বিজ্ঞাপন
default-image

একাত্তরের এপ্রিল মাস। কালবৈশাখী হাওয়া। মাঝেমধ্যে ঝমঝমে বৃষ্টি। যুদ্ধ তখন পুরোদস্তুর। ২৮ এপ্রিল সকাল নয়টার দিকে দুই দিক দিয়ে ২৬ জন পাকিস্তানি সেনা আক্রমণ করে গোটা গ্রাম ঘিরে ফেলে। আগের রাতে ধুমছে বর্ষা নামায় মাটিতে কাদা কাদা ভাব। গ্রামটি যশোর সদর উপজেলার বাহাদুরপুর।

গ্রামের ২৮টি বাড়ি থেকে ২৮ জন পুরুষ মানুষ ধরে কর্মকারবাড়ির পেছনে জড়ো করে লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয়। পরে তারা নৃশংসভাবে ব্রাশ টেনে গুলি করে। দুমড়েমুচড়ে একজনের ওপর আরেকজন লুটিয়ে পড়ে। ছোপ ছোপ রক্তে মাটি লাল হয়ে যায়। গুলির শব্দে চারদিক কেঁপে ওঠে। ওদের মারার পর বাড়িঘরে আগুন দিতে দিতে ভৈরব নদের দিকে এগিয়ে আসে পাকিস্তানি সেনার দল। গ্রামের নারীরা শিশু কোলে নিয়ে দিগ্বিদিক দৌড়াতে থাকে। পুরুষেরাও যে যার মতো দৌড়ে পালাতে থাকে।

গ্রামের সদর আলী ও মোকছেদের কাছে কর্মকারবাড়ির নারকীয় তাণ্ডবের খবরে শিউরে উঠলাম। ভয় আরও বাড়ল। সদর ও মোকছেদ কর্মকারবাড়ির দিকে যেতে চাইল। কী মনে করে আমিও তাদের সঙ্গী হলাম। ভৈরব নদের তীরে বটতলার তিন রাস্তার মাথায় আসার পর কোত্থেকে যেন জনাদশেক পাকিস্তানি সেনা এসে আমাদের ধরে ফেলল। গ্রামের ওহাবকেও তারা ধরে আনল। পেছন থেকে বন্দুকের নল দিয়ে খোঁচাতে খোঁচাতে আমাদের নিয়ে গেল তেঁতুলতলার দিকে। পাকিস্তানি সেনাদের একজন জিজ্ঞাসা করল, ‘মুসলমান না হিন্দু হ্যায়’। মুসলমান বলতেই আরেকজন হাঁক ছাড়ল, ‘কলেমা পড় ব্যাটা’। মৃদু স্বরে কলেমা উচ্চারণ করতেই পিঠে ধমাধম বন্দুকের বাড়ি। চারজনকে পাশাপাশি উপুড় করে শুইয়ে দিল। দাঁতের ওপর দাঁত রেখে পাকিস্তানি সেনাদের একজন ‘মুজিবর বাবা হ্যায়, বাবার ওধার যা’ বলেই শুরু করল ফায়ার।

কিছুক্ষণ পর চেতন ফিরলে দেখি, পিঠ দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়ছে। ছোপ ছোপ রক্ত শুকিয়ে গেছে। কাঁথা সেলাইয়ের মতো গুলি পিঠের চামড়া ভেদ করে বেরিয়ে গেছে। সারা শরীর ভয়ে কাঁপতে লাগল। সঙ্গী সদর ও মোকছেদের নিথর দেহ রক্তে ভেজা। তাদের হুঁশ নেই। কোনো রকমে উল্টিয়ে দেখি, গুলি তাদের পেট দিয়ে বেরিয়ে গেছে। কোথাও কেউ নেই। হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে আশ্রয় নিলাম হাদি মিয়ার ইটের ভাটায়। বাহাদুরপুর ও পার্শ্ববর্তী বিরামপুর-পাগলাদহ গ্রাম থেকে অনেক নারী-শিশু-পুরুষ সেখানে পালিয়ে ছিল। কিছুক্ষণ বসার পর অস্থির লাগতে শুরু করল। হাঁটতে হাঁটতে বাড়িতে এলাম। শরীরে আর কোনো বল পেলাম না। বারান্দায় গিয়ে ধপাস করে শুয়ে পড়লাম।

বড় বোন আমেনা বেগম কী যেন গাছের পাতা বেটে গেঞ্জি ছিঁড়ে ক্ষতস্থান বেঁধে দিল। পরে ইপিআরের (বর্তমান বাংলাদেশ রাইফেলস) সদস্যরা পাউডারের মতো কী ওষুধ লাগিয়ে দিল। আমেনা বেগমের বিয়ে হয় পার্শ্ববর্তী নওয়াপাড়া গ্রামে। পাকিস্তানি সেনারা ওই গ্রামেও আক্রমণ চালায়। বোন-ভাগনেরা উপায় না পেয়ে আমাদের বাড়িতে এসে আশ্রয় নেয়।

পরে ওহাবের সঙ্গে দেখা হলো। ওহাব জানাল, সেও মৃত্যুর ভান করে পড়ে ছিল। এ গ্রামের আমরাই দুজন জীবন্ত ইতিহাস। সেদিন লাশের স্তূপ থেকে বেঁচে ফিরি। ওহাব এখনো বেঁচে আছে।

যুদ্ধ শেষ হলো। আহত হিসেবে সরকার থেকে ৫০০ টাকা দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হলো। দেওয়ার সময় আমাকে দেওয়া হলো ৪০০ টাকা। ১০০ টাকা বকশিশ নিয়ে নিল। মুক্তিফৌজে নাম লেখানোর জন্য গ্রামের একজন দুই হাজার টাকা চাইল। দিতে পারলাম না। তাই নামটিও গেজেটে উঠল না।

সেদিনের করুণ দৃশ্য মনে পড়লে আজও চোখ ভিজে ওঠে। ওই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে এ দেশের যারা সম্পৃক্ত ছিল, তাদের বিচার আজও হলো না, যা ভাবতেই তীব্র যন্ত্রণা বোধ হয়।

অনুলিখন: মনিরুল ইসলাম, যশোর