৩০ মার্চ একজন ইপিআর কর্মকর্তার চিরকুট হাতে পেলাম আমি। এটিই সম্ভবত পূর্ব পাকিস্তান থেকে সাহায্যের জন্য পাওয়া প্রথম কোনো বার্তা। গোলক মজুমদার ৭৬ ব্যাটালিয়নের কর্নেল চক্রবর্তীর সঙ্গে কৃষ্ণনগরে গেলেন। বনপুর-গেদে সীমান্তে তাঁরা মেহেরপুরের সাব-ডিভিশনাল কর্মকর্তা তৌফিক ও সাব-ডিভিশনাল পুলিশ কর্মকর্তা মাহবুবের সঙ্গে সাক্ষাত্ করলেন। পূর্ব পাকিস্তানি কর্মকর্তারা বললেন, নেতাদের সঙ্গে এখনো তাঁদের নিয়মিত যোগাযোগ আছে। কারণ, টেলিফোন সংযোগগুলো এখনো বিকল হয়ে যায়নি। তাঁদের কাছে জানতে চাওয়া হলো, তাঁরা কী ধরনের সাহায্য চান। উত্তরে তাঁরা বললেন, পেট্রল, কেরোসিন, টাকাপয়সা, অস্ত্রশস্ত্রসহ তাঁদের সব ধরনের সহযোগিতা প্রয়োজন।
গোলক জানতে চাইলেন, তাঁরা এই যুদ্ধের দায়িত্বপ্রাপ্ত কিছু নেতার সঙ্গে দেখা করতে পারবেন কি না। কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্ধকার একটা জায়গা থেকে বেরিয়ে এলেন তাজউদ্দীন আহমদ। তাজউদ্দীনকেই উত্তরসূরি হিসেবে দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন মুজিবুর রহমান। তাজউদ্দীনের সঙ্গে ছিলেন জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের প্রধান হুইপ আমীর-উল ইসলাম। দুজনেরই খালি পা, কোটরে ঢুকে যাওয়া চোখ, এলোমেলো চুল, পরনে লুঙ্গি আর একটা গেঞ্জি। তাঁরা হেঁটে ঢাকা থেকে এখানে এসেছেন।
‘আপনি আমাকে চিনতে পারছেন? আমি গোলক মজুমদার।’ তাজউদ্দীন বললেন, ‘নিশ্চয়ই। আমাদের নেতা মুজিব ভাই বলেছেন সবাইকে ছড়িয়ে পড়তে এবং বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিরোধযুদ্ধের দায়িত্ব নিতে। মুজিব গ্রেপ্তার এড়াতে পারেননি। তিনি আমাদের বারবার বলেছেন এমন কিছু না করতে, যাতে করে ভারতকে বিব্রত হতে হয়। চীনকে উত্তেজিত করা বা আন্তর্জাতিক ফোরামে ভারতের অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ হতে হয় এমন কিছু করতে তিনি আমাদের নিষেধ করে দিয়েছেন।
গোলক তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনারা আমাদের থেকে কী প্রত্যাশা করেন? আমরা কী করতে পারি? আপনারা কি আমাদের সঙ্গে কলকাতায় যেতে চান?’
তাজউদ্দীন এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। তিনি বললেন, তাঁকে তাঁর মানুষের জন্য থেকে যেতে হবে। গোলক তাঁকে বললেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। ওরা তাঁকে খুঁজে বের করে গুলি করে মারবে। এ কথা শুনে তাজউদ্দীন মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আলোচনার জন্য ফিরে গেলেন এবং জানালেন, তিনি তাঁদের সঙ্গে কলকাতায় যেতে ইচ্ছুক।
গোলক আমাকে সবকিছু জানালেন। আমি কলকাতার উদ্দেশে রওনা দিলাম। যখন কলকাতায় পৌঁছালাম তখন ৩০-৩১ মার্চের মাঝামাঝি একটা সময়, রাত ১২টার মতো বাজে। গোলক তাঁর চিরাচরিত হাসি দিয়ে আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন। গোলক আমাকে একটু আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি আমাদের সঙ্গে আছেন। ‘আপনি কি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চান?’
‘অবশ্যই দেখা করতে চাই, এখনই চাই।’
আমরা হেঁটে জিপের কাছে গেলাম। সেখানে তাজউদ্দীন বসে ছিলেন, সঙ্গে তাঁর নিরাপত্তার জন্য থাকা দুজন। আমরা তাঁকে ও আমীর-উল ইসলামকে আসাম হাউসে নিয়ে গেলাম। তাঁরা গোসল করলেন। আমি তাঁদের আমার কুর্তা ও পাজামা পরতে দিলাম। গোলক তাঁদের জন্য অমলেট করে নিয়ে এলেন। গোয়েন্দা সংস্থার উপপরিচালক রাজগোপাল আমাকে নিশ্চিত করলেন, চলমান যুদ্ধে তাজউদ্দীন আহমদই দ্বিতীয় ব্যক্তি। আমাদের জন্য তিনি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
পরবর্তী দুই দিন আমরা যুদ্ধের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে তাজউদ্দীন আহমদের কাছ থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নিলাম। জানলাম পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের সঙ্গে তাঁদের আলোচনার বিষয়েও। তাজউদ্দীন এ পরিস্থিতির জন্য পুরোপুরিভাবে ভুট্টোকে দায়ী করলেন। ইয়াহিয়া সমঝোতার ব্যাপারে নিমরাজি ছিলেন, কিন্তু সামরিক জান্তা ও ভুট্টোর বিরোধিতার কারণে ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। ইয়াহিয়া আলোচনা ভেস্তে দিয়ে ওদের আশ্বস্ত করেছেন। সম্ভবত সবকিছু বুঝেও তিনি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমি আওয়ামী লীগের নেতাদের মনোভাব সম্পর্কে জানতে চাইলাম। তিনি সাফ জবাব দিলেন, তাঁরা স্বাধীনতা চান। পাকিস্তানি শাসকদের তাড়াতে তাঁদের যুদ্ধের পরিকল্পনা সম্পর্কেও শুনলাম আমরা। তিনি বললেন, পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিহত করতে পূর্ব পাকিস্তানের সব মানুষ একতাবদ্ধ—এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই।
তাজউদ্দীন সীমান্ত এলাকায় যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠলেন। ১ এপ্রিল তিনি রাজগোপাল ও গোলককে নিয়ে কৃষ্ণনগরের কাছে একটি সীমান্ত ফাঁড়ি পরিদর্শনে গেলেন। আগে থেকেই এই পরিদর্শন সম্পর্কে যশোর সেক্টরের নেতৃত্বে থাকা মেজর আবু ওসমান চৌধুরীকে (কুষ্টিয়া-যশোর সেক্টরের কমান্ডার) জানানো হয়েছিল। মেজর ওসমান তাজউদ্দীন আহমদকে জানালেন, পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিহত করতে তাঁদের কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণ গোলাবারুদ নেই। তাজউদ্দীন আমাদের কর্মকর্তাদের দিকে তাকালেন। মনে হলো, মেজর ওসমানের কথার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা যা বলব, তাতেই বোঝা যাবে আমরা যে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছি তা কতটা আন্তরিক। দুজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা মেজর ওসমানকে কিছু অস্ত্রশস্ত্র দেওয়ার সিদ্ধান্ত দিলেন। কী পরিমাণ গোলাবারুদ দরকার, তা-ও জানতে চাইলেন। ওসমান যখন তাঁর দলবল নিয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন। তাঁদের দিকে তাকিয়ে তাজউদ্দীনকে বলতে শোনা গেল, ‘ওই যে ওরা যায়। আমাদের আশা আর অদম্য আকাঙ্ক্ষাকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে গেল ওরা।’
সিদ্ধান্ত হলো, তাজউদ্দীন ও অন্য নেতাদের নয়াদিল্লি নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে একটি সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হবে। গোলক তাঁদের সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। আমি আর গোলক নিউমার্কেটে গেলাম। সেখানে গিয়ে তাঁদের জন্য কাপড়চোপড়, ব্যাগ, সাবান, তেল যা যা লাগে, কিনলাম।
আমি হাসতে হাসতে বললাম, গোলক, গত ২৩ বছরে নয়াদিল্লির মানুষ মুক্তিযোদ্ধা দেখেনি। ওখানকার বর্তমান প্রজন্মের নেতারা ভালো পোশাক-পরিচ্ছদ ছাড়া কাউকে ঠিক ভালোভাবে নেবে না।’
গোলক তাজউদ্দীন আহমদ ও আমীর-উল ইসলামকে নিয়ে ১ এপ্রিল নয়াদিল্লিতে পৌঁছালেন। ওখানে তাঁদের তত্ত্বাবধানে ছিলেন বিএসএফের সহকারী পরিচালক এস চট্টোপাধ্যায়। গোলক অন্য নেতাদের আনতে দ্রুতই আবার কলকাতায় ফিরে গেলেন।
৪ এপ্রিল সন্ধ্যায় তাজউদ্দীন আহমদ ও আমীর-উল ইসলাম প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করলেন। শুধু ভারতীয় নেতাদের সঙ্গেই নয়, তাঁরা দফায় দফায় বৈঠক করলেন শীর্ষ কর্মকর্তা এবং নয়াদিল্লিতে থাকা পূর্ববাংলার বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গেও। তাঁদের মধ্যে ছিলেন এম আর সিদ্দিকী, অধ্যাপক ইউসুফ আলী ও সিরাজুল হক। এ ছাড়া ছিলেন নির্দিষ্ট কিছু সাংবাদিক। নয়াদিল্লিতে সপ্তাহ খানেক থাকার পর তাঁরা ৯ এপ্রিল কলকাতায় পৌঁছালেন। এবার তাঁরা আরও বলিষ্ঠ, আরও প্রত্যয়ী।
এপ্রিলের ৬ ও ৭ তারিখ নয়াদিল্লিতে তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে যখন আলোচনা হলো, তখন তাঁকে বেশ উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল। তিনি বললেন, একটি আনুষ্ঠানিক প্রবাসী সরকার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তত তাড়াতাড়ি গঠন করা ও একে কার্যকর করা দরকার। পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত কিছু নির্বাচিত প্রতিনিধির উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য তিনি আমাদের সাহায্য চাইলেন। সদ্য নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দিয়ে গঠিত সরকার প্রবাসী সরকারকে অনেক বেশি বৈধতা দেবে বলে তিনি ধারণা করছিলেন। আমরা সাধ্যমতো সহযোগিতা করলাম।
আমরা বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। তাঁদের মধ্যে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম (ময়মনসিংহ), কর্নেল এম এ জি ওসমানী (সিলেট), ক্যাপ্টেন মনসুর আলী (পাবনা), খন্দকার মোশতাক (কুমিল্লা) ও কামরুজ্জামান (নোয়াখালী)। পরে মওলানা ভাসানীও ধুবড়ির কাছে তাঁর ‘বোটহাউস’ থেকে এসে যোগ দিলেন।
এ সময়ে নতুন করে যে প্রশ্নটি সবার সামনে এসে দাঁড়াল, তা হলো স্বাধীন হওয়ার পর দেশটির নাম কী হবে। পূর্ববাংলা, বঙ্গভূমি, বঙ্গ এবং স্বাধীন বাংলা—এ কয়েকটি নামের সুপারিশ এল। পূর্ববাংলা নামটি প্রত্যাখ্যান করা হলো। কারণ, পশ্চিম বাংলার সঙ্গে এ নামটি গুলিয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে এর অস্তিত্ব নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। বঙ্গভূমি নামটিও বাদ গেল বিদেশিদের নামটি মনে করতে পারায় অসুবিধা হতে পারে, এ বিবেচনায়। একে একে বাদ গেল বঙ্গ ও স্বাধীন বাংলা নাম দুটিও। সময় পরিক্রমায় স্বাধীন শব্দটি প্রাসঙ্গিকতা হারাতে পারে এমন ধারণা থেকে। তাজউদ্দীন বাংলাদেশ নামটি প্রস্তাব করলেন। মুজিবুর রহমান এ নামটি উচ্চারণ করেছিলেন বলে তিনি জানালেন। এই নামটি একটি ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্রের ধারণা দেয়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এ ভাষার জন্য অনেক যুবক প্রাণ দিয়েছেন। সব নেতা সঙ্গে সঙ্গে এ প্রস্তাবে সমর্থন দিলেন।
জাতীয় পতাকাটা কেমন হবে, তা নিয়েও আলোচনা হলো। প্রথমে নেতারা নিজেদের মধ্যে বৈঠক করলেন। পরে আমি ও গোলক সে বৈঠকে যোগ দিই। অনেক পরিমার্জন, পরিবর্ধনের পর চূড়ান্ত রূপ পেল জাতীয় পতাকা। একটা খসড়া নকশাও করা হলো। পূর্ববঙ্গের সবুজ শ্যামলিমা বোঝাতে সবুজ জমিন আর মুক্তির প্রভাত বোঝাতে ওই জমিনের ওপর লাল সূর্য। অনেক তর্ক-বিতর্কের পর সিদ্ধান্ত হলো, লাল সূর্যের ওপর রাখা হবে পূর্ববঙ্গের মানচিত্র। এতে করে জাপানের পতাকার নকশা থেকে এটি আলাদা হবে, কোনো রকম ভুল-বোঝাবুঝির আর অবকাশ থাকবে না।
ওই একই বৈঠকে জাতীয় সংগীতও চূড়ান্ত হলো। দুটি কবিতা বিবেচনায় ছিল। একটি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’, অন্যটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’। প্রথমটি আলোচনায় এগিয়ে রইল কিন্তু নেতাদের মধ্যে অনেক আলোচনার পর সবাই একমত হলেন, যেহেতু দ্বিতীয় গানটি মুজিব ভাইয়ের পছন্দ, তাই সেটিই হবে জাতীয় সংগীত।
কে এফ রুস্তামজী: বিএসএফের সাবেক প্রধান।
অনুবাদ: শেখ সাবিহা আলম
কে এম রুস্তামজীর দ্য ব্রিটিশ দ্য ব্যান্ডিক্স এবং দ্য বর্ডারম্যান থেকে ‘লিবারেশন অব বাংলাদেশ’ অধ্যায়ের অংশ বিশেষ।
সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০১১ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত