বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর যে তারিখে জন্মগ্রহণ করেন, সে তারিখটি আজ বিশ্বের মানুষের কাছে বাঙালির বিশাল অর্জন হয়ে উদ্ভাসিত হয়েছে। তারিখটি ৭ মার্চ। বছরটি অবশ্য ১৯৪৯ সাল।
জয়তু ৭ মার্চ। জয়তু জাহাঙ্গীরের জন্মদিন। দুইয়ের অসাধারণ যোগফলে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে জাহাঙ্গীর বীরশ্রেষ্ঠ। স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করে শহীদ হয়েছেন।
জাহাঙ্গীরের জন্মস্থান বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ থানার আগরপুর ইউনিয়নের রহিমগঞ্জ গ্রামে। পিতা আবদুল মোতালেব হাওলাদার। পিতামহের নাম আবদুর রহিম হাওলাদার। তাঁর নামে গ্রামের নাম হয় রহিমগঞ্জ। রহিমগঞ্জের প্রাকৃতিক পরিবেশ ছিল তাঁর বড় হওয়ার স্বপ্নভূমি। দুই চোখভরে দেখেছেন অপরূপ প্রকৃতি। দেখেছেন প্রকৃতির নিষ্ঠুরতাও। নদীভাঙনে তলিয়ে গেছে পৈতৃক সম্পত্তি। কৃষিজমি নদীর ভাঙনে হারিয়ে গেলে সংসারে শুরু হয় টানাপোড়েন। তার ওপর বাবা ছিলেন গানপাগল মানুষ। প্রাণভরে গাইতেন মুর্শিদি, মারফতি, বাউলগান। মরমি গানের পাশাপাশি দেশপ্রেমের গানও তাঁকে উজ্জীবিত করেছে। স্বদেশি আন্দোলনের সময় গান গেয়ে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন চারণকবি মুকুন্দ দাস। সে সময় এ গান ছিল বরিশাল অঞ্চলের মানুষের স্বাধীনতার স্বপ্নস্বরূপ। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছিল মুকুন্দ দাসের গান। বাবার গান শুনে শুনে, গানের আসরে বসে থেকে জাহাঙ্গীরের শৈশব-কৈশোর কেটেছে বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্য ধারণ করে। দেখেছেন মানুষের উদ্দীপনা, দেখেছেন স্বদেশের মাটি, দেখেছেন নদীবিধৌত এলাকায় মানুষের বেঁচে থাকার লড়াই। চারদিক দেখে বড় হওয়ার স্বপ্নের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে স্বাধীনতার ডাক।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সময় তিনি ছিলেন ২২ বছরের যুবক। দুই কান ভরে শুনেছেন: ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ স্বাধীনতার ডাকে বীরযোদ্ধা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে তাঁর সময় লাগেনি। পশ্চিম পাকিস্তানের দুর্গম পাহাড়ি পথ পার হয়ে ছুটে এসেছেন যুদ্ধক্ষেত্রে। বীরশ্রেষ্ঠ হয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে আজ তিনি অমর মানুষ।
শৈশবে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় মামার বাড়ি মুলাদী উপজেলার পাতারচর গ্রামে। নদীভাঙনের শিকার পিতার আর্থিক সংগতি ছিল না ছেলেকে শহরের ভালো স্কুলে পাঠিয়ে লেখাপড়া শেখানোর। মামা ছিলেন সিঅ্যান্ডবির সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার। তিনি মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের লেখাপড়ার দায়িত্ব নেন। ১৯৫৩ সালে জাহাঙ্গীর পাতারচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হন। মেধাবী ছাত্র ছিলেন। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত সব পরীক্ষায় প্রথম স্থান লাভ করেছেন। ১৯৫৮ সালে প্রাথমিক পরীক্ষায় বৃত্তি পেয়ে পাস করেন। শেষ হয় প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডি।
১৯৫৯ সালে ভর্তি হন মুলাদী মাহমুদ জান পাইলট স্কুলে, ষষ্ঠ শ্রেণিতে। নতুন স্কুল, নতুন ক্লাসে শুরু হয় নতুন জীবন। প্রতি ক্লাসে প্রথম স্থান পেয়ে তিনি শিক্ষক-অভিভাবকদের স্নেহ-আদর পেয়েছেন। গ্রামের মানুষের ভালোবাসা তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল বেশি। সেই সঙ্গে নিজেকেও দাঁড় করিয়েছিলেন মানুষের সুখ-দুঃখের পাশে। গাছপালা-ফুল-পাখি নিয়ে গ্রামের চিরসবুজ প্রকৃতির ছবি গেঁথেছিলেন নিজের বুকে। যেন নিজেকেই শুনিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের গান, ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা...’। ১৯৬৪ সালে মাহমুদ জান পাইলট হাইস্কুল থেকে পাস করলেন মাধ্যমিক পরীক্ষা।
পরিবারের সবার সিদ্ধান্তে ভর্তি হলেন বরিশালের সরকারি ব্রজমোহন কলেজে। সংক্ষেপে বিএম কলেজ। মেজ মামা মতিউর রহমান থাকতেন বরিশালে। তিনি জাহাঙ্গীরের পড়াশোনার দায়িত্ব নিলেন। কলেজ থেকে বাড়ির দূরত্ব বেশি হওয়ায় মামা তাঁকে একটি সাইকেল কিনে দিলেন। সাইকেল পেয়ে জাহাঙ্গীর মহাখুশি, যেন বরিশাল শহর তাঁর হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। একই সঙ্গে পড়াশোনায় মনোযোগী হয়ে উঠলেন। ১৯৬৬ সালে এই কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করলেন। সামনে পেলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার দিন। পার হতে হবে শিক্ষার সমুদ্র। নিজেকে গড়তে হবে যোগ্য মানুষ করে। ঢাকায় এলেন বড় মামা ফজলুর রহমানের কাছে। তিনি তখন ঢাকায় বদলি হয়ে এসেছেন। সেখানে থেকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে পরিসংখ্যান বিভাগে সুযোগ পেলেন। এই বিভাগে পড়ার সুযোগ পেয়ে তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন। শুরু হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন। পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্য বইও পড়ার আগ্রহ বেড়ে গেল। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি আর পাবলিক লাইব্রেরি হয়ে উঠল তাঁর প্রিয় স্থান। ক্লাসের ফাঁকে লাইব্রেরিতে গিয়ে ঢুকতেন। অকারণ আড্ডা দিতে পছন্দ করতেন না। অবসর পেলে গান শুনতেন। বিশেষ করে, দেশাত্মবোধক গান। রেডিওতে গান শোনা ছিল তাঁর বিনোদন।
শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নেওয়ার জন্য তিনি শিক্ষাজীবন অব্যাহত রাখলেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে পত্রিকা পড়ার সময় বিমানবাহিনীতে অফিসার নেওয়ার বিজ্ঞাপন পড়লেন। ভাবলেন, পরিসংখ্যান বিভাগ থেকে অনার্স পাস না করে চাকরিতে ঢুকলে বাবার খারাপ আর্থিক অবস্থান সুরাহা করা যাবে। মামার সঙ্গে কথা বললেন। বাবাও জানালেন, বিমানবাহিনীতে অফিসার হতে পারলে ভালোই হবে। পরিবারের কাছ থেকে সম্মতি পেয়ে জাহাঙ্গীর বিজ্ঞাপনের পরিপ্রেক্ষিতে আবেদন করেন। বিমানবাহিনীর সব ধরনের পরীক্ষায় পাস করলেন। চূড়ান্ত মেডিকেল পরীক্ষার জন্য নির্বাচিত হলেন। কিন্তু ডান চোখের সমস্যার কারণে বাদ পড়ে গেলেন।
কিছুদিন পরে সেনাবাহিনীতে অফিসার নিয়োগের বিজ্ঞাপন দেখলেন। রীতিমাফিক আবেদন করলেন। প্রথা অনুযায়ী পরীক্ষা হলো। আইএসএসবি ও মেডিকেল পরীক্ষায় পাস করলেন। ১৯৬৭ সালে ওয়ার (১৫তম শর্ট সার্ভিস) কোর্সের জন্য প্রশিক্ষণার্থী অফিসার ক্যাডেট হিসেবে যোগ্যতায় উত্তীর্ণ হলেন। ঘুরে গেল জীবনের মোড়।
১৯৬৭ সালের ৫ অক্টোবর পাকিস্তানের কাকুল মিলিটারি একাডেমিতে ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন। তাঁর সঙ্গে আরও কয়েকজন বাঙালি ক্যাডেট ছিলেন। তাঁরা পাকিস্তান ব্যাটালিয়নে যোগদান করেন। জাহাঙ্গীরের ক্যাডেট নম্বর ছিল ৭৪৬০।
মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর জন্ম: ৭ মার্চ ১৯৪৯, মৃত্যু: ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১, জন্মস্থান: রহিমগঞ্জ, বাবুগঞ্জ, বরিশাল। যোদ্ধা: ৭ নম্বর সেক্টর, যুদ্ধ: চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পদবি: ক্যাপ্টেন, সমাধি চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনা মসজিদ প্রাঙ্গণ
তাঁর ক্যাডেট প্রশিক্ষণের সময়কাল ছিল আট মাস। ১৯৬৭ সালের ৫ অক্টোবর থেকে ১৯৬৮ সালের ১ জুন পর্যন্ত। একই বছরের ২ জুন ইঞ্জিনিয়ারিং কোরে কমিশন লাভ করেন। ১৯৬৮ সালের ৩ ডিসেম্বর তিনি সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদ থেকে লেফটেন্যান্ট পদে প্রমোশন পান। তিনি মুলতান ও রিসালপুর ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। অফিসার্স বেসিক কোর্স ২৯ সম্পন্ন করেন রিসালপুর থেকে। ১ জানুয়ারি ১৯৬৯ থেকে ৩১ জুন ১৯৭০ পর্যন্ত এই কোর্সের মেয়াদ ছিল। ১৯৭০ সালের ৩০ আগস্ট তাঁর ক্যাপ্টেন পদে প্রমোশন হয়। তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ‘বম্ব ডিসপোজাল কোর্স’ সম্পন্ন করেন। ‘কোর অব ইঞ্জিনিয়ারিং’-এর দক্ষ অফিসার হিসেবে তাঁর সুনাম ছিল।
১৯৭০ সালে জাহাঙ্গীর একটি ভিন্নধর্মী কাজে যুক্ত হয়েছিলেন। কাজটি ছিল কারাকোরাম হাইওয়ে কনস্ট্রাকশনের। এই রাস্তা নির্মাণ নিয়ে বাঙালি অফিসারদের ক্ষোভ ছিল। কারণ, যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে কমিটি করা হচ্ছিল, তাঁদের কাছে তার কোনো যুক্তি ছিল না। তাঁরা তখন ওই পাহাড়ি এলাকায় থেকেও জানতে পারছিলেন পূর্ব পাকিস্তানে ঘটে যাওয়া প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে লাখ লাখ মানুষের হতাহতের খবর। অথচ পাকিস্তান সরকার মানুষের দুর্দশার পাশে দাঁড়িয়ে সহযোগিতার হাত ঠিকমতো বাড়াচ্ছে না, যেন এমন একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ স্বাভাবিক ঘটনা। এ নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই। এর বিপরীতে তাদের প্রয়োজন ছিল শতকোটি টাকা ব্যয় করে গিলগিটে পাহাড় ভেঙে রাস্তা তৈরি। এই কাজে পাহাড় ভাঙার জন্য বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক ব্যবহার করা হচ্ছে। এই রাস্তা খুব বেশি মানুষ ব্যবহার করবে না। তারপরও পূর্ব পাকিস্তানের জনজীবনকে ঘূর্ণিঝড়ের প্রলয়ে আটকে রেখে নিজেদের অংশের জন্য অর্থ ব্যয় বাঙালি সেনা অফিসারদের ক্ষুব্ধ করেছিল। জাহাঙ্গীর সরাসরি এই কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে তাঁর কষ্ট বেশি ছিল। পাকিস্তান সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণ তাঁর পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছিল।
মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি এই কারাকোরাম এলাকার ১৭৩ ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়নে ছিলেন। খবর পাচ্ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানে ঘটে যাওয়া গণহত্যার। পাশাপাশি সেনাবাহিনীর নারকীয় তাণ্ডবের খবর সরাসরি না পেলেও জানতে পেরেছিলেন নানা সূত্রে। সেই সঙ্গে বুঝতে পারছিলেন, শুরু হলো বাঙালির মরণপণ লড়াই। জাহাঙ্গীর বাঙালির স্বাধীন দেশের স্বপ্নজয়ের চিন্তার সঙ্গে নিজের চিন্তা যোগ করেন। অস্থির হয়ে ওঠেন। পালিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজতে থাকেন। একই সঙ্গে অন্য বাঙালি অফিসারদের মধ্যে কারা যুদ্ধ করবেন, এমন সঙ্গী খুঁজতে থাকেন। একসময় চিন্তার অবসান হয়। ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন, ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার ও ক্যাপ্টেন আনামের সঙ্গে জোট বাঁধেন। তত দিনে তিন মাস পার হয়ে গেছে।
জুলাই মাসের ৩ তারিখে তাঁরা একত্র হয়ে বেরিয়ে পড়েন। লক্ষ্য শিয়ালকোটের কাছে সীমান্ত পার হয়ে ভারতে ঢুকবেন। তাঁরা চারজনে একটি ট্যাক্সি নিয়ে সীমান্তের কাছের মারালা নামের একটি জায়গায় আসেন। সেখানে একটি দরগা ছিল। দরগাটি ছিল একটি টিলার ওপর। তাঁরা ট্যাক্সির ড্রাইভারকে ছেড়ে দিয়ে টিলার নিচে অপেক্ষা করলেন। রাত নামলে চারজন বীরযোদ্ধা সীমান্ত পার হওয়ার জন্য পথে নামলেন। মারালার কাছে ছিল সুনাওয়ার তায়ী নদী। নদীর ওপর ড্যাম আছে। ড্যাম পার হয়েই পালাতে হবে। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়ে এগোলেন। তাঁরা জানেন, নদী পার হলেই পাওয়া যাবে ভারতীয় সীমান্ত। একসময় পার হয়ে গেলেন পাকিস্তানের সীমান্ত।
কাছাকাছি এসে বিএসএফের ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টারে গেলেন। সেখান থেকে দিল্লি এবং পরে কলকাতায় পৌঁছালেন। যুদ্ধক্ষেত্রে খবর ছড়িয়ে পড়ল যে চারজন অফিসার পাকিস্তান সেনাবাহিনী ছেড়ে এসেছেন নিজেদের মাতৃভূমি স্বাধীন করার জন্য। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেবেন। তাঁদের পালিয়ে চলে আসার খবরে তোলপাড় ওঠে মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের মধ্যে। সবাই উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী তাঁদের স্বাগত জানান। তাঁদের সাহসী সিদ্ধান্তের জন্য অভিনন্দিত করেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য তাঁদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টাকে দেশপ্রেমের নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত বলে জানান। তিনি তাঁদের মুক্তিযুদ্ধের চারটি সেক্টরে পোস্টিং দেন।
ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরকে মুক্তিবাহিনীর ৭ নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার হিসেবে পোস্টিং দেওয়া হয়। তাঁর ক্যাম্প ছিল মোহদীপুরে। ৭ নম্বর সেক্টরে দায়িত্ব পালনের সময় তিনি বেশ কয়েকটি অপারেশনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর সাহস, কৌশল, অসাধারণ দক্ষতা দেখে প্রত্যেকে বুঝেছিলেন, তিনি এক ব্যতিক্রমী যোদ্ধা। দ্রুত তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে সাব-সেক্টরে। অন্যদিকে নিজের প্রতি নির্মোহ দৃষ্টি ও দেশপ্রেমের অঙ্গীকার ছিল তাঁর চরিত্রের অন্যতম দিক। তাঁর পরনে থাকত লুঙ্গি, গেঞ্জি, গামছা ও ক্যানভাসের জুতা। সেক্টর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল কাজী নূর-উজ-জামানের সঙ্গে তিনি ভারতীয় জেনারেলদের মিটিংয়ে গেলে এই পোশাকই পরে যেতেন। আর যে দুটি জিনিস তাঁর সঙ্গে থাকত, তার একটি হলো রেডিও—স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে যুদ্ধের খবর শোনার জন্য। আরেকটি ছিল টর্চ—অন্ধকারে যার প্রয়োজন ছিল খুব বেশি। এ ছাড়া আর কোনো জিনিস তাঁর সঙ্গে থাকত না।
নানা দিক থেকে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁদের সবার সঙ্গে সমন্বয় সাধন করার জন্য নিজেকে বিনয়ী ও সাধারণ বেশে সাহসী মানুষের চেতনায় ধরে রাখতেন। মুক্তিযোদ্ধারা তাঁকে শুধু ভালোবাসতেন না, গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁর অমিত সাহস ও দক্ষতাকে পরিমাপ করতেন। অন্যদিকে তিনি পাকিস্তানি সেনাদের মাঝে ত্রাসের সঞ্চার ঘটাতেন। ৭ নম্বর সেক্টর কমান্ডার কাজী নূর-উজ-জামান যুদ্ধদিনের স্মৃতি নিয়ে যে বই লিখেছিলেন, তার নাম এ সেক্টর কমান্ডার রিমেম্বারস বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার ১৯৭১। এতে তিনি লিখেছেন: ‘মহিউদ্দিন ছিলেন একজন অনন্যসাধারণ দেশপ্রেমিক এবং যোগ্য সেনানায়ক। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে মোহদীপুর সাব-সেক্টরের চেহারা পাল্টে গেল। তাঁরা তাঁদের গেরিলা অপারেশনের কৃতিত্বের মাধ্যমে প্রেম সিং ও আমাকে মুগ্ধ করে ফেললেন।’ প্রেম সিং ছিলেন ৭ নম্বর সেক্টরের ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইনচার্জ। একজন নিবেদিতপ্রাণ যোদ্ধা হিসেবে জাহাঙ্গীর ভারতীয় সেনা অফিসারদের সম্মান পেয়েছিলেন।
তৎকালীন রাজশাহী জেলার চাঁপাইনবাবগঞ্জ ভারত-পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকা। সেক্টর কমান্ডার নূর-উজ-জামান পূর্ববঙ্গের এই শহর দখল করার পরিকল্পনা করেন। এ জন্য তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের তিনটি দল গঠন করেন। একটি দলের নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর, অন্যটির নেতৃত্ব দেন মেজর রশীদ, আরেকটির নেতৃত্বে ছিলেন মেজর গিয়াস। প্রতিটি দলের জন্য আলাদা পরিকল্পনা করা হয়েছিল। শহরটি দখল করার দায়িত্ব ছিল ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের ওপর। স্বদেশভূমির একটি শহর মুক্ত করার দায়িত্ব নিয়ে নিজের মগ্নতাকে বিস্তৃত করেন জাহাঙ্গীর।
কৈশোরে শোনা মুকুন্দ দাসের গান জাহাঙ্গীরকে আলোড়িত করে, ‘ছিল ধান গোলা ভরা/শ্বেত ইঁদুরে করল সারা’। পশ্চিম পাকিস্তানের চাকরিজীবনে তিনি তো সাদা ইঁদুরের দেখা পেয়েছেন। ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত এলাকাকেও তারা ঠিকমতো দেখাশোনা করেনি। উল্টো পূর্ব পাকিস্তানের গোলাভরা ধান কেটে সারা করেছে। এখন সময় হয়েছে তাদের উচিত শিক্ষা দেওয়ার।
ডিসেম্বর মাসের ১০ তারিখে জাহাঙ্গীর চাঁপাইনবাবগঞ্জের পশ্চিমে বারঘরিয়া এলাকায় প্রবেশ করেন। সঙ্গে ছিলেন ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ লেফটেন্যান্ট কাইউম ও লেফটেন্যান্ট আউয়াল। তাঁরা সেখানে অবস্থান করে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর হামলা করার পরিকল্পনা করেন। ডিসেম্বরের ১১ তারিখে তিনি খবর পেয়েছিলেন যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী চাঁপাইনবাবগঞ্জের সীমান্ত এলাকা কানসাট ও শিবগঞ্জ ছেড়ে শহরে অবস্থান নিয়েছে। জাহাঙ্গীর তাঁর সাঁড়াশি আক্রমণের পরিকল্পনা নিয়ে সেক্টর কমান্ডার কাজী নূর-উজ-জামানের সঙ্গে পরামর্শ করেন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী আক্রমণের সিদ্ধান্ত হয়। ঠিক হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর আক্রমণের সময় পাকিস্তানি সেনারা যেন প্রতিহত করার সুযোগ না পায়, সে জন্য লেফটেন্যান্ট রফিক ও লেফটেন্যান্ট রশীদ শাহপুরের কাছ দিয়ে মহানন্দা নদী পার হবেন। সেই রাস্তা দিয়ে এগিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের ব্যতিব্যস্ত রাখবেন। অন্যদিকে জাহাঙ্গীর লে. কাইউমকে নিয়ে শহরে অবস্থিত পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালাবেন। জাহাঙ্গীর প্লাটুন কমান্ডারদের জানান যে মহানন্দা নদীর পারে পাকিস্তানি সেনারা তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বাঙ্কার ও পিলবক্স বানিয়ে রেখেছে। বাঙ্কারগুলোর ভেতরে কমিউনিকেশন ট্রেঞ্চ বানিয়ে এক বাঙ্কার থেকে অন্য বাঙ্কারে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। জাহাঙ্গীর আক্রমণের পরিকল্পনা জানালেন সবাইকে। কোনো বাঙ্কারেই সামনে থেকে আক্রমণ করা ঠিক হবে না বলে প্রথমে মত দিলেন। বললেন, বাঙ্কারের ওপরে ও আশপাশে মর্টার ফায়ার করতে হবে। সেই ফায়ারের কভারে একজন-দুজন মুক্তিযোদ্ধা গিয়ে গ্রেনেড চার্জ করবেন। এভাবে ধ্বংস করতে হবে বাঙ্কার।
পরিকল্পনা অনুযায়ী নদীর পাড় ধরে এগোতে থাকে তিন প্লাটুন। তারিখ ছিল ১২ ডিসেম্বর। তিনি নদীর কাছের বাঙ্কারগুলোর ওপর মর্টারের গোলা ফেলার জন্য মর্টার প্লাটুনকে নির্দেশ দেন। কিন্তু সুরক্ষিত বাঙ্কারগুলোকে তেমনভাবে ঘায়েল করা যাচ্ছিল না। জাহাঙ্গীর চিন্তিত হন। তিনি অন্যদের সঙ্গে আলোচনা করেন। ঠিক হয়, তিনি নিজে একটি প্লাটুন নিয়ে নদী পার হয়ে অপর পাড়ে যাবেন। সেখান থেকে আক্রমণ করা হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জাহাঙ্গীর তাঁর প্লাটুন নিয়ে বারঘরিয়ার দক্ষিণে রেহাইচরের কাছে গিয়ে নৌকায় করে নদী পার হন। তারপর পাড় ধরে হেঁটে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে পৌঁছান।
এর আগে তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী চাঁপাইনবাবগঞ্জের আরগারার হাট, কানসাট ও শাহপুর এলাকা দখল করে মুক্তিযুদ্ধের অগ্রযাত্রা নিশ্চিত করে। ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত শহর দখলের এই অগ্রগতি ছিল।
১৪ ডিসেম্বর জাহাঙ্গীর পাকিস্তানি সেনাদের সুরক্ষিত বাঙ্কারে হামলা চালান। পাকিস্তানি সেনারা বাঙ্কার ছাড়াও আশপাশের বাড়ির ছাদের ওপরে অবস্থান নিয়েছিল। মুক্তিবাহিনী প্রচণ্ড গোলাগুলির মধ্যে একটু একটু করে চাঁপাইনবাবাগঞ্জের প্রধান সড়কের দিকে এগোতে থাকে। জাহাঙ্গীর ওয়্যারলেসের মাধ্যমে লেফটেন্যান্ট কাইউমের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন। ওয়্যারলেসে তাঁর কোড নাম ছিল ‘টাইগার’। জাহাঙ্গীরের কোম্পানির সামনে পাকিস্তানি সেনাদের বাঙ্কার থেকে প্রবলভাবে গুলি আসছিল। এর কাছাকাছি অন্য একটি জায়গা থেকেও মেশিনগানের গুলি আসছিল। মুক্তিবাহিনী এগোতে পারছিল না। তখন জাহাঙ্গীরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কিশোর যোদ্ধা লালু নিচু জায়গা দিয়ে বাঙ্কারের কাছাকাছি চলে যায়। বাঙ্কারের গর্তে দুটি গ্রেনেড ছুড়ে দেয়। বাঙ্কার ধ্বংস হয়।
১৪ ডিসেম্বরের সকাল।
প্রবল যুদ্ধ চলছে। মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকজন শহীদ হয়েছেন। অনেকে আহত হয়েছেন। একটি বাড়ির ছাদ থেকে মেশিনগানের গুলি ছুটে আসছে। জাহাঙ্গীর মেশিনগান স্তব্ধ করার জন্য তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেন। বাম হাতে এসএমজি ও ডান হাতে একটি গ্রেনেড নিয়ে ক্রলিং করে রাস্তা পার হয়ে যান। ওই বাড়ির সামনে গিয়ে মেশিনগান লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছোড়েন। মেশিনগানে পোস্ট ধ্বংস হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে রাস্তার পাশের আরেকটি বাড়ি থেকে শত্রুর স্নাইপারের গুলি বিদ্ধ করে জাহাঙ্গীরকে। তিনি রাস্তার ওপর পড়ে যান।
কপালে গুলি লাগার কারণে মুখ দিয়ে গলগলিয়ে রক্ত বের হয়। পাকিস্তানি সেনাদের পজিশনের সামনে মৃত্যুবরণ করে তিনি তাদের বুঝিয়েছিলেন স্বাধীনতার স্বপ্ন কত গভীর। পাকিস্তানি সেনারা তাঁর মৃতদেহ উল্টিয়ে দেখে ফেলে রেখে চলে যায়। তাঁকে দেখে বোঝার উপায় ছিল না যে তিনি একজন অফিসার, তিনি পরেছিলেন একটি ছাই রঙের জামা, সবুজ রঙের লুঙ্গি, কোমরে বাঁধা ছিল গামছা, পায়ে ছিল কালো রঙের পিটি সু। শরীরজুড়ে ছিল রক্ত।
রাস্তার অপর পাশে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখে ওয়্যারলেসে নওশের বললেন, ‘টাইগার নেই।’
দু-তিনজন মুক্তিযোদ্ধা মহানন্দা নদী সাঁতার কেটে বারঘরিয়ায় যান। খবর দেন জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর। মুক্তিযোদ্ধারা নতুন আক্রমণ শুরু করেন বিকেলের মধ্যেই। আক্রমণের তোড়ে পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটতে শুরু করে। রাজশাহীর দিকে পালিয়ে যায়। মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আসে চাঁপাইনবাবগঞ্জ।
ভোররাতে জাহাঙ্গীরের মরদেহ উদ্ধার করে মুক্তিযোদ্ধারা নদী পার হয়ে বারঘরিয়ায় নিয়ে আসেন। পরে অ্যাম্বুলেন্সে করে শিবগঞ্জে নিয়ে আসা হয় শহীদ জাহাঙ্গীরের মরদেহ। রাখা হয় শিবগঞ্জ থানা হেলথ কমপ্লেক্সে। হাজার হাজার মানুষ দেখতে আসে শহীদ জাহাঙ্গীরকে।
পরদিন ১৫ ডিসেম্বর।
মুক্তিযোদ্ধারা ও গ্রামবাসী তাঁর জানাজা পড়লেন। লাশ দাফন করার জন্য স্থান ঠিক করা হয়। সোনা মসজিদ প্রাঙ্গণ। জাহাঙ্গীরের ৭ নম্বর সেক্টরের প্রথম সেক্টর কমান্ডার নাজমুল হক সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করলে সোনা মসজিদ প্রাঙ্গণে তাঁকে সমাহিত করা হয়েছিল। তাঁর দাফনের তদারকি করেছিলেন জাহাঙ্গীর। সোনা মসজিদ ছিল ৭ নম্বর সেক্টরের ভেতরে। সেদিন জাহাঙ্গীর বলেছিলেন, স্বাধীনতার জন্য মৃত্যু হলে তাঁকে প্রিয় সেক্টর কমান্ডারের পাশে যেন দাফন করা হয়।
জাহাঙ্গীরের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধারা তাঁকে সমাহিত করার জন্য শিবগঞ্জ থেকে সোনা মসজিদ প্রাঙ্গণে নিয়ে যান। সুলতানি আমলে তৈরি অসাধারণ অলংকরণশৈলীতে নির্মিত শিল্পের একটি বড় নিদর্শন এই মসজিদ। দেয়ালের কারুকাজের দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতে হয়। এই মসজিদ জাহাঙ্গীরের প্রিয় প্রাঙ্গণ ছিল। তাঁকে দাফন করার জন্য এসেছিলেন সেক্টর কমান্ডার কর্নেল নূর-উজ-জামান, তাঁর পরিবারের সদস্য, মুক্তিযোদ্ধাসহ এলাকার হাজার হাজার মানুষ। তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।
১৬ ডিসেম্বর বিকেলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করে মিত্র বাহিনীর কাছে। বিকেলের সূর্য যখন আলোকিত করে রেখেছে রমনার রেসকোর্স ময়দান, ঠিক তার এক দিন আগের বিকেলেই ঐতিহাসিক সোনা মসজিদ প্রাঙ্গণে রচিত হয় বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ জাহাঙ্গীরের অন্তিম শয়ান। দীর্ঘ বছরের ব্যবধানে সেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে তাঁদের স্মরণে।
স্বাধীনতার পরে মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরকে সম্মানিত ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ খেতাবে ভূষিত করেন স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান।
সূত্র: ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত