একাত্তরকে পেছনে ফেলে ৩৭টি বছর কেটে গেছে। তবু একাত্তর আমাদের কাছে জ্বলন্ত এক মশাল। এ মশাল যার হূদয়ে জ্বলছে সে-ই আলোকিত। আর একাত্তরে আজও প্রাণ সঞ্চারিত করছে তখনকার ছবি, তথ্যচিত্র আর স্মৃতি। ওই সময়ের প্রতিটি ছবি নিজেই এক একটি ইতিহাস। সে ইতিহাস গড়ার কারিগরদের নেপথ্যে যাঁরা ছিলেন তাঁদের মধ্যে ফটোসাংবাদিক রশীদ তালুকদার একজন। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান থেকে সত্তরের নির্বাচন, অসহযোগ আন্দোলন, যুদ্ধ, গণহত্যা, যুদ্ধের ধ্বংসলীলা, কান্না, নারী আন্দোলনসহ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আন্দোলনে তাঁর ছবিগুলো আমাদের ইতিহাসের প্রমাণ দিয়েছে; কখনো দেখিয়েছে আলোর পথ, কখনো দেখিয়েছে আমাদের প্রত্যয়।
জন্ম ১৯৩৯ সালের ২৪ অক্টোবর ভারতের চব্বিশ পরগনায়। পিতার চাকরির জন্য জীবনটা কেটেছে যাযাবরের মতো। রাজশাহীর মোতাহার হোসেনের স্টার স্টুডিওর ছবি তোলা আর মানুষের প্রতিচিত্র হুবহু দৃশ্যায়িত হতে দেখে ঝোঁক বাড়ে ফটোগ্রাফির ওপর। জীবন শুরু করেছেনও স্টার স্টুডিও থেকে। ১৯৬২ সালে ফটোসাংবাদিক হিসেবে যোগদান করেন দৈনিক সংবাদে। যুদ্ধের সময় আইডি কার্ড করে দিতেন আর সঙ্গী ছিল তার ক্যামেরা। ১৯৭৫ থেকে প্রায় তিন দশক সিনিয়র ফটোসাংবাদিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। জীবনে প্রথম ক্যামেরা ছিল আইসুলেট ক্যামেরা। আরও ছিল রোলিকর্ড আর রোলিফ্লেক্স। ষাটের দশকের শেষ দিক থেকেই ১৩৫ মিমি ক্যামেরা ব্যবহার করেন। কাজের মূল্যায়ন হিসেবে সর্বমোট ৭২টি সংবর্ধনা পেয়েছেন।
বাংলাদেশের বিভিন্ন সোসাইটি ও সংস্থা কর্তৃক, জাপান, ইউনেসকো, থাইল্যান্ড ও অন্যান্য দেশ থেকে পুরস্কৃত হয়েছেন বহুবার। ফ্রান্সে জাতিসংঘ আয়োজিত ‘নিরাপদের জন্য আশ্রয়’ শীর্ষক প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় স্থান, জার্মান ডিডিআর থেকে ডিপ্লোমা, জাপান ফটোগ্রাফিক সোসাইটি ও আসহাই সিমবুন পত্রিকা থেকে দুইবার পুরস্কৃত হন। দেশ থেকে পূরবী পদক-৯৩, ঋষিজ শিল্পগোষ্ঠী-৯০, বিপিএস স্বর্ণপদক (১৯৮২), জাতীয় জাদুঘর থেকে দুইবার বিশেষ পুরস্কারসহ বিভিন্ন আলোকচিত্র প্রতিযোগিতায় তিনি পুরস্কৃত হয়েছে। ২০০৬ সালে ছবিমেলা কর্তৃক ‘আজীবন সম্মাননা’ লাভ করেন। তিনি বাংলাদেশ ফটোজার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৫৯ থেকে ২০০৬। তাঁর আলোকচিত্র অসম্ভব মূল্যবান এবং দুর্লভ। যে আলোকচিত্রগুলো নিজেই এক একটি ইতিহাস তার মূল্য নিরূপণ এত সহজ তো নয়।
রশীদ তালুকদার বলছিলেন, আজ ছবিগুলো দেখতে দেখতে একটা কথা বারবার মনে হয়। অনেক ঐতিহাসিক অধ্যায়েরই ছবি আছে যেখানে আমার ছবিগুলোই ঘুরেফিরে প্রচারমাধ্যমে আসে। অথচ ওই সময় আমি তো দেখেছি, আমার সঙ্গে আরও অনেক আলোকচিত্রী ছিলেন। তাঁদের মধ্যে বিদেশি আলোকচিত্রীরাও কাজ করেছেন। তাঁরা আজ কোথায়? কোথায় তাঁদের তোলা সেই ছবিগুলো যা আরও সমৃদ্ধ করতে পারত? কিন্তু আমি তো আর দেখি না। সেগুলো কি নষ্ট করে ফেলা হয়েছে না সংরক্ষণের অভাবে হারিয়েই গেছে?
শিখ্তী সানী
সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০০৮ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত