা দাসের সঙ্গে দেখা হলে ঝলমলে কণ্ঠে সে বলেছিল, ‘জয় বাংলা তো হইছে, স্বাধীন দ্যাশ, এখন তো আমাদের সব দুঃখ-কষ্টের শেষ হবে, কোনো অন্যায়-অবিচার আর থাকবে না। কী কহেন?’ ধনা দাসের বিশ্বাস ভাঙতে ইচ্ছে করে না। বলি, তা-ই হবে ধনা দাস।

জালিমদের হাত থেকে বাঁচান

সর্দারপাড়ার হালিম মাস্টার যুদ্ধের আগে কাউন্সিল মুসলিম লীগের সমর্থক ছিলেন। যুদ্ধ শুরু হলো। পাকিস্তানি সেনাদের বর্বরতা-নৃশংসতা দেখে তিনি জয় বাংলার পক্ষে চলে আসেন। যোগাযোগ করেন মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে। তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া যুবক ছেলেদের বাঁচাতে হবে। তাঁর গ্রামকে রক্ষা করতে হবে। পাকিস্তানি সেনাদের নিয়মিত টহল বন্ধ করতে হবে। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক আবদুল হালিম তাই বড় ধরনের ঝুঁকি নেন। আমাদের সঙ্গে দেখা করে বলেন, ‘বাবা, ওই জালিমদের হাত থেকে বাঁচান। আপনারা আমাদের গ্রাম আক্রমণ করেন। আমার বাড়িঘর উড়িয়ে দেন, ছেলেদের নিয়ে যান। আমরা পাকিস্তানি সেনাদের বলতে পারব, মুক্তিযোদ্ধারা এসে হামলা করে গেছে আপনাদের সমর্থন দেওয়ার কারণে।’ ওরা ভয় পেয়ে যাবে, আর আসবে না এদিকে। সেভাবেই নকল যুদ্ধ সাজানো হয়, কিন্তু সত্যি-সত্যি মাস্টার সাহেবের দো-মহলা বাড়ি চার্জ লাগিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয়। ছেলেরা চলে আসে আমাদের দলে। হালিম মাস্টার সেভাবেই গল্প ফাঁদেন পাকিস্তানি সেনাদের কাছে। ওরা আর সর্দারপাড়ার পথ মাড়ায় না। হালিম মাস্টার এভাবেই আমাদের সাহায্য করেন বিস্তীর্ণ একটা জনপদ মুক্ত রাখতে। যুদ্ধের পর হালিম মাস্টার তাঁর বাড়িঘর ঠিক করতে পারেননি। এ নিয়ে তাঁর হতাশা নেই। বলেন, জালিমদের হাত থেকে তো দেশটা রক্ষা পেয়েছে।

পঞ্চগড় সদরের পানিমাছ শত্রুঘাঁটি আক্রমণ করা হবে। রাজ্জাক মাস্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলো। তাঁর গ্রাম পার হলেই শত্রুর শক্ত ঘাঁটি পানিমাছ। সেখানে যেতে হলে স্থানীয় মানুষের সাহায্য প্রয়োজন। রাজ্জাক মাস্টার সেই মানুষ। এক আঁধারকালো রাতে তিনি শত্রুঘাঁটির কাছাকাছি এক কৌশলগত অবস্থানে আমাদের পৌঁছে দেন। মধ্যরাতের শুরু হলো ভয়াবহ যুদ্ধ। শেষ রাতে আমরা ফল ব্যাক করি। পরদিনই পাকিস্তানি সেনারা এসে রাজ্জাক মাস্টারের গ্রামটা জ্বালিয়ে দেয়। পরিবার-পরিজন নিয়ে রাজ্জাক মাস্টারসহ অন্যরা আশ্রয় নেন ভারতের বেরুবাড়ী শরণার্থী ক্যাম্পে। একদিন দেখা হয়ে যায় তাঁর সঙ্গে বেরুবাড়ী বাজারে। কেমন শীর্ণ মলিন হয়ে গেছেন, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। নিজেদের কেমন অপরাধী লাগে তাঁর সামনে। মনে হয়, আমরা পানিমাছ ডিফেন্স আক্রমণ না করলে পাকিস্তানি বাহিনী প্রতিহিংসার বশে এঁদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিত না। শরণার্থী হয়ে ভিন দেশে এই হীনম্মন্যতার জীবন যাপন করতে হতো না তাদের। কিন্তু অবাক হয়ে শুনতে হয়, ‘আমাদের ঘরবাড়ি গেছে তো কী হয়েছে, ওদের তো হটানো গেছে। আবার যদি ওরা আসে পানিমাছে, আবার যাব, ব্যাটাদের খতম করে দিয়ে আসব।’ মনে মনে বলি, এই রাজ্জাক মাস্টাররা আছেন বলেই তো আমরা যুদ্ধ করছি। তাঁর জয় বাংলা প্রয়োজন। জয় বাংলার নাগাল তাঁকে যে করেই হোক পেতে হবে।

পালান এই দিক দিয়া

পিন্টুসহ ১০ জন যুদ্ধ শেষে ঝুম বৃষ্টির মধ্যে সদর থানার ভিতরগড়ে মতিনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। মতিন ওর বউ-বাচ্চা সরিয়ে নিয়ে শোবার ঘরটা পিন্টুদের জন্য ছেড়ে দিয়েছে। গভীর ঘুমে নিমগ্ন পিন্টুদের ঘুম ভেঙে যায় ধাক্কাধাক্কিতে। মতিনের বাবা বলেন, ‘সর্বনাশ হয়েছে, খানসেনারা বাড়ি ঘেরাও করেছে, এক্ষুনি ভেতরে ঢুকে পড়বে, আপনারা পালান।’ পিন্টুরা কিছু বুঝে উঠতে পারে না—কী করবে, কোন দিকে যাবে। এমন সময় মতিনের মা আর বউ এসে তাঁদের শরীরে শাড়ি পেঁচিয়ে দিয়ে যেন ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে যান। পাতকুয়ার পাশ দিয়ে পেছনের আখখেতে ঢুকিয়ে দিয়ে বলেন, পালান এই দিক দিয়ে। পাকিস্তানি সেনারা পিন্টুদের খুঁজে পায় না, গুলি করে মারে মতিনের দুই ভাইকে, পুরো বাড়িতে আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয়।

মুক্তিযুদ্ধ মানে সাধারণ মানুষের মুখ, তাদের স্বতঃস্ফূর্ত সম্পৃক্ততা। জনযুদ্ধের স্বরূপ তো এমনই। জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। কত মানুষ এভাবে এগিয়ে এসেছে সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে। প্রবল ঘৃণা ছিল তাদের পাকিস্তানি সেনাদের প্রতি, যারা দেশটা জবরদখল করে অত্যাচারে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছিল। পরাভূত করে রাখছিল জয় বাংলার চির লালিত স্বপ্ন। ফলে সুযোগ পেলেই মানুষ এগিয়ে এসেছে, কি পুরুষ কি নারী। তাদের তেমন চাওয়া-পাওয়া ছিল না। ছিল আশাজাগানিয়া স্বপ্ন। দেশটা স্বাধীন হবে, স্বাধীন দেশে মুক্ত মানুষ হয়ে তারা ইচ্ছাখুশিমতো বাস করবে। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা এত বেশি ছিল, যা কোনো দিনই বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। এখানে মাত্র কয়েকটি ঘটনা বিধৃত করে জনসম্পৃক্ততার গভীরতা বোঝানোর চেষ্টা হয়েছে। এমন হাজারো ঘটনা রয়েছে দেশজুড়ে।

এখন কেমন আছেন তাঁরা

কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী থেকে মুক্তিযুদ্ধে এসেছিল নুরউদ্দিন। বেশকিছু ভয়াবহ যুদ্ধের অংশ নেয় সে। সাহসী টগবগে সদ্য তারুণ্য পার হয়ে আসা যুবক। যুদ্ধ শেষে এটা-ওটা করে কিছুই ধরে রাখতে পারে না। চলে যায় দুর্গম পার্বত্য এলাকা বান্দরবান। বাঁশ কাটে, শন কাটে পাহাড় থেকে, বাজারে বিক্রি করে। তাকে একটা চাকরি জুটিয়ে দেওয়া হয় নিজ উপজেলা নাগেশ্বরীতে। তার ছেলেমেয়েদের সাধ্য অনুযায়ী পড়াশোনা করায়। সদা অস্থিরতায় ভোগা নুরউদ্দিন মনে শান্তি পায় না। কী হলো তার জয় বাংলার যুদ্ধে গিয়ে? স্বাধীন দেশ তো আমাদের কিছু দিল না। আমার সন্তানদের কী হবে?

রংপুরের মুহিপুর গ্রামের হাসানের মেরুদণ্ডে গুলি লাগে, করতোয়াপারের কালিয়াগঞ্জের যুদ্ধে। তুমুল যুদ্ধ আর গোলাগুলির তাণ্ডবের মধ্যে তাকে উদ্ধার করা হয় অনেক ঝুঁকি নিয়ে। দ্রুত পাঠিয়ে দেওয়া হয়ে সিএমএইচে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সুস্থ হয়ে দেশে ফেরে। তার কাছে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তাদের দেখতে গিয়েছিলেন। জামাকাপড়, টাকা, বিস্কুট, সাবান—এগুলো উপহার দিয়েছিলেন। হাসানের ভাগ্যে আর কিছুই জোটে না। ‘ভাইজান, মোক এখনা চাকরি দ্যান।’ দেখা হলেই বলে। এরশাদের আমল তখন, রংপুর চিড়িয়াখানা হচ্ছে। পিন্টুসহ কয়েকজন মিলে জেলা পশুপালন অফিসারকে এক রকম ঘেরাও করি। বলি, এর নাম হাসান। কালিয়াগঞ্জের যুদ্ধে ওর পিঠে গুলি লেগেছিল। এখনো বুলেট রয়েছে ওর মেরুদণ্ডে। ওকে চাকরি দিতেই হবে। হাসানের দারোয়ানের চাকরি হয়। তার সন্তানদের চাকরির জন্য এখন সে হন্যে হয়ে ঘোরাঘুরি করে।

পঞ্চগড়ের সজিমউদ্দীন মুক্তিযোদ্ধা সঙ্গীদের নিয়ে বদলুপাড়ায় তার নিজ গ্রামে তুলেছিল। কিছু দূরেই বিসমনিতে পাকিস্তানি আর রাজাকার বাহিনীর ঘাঁটি। বিসমনি ব্রিজ উড়িয়ে দেওয়ায় পাকিস্তানি বাহিনী চড়াও হয় সজিমউদ্দিনের বাড়িতে। মহিলাদের নির্যাতন করে। জ্বালিয়ে দেয় সজিমউদ্দীনের বাড়িসহ পুরো গ্রাম। বড় অপমান সইতে হয়েছে সজিমউদ্দীনকে। বড় মূল্য দিতে হয়েছে তার পরিবারকে। স্বাধীনতার পর তার কোথাও যাওয়া হয় না। সংসারের অনটনে জমি বেচতে থাকে এবং প্রায় পথের ভিখারি হয়ে যায়। কয়েক বছর আগে কিছু জমি উদ্ধার করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাকি সব জমি ফেরত চাই। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা সে। কেনো স্বাধীন দেশে এত দিন পার হওয়ার পরও তার জমি উদ্ধার হবে না? তার দাবির কথা ঠিক। কিন্তু শুনে যাওয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই।

আক্কাস ছিল লালমনিরহাটের হাতিবান্ধার কাকিনার লোক। মধুপাড়ার যুদ্ধে সে মারা গেল। কলেজে পড়ত সে, ফার্স্ট ইয়ারে। যুদ্ধে যাওয়ার এক মাস আগে বিয়ে করেছিল। নতুন বউ ছেড়ে চলে গিয়েছিল যুদ্ধে। মধুপাড়ার যুদ্ধে বুকে গুলি লেগে সে মারাই গেল। ওর ঠিকানা যুদ্ধের ডামাডোলে হারিয়ে গিয়েছিল। হাতিবান্ধার কাকিনার কাছে কোনো এক গ্রামে অপেক্ষারত তার স্ত্রীকে আমরা ওর মৃত্যুর খবর পৌঁছাতে পারিনি। জানি না, পরে সেদিনের সেই নতুন বউয়ের কী হাল হয়েছে।

জহিরুল ছিল পঞ্চগড় স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র। যুদ্ধের ডাকে সে চলে যায় ফ্রন্টে। অমরখানার যুদ্ধে দুজন রাজাকার পাকড়াও করা হয়েছিল। তাদের পাহারাদারিতে ছিল ভজনপুরের ছেলে মতিয়ার আর পঞ্চগড়ের জহিরুল। রাতের অন্ধকারে পাকিস্তানি বাহিনীর কাউন্টার অ্যাটাকে মতিয়ার নিহত হয়, প্রচণ্ডভাবে আহত জহিরুল মৃতবত্ পড়ে থাকে। তাদের উদ্ধার করে আনা হয়েছিল অতিকষ্টে। জহিরুলকে পাঠানো হয় হাসপাতালে আর মৃত মতিয়ারকে কবর দেওয়া হয় পাকা রাস্তার ধারে। কেউই যায় না এখন মতিয়ারের কবরের কাছে, নিতান্তই অবহেলিত শহীদ মতিয়ার। আর পুরো শরীরে যুদ্ধের ক্ষত নিয়ে জহিরুল ঘুরে বেড়ায় মুক্তিযোদ্ধা-ভাতার জন্য।

বেপরোয়া সাহস আর ঝুঁকি নিয়ে টোকাপাড়া ক্যাম্প রক্ষার সংকল্প নিয়েছিল গোলাম গউস। তার বাড়ি রংপুর। এককভাবে অগ্রসরমাণ শত্রুসেনা দলকে থামানোর লক্ষ্যে সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হয় গোলাম গউস। এই বীরত্বের জন্য কোনো স্বীকৃতি নেই, নেই কোনো পদক। তার কবর পড়েছে ভারতীয় ভূখণ্ডে, সেখানে যাওয়ারও কোনো উপায় নেই।

রংপুরের সেই বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা পিন্টুর এখনো বাড়িঘর হয়নি। প্রাইভেট কোম্পানির চাকরি করে কায়ক্লেশে সংসার চলে। তার জিজ্ঞাসা, আমি মারা গেলে বউ-বাচ্চা থাকবে কোথায়? দুর্ধর্ষ যোদ্ধা কোম্পানি কমান্ডার পিন্টুর প্রশ্নের কোনো জবাব দেওয়া যায় না।

অমরখানা যুদ্ধের নায়ক নাগেশ্বরীর বীর মুক্তিযোদ্ধা বসারতে। বেসরকারি এক প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করে সে। তাতে সংসার চলে না। অভিমানহত বসারত এখন আর কোনো অনুযোগ করে না।

বদরগঞ্জের খলীল, শালমারা যুদ্ধের সেই সাহসী যোদ্ধা। যুদ্ধের পর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে ডিড রাইটারের কাজ করত। কয়েক বছর আগে মারা গেছে। তার বড় ছেলে ঢাকায় রিকশা চালায়, ছোটটার কোথাও চাকরি হয় না। তার স্ত্রী রংপুর মেডিকেলে চিকিত্সা নেন আর বেঁচে থাকার সংগ্রাম করে চলেন।

জনযুদ্ধের গণনায়কেরা

দুর্ধর্ষ যোদ্ধা মতিয়ার, বাবলু, খলিল, মালেক, মঞ্জু, মোতালেব, হাদী, মূসা, ইব্রাহিম, একরামুল, তবিবর, জব্বার, হাকিম, আখতার, আবু বকর, শামসুল, হাফেজ, সফিজউদ্দিন, পহর আলী, মজিদ, চাঁদ মিয়া, শম্ভু, ভরত, অশ্বিনী, সামসুদ্দিন, জয়নালসহ অন্যান্য সাহসী যোদ্ধা জীবন-সংসার নিয়ে ব্যস্ত। মরে মরে বেঁচে থাকা এসব জনযোদ্ধা এখনো নিজেদের মধ্যে ধরে রেখেছে সেই অহংবোধ। তারা জয় বাংলার জন্য যুদ্ধ করেছে। তারা মুক্তিযোদ্ধা, তাদের জন্যই এই দেশ।

দুর্ধর্ষ যোদ্ধা শাহাজাহান নাগেশ্বরীতে প্যারালাইসড হয়ে পঙ্গু জীবন যাপন করছে। মোসারেদ পাগলা অভাবের তাড়নায় গাছের সঙ্গে ফাঁস লাগাবে বলে দড়ি হাতে ছুটে যায়। গাধা কমান্ডার রউফ এখন কেমন কুঁজো হয়ে চলাফেরা করে। আজিজুল রংপুর শহরে তেল বেচে বলে তার নাম হয়ে গেছে তেলী আজিজুল। তারও সংসার চলে না। ভূত দেখা বাচ্চা মিয়া রেলের চাকরি করে। চাকরির বয়স শেষ হয়ে এল, ছেলেদের সঙ্গে নিয়ে ঘোরে চাকরি খোঁজে। এভাবে যুদ্ধদিনের ছেলেরা, যারা দুর্ধর্ষ যোদ্ধা হিসেবে দারুণ খ্যাতি অর্জন করেছিল, তারা আসে আমার কাছে। আমি তাদের যুদ্ধদিনের কমান্ডার, তাই এখনো কমান্ডার।

এরা কেউই সেনাবাহিনী থেকে আসেনি, ইপিআর থেকে আসেনি, অন্য কোনো সশস্ত্র বাহিনী থেকেও নয়। এরা অন্ধ আবেগে সীমান্ত পাড়ি দিয়েছে। এদের বুঝের মধ্যে শুধু কাজ করছে জয় বাংলা আর জয় বঙ্গবন্ধু। এরা মুক্তিফৌজে নাম লিখিয়েছে, প্রশিক্ষণ নিয়েছে, তারপর থেকেছে যুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত যুদ্ধক্ষেত্রে। যুদ্ধের নায়ক এরা, এরা সব সূর্যসন্তান। কিন্তু যুদ্ধের পর সবার যেন কেমন কদর কমে গেল। কেমন করুণার পাত্র বনে গেল সবাই। অথচ কজনই বা ছিল সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা? এক লাখ, দেড় লাখ? এদের কি পুলিশ, আর্মি, বিডিআর, কল-কারখানায় প্রশাসনে চাকরি দিয়ে পুনর্বাসন করা যেত না? যেত। কিন্তু সেটা আমরা করিনি। কেন করিনি?

জনযুদ্ধের স্বরূপ হচ্ছে, জনগণের মধ্যে থেকে জনগণকে দিয়ে যুদ্ধ করা। ভিয়েত্কঙ যুদ্ধের কমান্ডার জেনারেল গিয়াপের তত্ত্ব এটি। কজন আর সেনাসদস্য বা ইপিআর ছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে? কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, যুবক—এদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী। নিম্নবর্গ মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী এই যোদ্ধা দল স্বাভাবিকভাবেই জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন পেয়েছিল। জনগণ আশ্রয় দিয়েছে, খাদ্য দিয়েছে, পথ দেখিয়ে নিয়ে গেছে শত্রুর অবস্থানের দিকে। এমনকি যখন অলআউট যুদ্ধ শুরু হয়, সব ফ্রন্ট দিয়ে মিত্রবাহিনী এগোতে থাকে, তখন এই জনগণই তাদের সাদরে গ্রহণ করেছে, শত্রুর অবস্থান চিনিয়ে দিয়েছে, সঙ্গী হয়েছে অগ্রসরমাণ যোদ্ধাদের পথ প্রদর্শক হিসেবে। তাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমেই নয় মাসের যুদ্ধে অর্জিত হয়েছে বিজয়। বাংলাদেশের জনযুদ্ধের ব্যাপারটি এক ব্যতিক্রমী অসাধারণ ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হবে আমাদের ইতিহাসে। মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে গেলে অবশ্যই সর্বাগ্রে বলতে হবে তাদের কথা। আমাদের যুদ্ধের নায়ক সেই সাধারণ জনগণের কথা।

মাহবুব আলম, মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক সরকারি কর্মকর্তা