বিজ্ঞাপন
default-image

একাত্তরে আমার বাবা দৈনিক ইত্তেফাক-এর কার্যনির্বাহী সম্পাদক শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেনকে আলবদররা অন্য অনেক বুদ্ধিজীবীর মতো নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। আজও নিশুতি রাতে অকস্মাত্ আমার মায়ের ঘুম ভেঙে যায় তাঁর প্রিয়তম স্বামীর প্রতি ব্যাকুল আকাঙ্ক্ষায়। কিন্তু আচমকা ঘুম ভাঙতেই তিনি দেখতে পান এ সত্য নয়, এক মধুর স্বপ্ন মাত্র! তিনি নবপরিণীতা লাজ-রক্তিম বধূ হিসেবে সেই যে কতকাল আগে এসেছিলেন আমার বাবার সংসারে, তার পর কেটে গেল কতকাল, ‘তবু মনে হয় যেন সেদিন সকাল!’ এমনিভাবে একাত্তরের সব শহীদজায়া আর তাঁদের সন্তানেরা অবচেতনমনে অপেক্ষা করে চলেন তাঁদের হারিয়ে যাওয়া স্বামী-পিতা বা প্রিয়জনকে কাছে পাওয়ার, তাঁর স্পর্শ পাওয়ার। কিন্তু হায়, তাঁদের সে আশা শুধু দুরাশাই হয়ে ফেরে! ইতিমধ্যেই এই শহীদজায়াদের অনেকেই প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে ধরাধাম থেকে বিদায় নিয়েছেন, যাঁরা বেঁচে আছেন তাঁরা তাঁদের স্বামীর হন্তারকদের শাস্তি দেখে যেতে চান—এটিই স্বাভাবিক।

যুদ্ধাপরাধীরা শাস্তি পাবে দেশের অন্য সবার মতোই এটি আমারও প্রত্যাশা। কেন, কী কারণে এই যুদ্ধাপরাধীরা চার দশককাল ধরে আইনের আওতামুক্ত থাকল তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক তোলা সম্ভব বটে। তথাপি বহু বিলম্বে হলেও বিচারকাজটি চলছে, এটিই বড় কথা। কিন্তু ঘাতক-দালালদের বিচার বাধাগ্রস্তের যে অপপ্রয়াস কয়েক দিন ধরে আমরা লক্ষ করছি, তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। সম্প্রতি এই বিচার নস্যাত্ করার জন্য হরতালের নামে যে সহিংসতা চালানো হলো এবং এখনো হচ্ছে, তাতে এ দেশের বিবেকবান মানুষের কাছে শহীদ পরিবারের সদস্য হিসেবে আমি এই প্রশ্নটিই রাখতে চাই, এমনিভাবেই কি এসব অপরাধী পার পেয়ে যাবে? এই ঘাতক চক্রের বিচার না হলে তো দেশের অন্য সব অপরাধীর বিচার চাওয়ার নৈতিক ভিত্তি আর রইবে না। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী এ বিচারের বিষয়টিকে যেভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করতে উঠেপড়ে লেগেছে, তাতে শহীদ পরিবারের বেদনা ও ক্ষোভ আরও ঘনীভূত হচ্ছে বৈকি।

ইত্তেফাক-এর বার্তা ও কার্যনির্বাহী সম্পাদক হিসেবে সিরাজুদ্দীন হোসেন পাকিস্তানের শাসকবর্গের যাবতীয় অন্যায়-অবিচার, শোষণ ও অপশাসনের বিরুদ্ধে অকুতোভয়ে কলমযুদ্ধ করে গেছেন। এই অঞ্চলের মানুষের মনে যাবতীয় মৌলিক ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তোলা এবং তাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির দিশা বাতলানোর কাজটি করে গেছেন দৃঢ়প্রত্যয় আর গভীর মমত্বের সঙ্গে। তাঁর লেখা রাজনৈতিক ভাষ্য, তাঁর দেওয়া লাগসই সংবাদ শিরোনাম এবং তাঁর রচিত সম্পাদকীয়-উপসম্পাদকীয় বা ঘটনার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ইত্যাদি এ দেশের জনগণকে অধিকার সচেতন করার এবং তাদের ন্যায্য হিস্যা পাওয়ার সংগ্রামকে বেগবান করার সহায়ক হয়েছে।

ছয় দফাকে বাঙালির মুক্তিসনদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে জনগণকে সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে তাঁর কলম যারপরনাই বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রেও তিনি জনগণের পক্ষ থেকে যেভাবে সংবাদ পরিবেশন করে গেছেন, তা এককথায় অসাধারণ। একাত্তরে পূর্ব পাকিস্তান নামক বন্দিশালায় বসে তিনি যেসব রাজনৈতিক ভাষ্য রচনা করেছিলেন, তা এ দেশে বন্দিদশায় থাকা কোটি কোটি বনি আদমকে শক্তি ও সাহস জুগিয়েছে।

মার্কিন কূটনীতিক আর্চার ব্লাড পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতনের যে গোপন রিপোর্টটি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে পাঠিয়েছিলেন, সেটির একটি কপি ব্লাড আমার বাবাকে দিলে তিনি প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কাছে তা পাঠিয়ে দেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে এরপর তা বারবার প্রচারিত হয় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বৃদ্ধির সহায়ক হয়। একজন প্রখর রাজনীতিসচেতন সাংবাদিক ছিলেন তিনি। দায়িত্ববোধসম্পন্ন, নিষ্ঠাবান, অকুতোভয় আর আশ্চর্য বিশ্লেষণী ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন তিনি। জনস্বার্থে সব ধরনের ত্যাগ করার মতো মনের জোর আর কর্তব্যনিষ্ঠা ছিল তাঁর।

আজ যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য যারা আস্ফাালন করছে, তারা সত্য ও ন্যায়ের পথ থেকে বিচ্যুত। তাদের এহেন অপচেষ্টার বিরুদ্ধে জাতিকে রুখে দাঁড়াতে হবে সত্যের খাতিরে, ন্যায়ের খাতিরে। একাত্তরে এই দেশে যা ঘটেছিল তাকে মিথ্যার আবরণে ঢেকে রাখা যাবে না। সুতরাং শহীদ সন্তান হিসেবে এ জাতীয় অপপ্রচার দেখে বড়ই মর্মাহত হই।

আমার মতো লাখ লাখ শহীদ পরিবার যে আমাদের প্রিয়জনের নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার ও হত্যাকারীদের শাস্তি চাইছি, একি আমাদের কোনো অন্যায় দাবি? আমাদের এ দাবি যদি আপনাদের কাছে সত্য ও ন্যায়প্রতিষ্ঠার দাবি বলে মনে হয়, তাহলে আসুন এই বিচারপ্রক্রিয়ায় সর্বত্র সমর্থন ও সহযোগিতা জুগিয়ে দেশকে যুদ্ধাপরাধীদের অপচ্ছায়ামুক্ত করি।

সূত্র: ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১২ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত