বিজ্ঞাপন
default-image

আমার ভাই দেশের জন্য যুদ্ধ করেছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমরা স্বাধীন দেশে বাসবাস করছি। কিন্তু আমার ভাই আশীষ স্বাধীনতা অর্জনের ভাগীদার হলেও তার স্বাদ পায়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে মারা যায়। এত বছরের মধ্যে শহীদ পরিবারের সদস্য হিসেবে আমার বৃদ্ধ মা মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পেতেন। মা-বাবা দুজনই মারা গেছেন; বাবা ১৯৯৫ ও মা ২০০৮ সালে। এর পর থেকে ভাতাও বন্ধ রয়েছে। আমাদের দাবি, অন্তত বরিশালের ব্যাপ্টিস্ট মিশন সড়কের নামটি শহীদ টমাস আশীষের নামে করা হোক। এসব কথা বলছিলেন মুক্তিযুদ্ধে শহীদ টমাস আশীষ বেপারীর বোন লীলা বেপারী।

আমি তখন পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী। আমরা তিন বোন, দুই ভাই। আশীষ আমাদের মধ্যে বড়। বাবা সরকারি চাকরি করতেন। নগরের ব্যাপ্টিস্ট মিশন রোডের উইলিয়ামপাড়ায় থাকতাম আমরা। মুক্তিযুদ্ধের সময় আশীষদা আইএসসির ছাত্র ছিল। বরিশাল সৈয়দ হাতেম আলী কলেজে (বর্তমানে সরকারি) পড়াশোনা করত।

১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী বরিশাল নগরে বিমান আক্রমণ চালায়। এ সময় আমার বাবা আমাদের নিয়ে গৌরনদী উপজেলার যোবারপাড় গ্রামের বাড়িতে চলে যান। গ্রামে বসেই জানতে পারেন, বরিশাল নগর পাকিস্তানি আর্মিরা দখল করে নিয়েছে। হঠাত্ কাউকে কিছু না বলে দাদা (আশীষ) বরিশাল চলে আসে। উইলিয়ামপাড়ায় নিজেদের বাড়িতেই থাকতে শুরু করে। পাকিস্তানি বাহিনীর নারকীয় তাণ্ডব, নারী নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে ভেতরে ভেতরে প্রতিরোধী হয়ে ওঠে। এ সময় একই পাড়ায় থাকত ফ্রান্সিস অরুণেষ পান্ডে। তার অনুপ্রেরণায় যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয় দাদা। এরই মধ্যে যোবারপাড় এলাকা থেকে বাবা আমাদের নিয়ে পুনরায় শহরে চলে আসেন।

আমি দেখতাম, পাকিস্তানি বাহিনীর ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত মানুষ কীভাবে গুটিয়ে রয়েছে। বাবা-মা আমাদের কোথাও বের হতে দিতেন না। মেয়েদের ওপর অমানবিক অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আমার ভাই মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তখনও দক্ষিণাঞ্চলে সংগঠিতভাবে মুক্তিযোদ্ধারা কাজ শুরু করেননি। একপর্যায়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংবাদ শুনে অরুণেষদা ও আশীষদা ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এটা অবশ্য আমরা পরে অরুণেষদার কাছে শুনেছি। ওই সময় আশীষদা আনমনা হয়ে থাকত। বাবা-মা বিষয়টি বুঝতে পেরে সব সময় নজরে রাখার চেষ্টা করতেন। মা-বাবার নজরদারি টের পেয়ে ১৫ জুন কাউকে কিছু না বলে ফ্রান্সিস অরুণেষ পান্ডের সঙ্গে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়।

১৩ নভেম্বর আশীষদা সুবেদার করিমের নেতৃত্বে বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলায় অপারেশনে যায়। সেখানে রঙ্গশ্রী উপজেলার শ্যামপুর উচ্চবিদ্যালয়ে তারা প্রথম অবস্থান করে। এ সময় স্থানীয় সাধারণ মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে থাকে। আস্তে আস্তে এ সংবাদ চলে যায় রাজার সদস্যদের মাধ্যমে পাকিস্তানি আর্মিদের কাছে। ১৭ নভেম্বর ভোররাতে পাকিস্তানি বাহিনী অতর্কিতে হামলা চালায় শ্যামপুর উচ্চবিদ্যালয়ে। এ সময় আশীষদা সামনের সারিতে থেকে দলনেতা ও অন্য সদস্যদের নিরাপদ দূরত্বে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে একাই শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকে। একপর্যায়ে আশীষদা নিজে আত্মরক্ষা করতে পেছনে সরতে চাইলে প্রতিপক্ষের একটি গুলি এসে ডান হাতে লাগে। গুলিবিদ্ধ অবস্থায়ও সে শত্রুদের বিরুদ্ধে গুলি চালাতে থাকে। এ সময় পাকিস্তানি আর্মি এসে আশীষদাকে ধরে ফেলে পায়ের তলায় পিষে এবং নদীর পাড়ে নিয়ে গুলি করে বুক ঝাঁঝরা করে দিয়ে লাশ নদীতে ফেলে দেয়।

আশীষদা মারা যাওয়ার কয়েক দিন পর আমরা তার মৃত্যুসংবাদ পাই। তার সহযোদ্ধা নাসিরউদ্দিন আমাদের কাছে মৃত্যুসংবাদ পৌঁছায়। কিন্তু তার লাশ আমরা পাইনি। যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমার মা জানতেন, দাদা বেঁচে আছে। যুদ্ধের পরে তাঁকে জানানো হয়েছিল। আমার ভাই দেশের জন্য সংগ্রাম করেছে। এ জন্য আমাদের যেমন অহংকার ও গর্ব হচ্ছে, তেমনি দুঃখ ও কষ্ট পাচ্ছি। স্বাধীনতার ৪০ বছরেও আমার ভাইয়ের স্মৃতি রক্ষার্থে কোনো উদ্যোগ দেখিনি। আমরা চাই, আমার ভাইয়ের অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে নগরের ব্যাপ্টিস্ট মিশন রোডটি শহীদ টমাস আশীষের নামে করা হোক।

অনুলিখন: সাইফুর রহমান, বরিশাল

সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০১০ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত