বিজ্ঞাপন

উপক্রমণিকা

default-image

সময় সময়ের গতিতে চলছে। চলছি আমরাও। সময় কোনো দিন পেছনে ফিরে তাকায় কি না আমার জানা নেই। কিন্তু আমরা যে প্রতিনিয়ত এ কাজটি করি, এতে সন্দেহ নেই। আমরা পেছনে ফিরে তাকাই, তাকাতেই হয় আমাদের। হাতড়িয়ে বেড়াতে হয় স্মৃতির চিত্রপট, মন-মানচিত্র। আমাদের ছোট ছোট জীবনের, ছোট ছোট কথা-কাহিনী, হর্ষ-বিষাদ, আনন্দগান—সবই ফিরে ফিরে আসে বারবার। কিন্তু আমাদের জীবনে (জাতির জীবনেও) কখনো কখনো এমন সব ঘটনা ঘটে যায়, তা প্রতিদিন বা প্রতিক্ষণে ফিরে ফিরে এলেও সেসবের ভার-কলেবর, আকার-প্রকার বা-ব্যাপ্তি এত বিশাল যে এটি ধারণ করার, বহন করার ক্ষমতা সবার সমান থাকে না। অনেকে তা পারেও না। আমি না পারার দলেই।

অথচ ৩৭ বছর ধরে সেই সব স্মৃতি থেকে আমি বিচ্যুত হতে পারিনি। পারিনি নিজেকে আলাদা করতে। অথচ বিশাল এই কষ্টের বোঝা বইতে ও সইতে না পেরে আমি মুক্তি চেয়েছি বারবার। এবং পরিত্রাণের আশা নিয়ে কিছু করার উদ্যোগ নিয়েছি। তা মূলত লেখাই।

আমার সেসব একান্ত চেষ্টার কথা আমি কাউকে কখনো শোনাইনি। তবে এটুকু আমি বুঝে নিয়েছি যে ১৯৭১-এর নয় মাসের যে ঘটনাপুঞ্জ, যে বিভীষিকা, যে নির্মম অত্যাচার ও হত্যাযজ্ঞ ঘটেছিল; লাখ লাখ নিরীহ মানুষ প্রাণ দিয়েছিল এবং এর সামান্য যা কিছু আমি দেখেছি, তা কি সাদা কাগজে লাল বা কালো কালি দিয়ে লিখে প্রকাশ করা যায়? আমি মনে করি, না।

তার পরও কথা থাকে। ব্যক্তিগত কষ্ট, হতাশা ও অক্ষমতা পাশ কাটিয়ে দুকথা বলে যাওয়াতেই বোধকরি আমাদের শক্তি নিহিত। সেই ‘শক্তি’কে সম্বল করেই আমার এই লেখা। সেগুলোকে আমি লেখচিত্রই বলব। কারণ, অবরুদ্ধ ৯ মাসের প্রতিদিনের, প্রতি মুহূর্তের দুর্বিষহ ঘটনাপুঞ্জ ছায়াচিত্রের মতই আমার চারপাশে সারাক্ষণ ঘুরঘর করে। এরই গুটি কয়েক মাত্র এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

হাতে পায়ে ভয়ের কাঁপন

আজ থেকে ৩৭ বছর আগেকার কথা। আমি তখন ২৫-২৬ বছরের উদ্দেশ্যবিহীন এক যুবক। চাকরিতে ঢুকেছি কয়েক বছর। কাজে মন নেই। বন্ধুদের নিয়ে গল্পগুজব আর আড্ডায় দিন কাটে। ঘুরে বেড়াই রাস্তাঘাটে। ১৯৭১-এর মার্চের বেসামাল রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চের তামাশা-প্রহসনের সঙ্গে আমার যেটুকু যোগাযোগ ছিল, তাও সাদামাটা—আর দু-দশটা সাধারণ মানুষের মতোই। পঁচিশে মার্চের রাতেও অন্যান্য দিনের মতো প্যারিস-ফেরত স্থপতি কমল, মাইনুল ও রশীদদের ফার্ম থেকে আড্ডা দিয়ে ঘরে ফিরছিলাম। রাত তখন সাড়ে ১০টা-১১টা হবে। জোহরা মার্কেট থেকে বংশাল রোড। লম্বা রাস্তা। বহু বছর পর আজ যখন পেছনে ফিরে তাকাই, তখন আমার মনে হয় না রিকশার দীর্ঘপথ ভাঙতে ভাঙতে তেমন অস্বাভাবিক কিছু দেখেছিলাম। তবে হ্যাঁ... যেটুকু আজ মনে পড়ে তা হলো: হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের (এখন শেরাটন হোটেল) সামনে, পাশে বড় বড় ঢালাইয়ের স্যুয়ারেজ পাইপ দিয়ে কিছু লোক ব্যারিকেড সৃষ্টি করছে। সেদিন ঘরে ফিরে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম যথারীতি। ঘুমে-তন্দ্রায় সারা রাত আলতো আলতো দেখলাম, মুহুর্মুহু আকাশজুড়ে যেন ফুটছে, জ্বলছে অগণিত আতশবাতি। ছিটিয়ে-ছড়িয়ে পড়ছে চারদিক। আর সঙ্গে বিরতিহীন ফুটফাট শব্দ। তাতে আমার ঘুমের খুব একটা ব্যাঘাত ঘটেনি। ভেবেছি, আশপাশে কোথাও বিয়ের রাত চলছে। যেন রাতভর আনন্দ-উত্সবের মেলা বসেছে।

ঘুম ভাঙল বাবার ডাকে। তিনি উচ্চগ্রামে আকুলি-বিকুলি করে ছুটে আসছেন রাস্তা থেকে। ফজরের নামাজ পড়ে। তিনি একটানা বলে যেতে থাকেন—সর্বনাশ... সব শেষ... রাস্তাঘাটে সব মরা মানুষ পড়ে আছে। নওয়াবপুর পুলিশ ফাঁড়ির সব পুলিশ মেরে ফেলেছে গুলি করে।... হায় হায়, কী হবে... পাক সেনারা...

শার্ট গায়ে দিয়ে রাস্তায় নামি। রাস্তাঘাট সুনসান। কুকুর কাঁদছে টানা সুরে। ডাকছে ভয়ার্ত কাক। লোকজন খুব একটা নেই। যা-ও দু-একজন পথের পাশে দাঁড়িয়ে আছে বা দ্রুতগতিতে কোনো একদিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তাদের চোখে-মুখে আতঙ্ক আর মৃত্যুভয়।

আমি এগিয়ে যাই নওয়াবপুর পুলিশ ফাঁড়ির দিকে। হাতে-পায়ে ভয়ের কাঁপন। বুকে ধড়ফড়ানি। যখন ফাঁড়ির গেটে গিয়ে দাঁড়ালাম, তখন কাঁপন আরও বেড়ে গেল। ফাঁড়ির সামনের আঙিনার চত্বরজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে পুলিশের মৃতদেহ। দু-একজন বাদে সবাই ঘুমের সাধারণ পোশাকে। লুঙ্গি-গেঞ্জি। গড়িয়ে যাওয়া রক্ত তখনো পুরোপুরি শুকিয়ে ওঠেনি। ফাঁড়ির গেটের বাঁ পাশে যে পুলিশ ভাই মরে পড়ে ছিল, তাঁর বগলের নিচে তখনো চেপে ধরে রাখা সাদা কভারের বালিশ। কভারটি কাঁচা হাতের সুচের কাজে সজ্জিত। সহজেই বোঝা যায়, প্রিয়তমা কিংবা বঁধুয়ার সযতন উপহার। ভালোবাসার স্বাক্ষর। কোনায় লেখা—‘সুখে থাক’।

আমাকে থ মেরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পাশ কাটিয়ে যাওয়া এক ফজরের নামাজি জানিয়ে গেল, তাড়াতাড়ি ভাগেন। নওয়াবপুরের বিহারিরা বেরিয়েছে তলোয়ার হাতে। তারা বাঙালি জবাই করছে... আল্লাহু আকবার বলে...

আমি ফিরে আসি বাসায়। অনেকটা ছুটতে ছুটতে।

যে যাত্রায় কোনো আনন্দ নেই

সকালের আলো ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানি সেনারা আবার ফিরে আসে আমাদের মহল্লায়। লরি ভরে ভরে। বংশাল রোডের তেমাথায় তারা লাফিয়ে লাফিয়ে নামে। পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের প্রস্তুতিতে। এদিক-সেদিক এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে কোনার মজ্জু ব্যাপারির (পাড়ার সর্দার) বাড়িতে তেল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় (পরবর্তী সময়ে তাঁর ছেলে মরহুম ফজলুল করিম আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের একজন হয়েছিলেন)।

কারফিউ প্রত্যাহারের পর পাড়াজুড়ে চরম উত্তেজনা ও ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। মহল্লার সবাই প্রায় এদিক-সেদিক পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। আমরাও তাই করি। দু-একজন করে করে শাড়ি পেঁচানো রিকশায় পাড়ি দিই লারমিনী স্ট্রিট, ওয়ারীতে। মালেকাদের বাসায়। দুপুরের দিকে যাচ্ছিলাম খোকন (ডা. সালাহউদ্দিন, সে এখন আমেরিকায় সম্মানিত চিকিত্সক) ও আমি। রিকশা নওয়াবপুর রোড অতিক্রম করার সময় দেখলাম, তখনকার ‘পদ্মনিধি ফার্মেসি’র হিন্দু এক কর্মচারীকে বিহারিরা ড্রেনের পাশে ফেলে জবাই করছে। আর অট্ট-উল্লাসে নাঙ্গা তরবারি তুলে ‘নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবার’ রব তুলছে। তারা সড়ক ধরে ছোটাছুটি করছে, আর পাক সেনাদের লরি থামিয়ে তাদের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয় আর কলেজ ছাত্রী আমার পাঁচ বোনকে (নাজমা, সেলিমা, ফরিদা, শাহানা, নীনা) নিয়ে শহরে থাকা নিরাপদ নয় ভেবে আমরা নৌকাযোগে বেরাইদ হয়ে শীতলক্ষ্যা বেয়ে মামার বাড়ি কাপাসিয়ায় গিয়ে উঠি। মামার বাড়ি আমাদের পরিচিত। তারপরও মনে হচ্ছিল, এ যাত্রায় কোনো আনন্দ নেই। যা আছে তা শুধু হতাশা আর প্রাণে বেঁচে থাকার একমাত্র তাগিদ। এ এলাকার কয়েক গ্রাম ঘিরে শুরু হয় আমাদের শ্বাসরুদ্ধকর, বিভীষিকাময় অবরুদ্ধ এক জীবন। এখন মনে হয়েছে, এ ধারার বুঝি আর শেষ হবে না।

বিরামহীন গুলি

কাপাসিয়া থেকে গাজীপুর সেনানিবাস সড়ক ধরে মাত্র আধা ঘণ্টার পথ। পাকা সড়ক। সেখানে পাক সেনাদের বড় ক্যাম্প, ক্যান্টনমেন্ট। সেখান থেকে তারা যখন-তখন, রাত-বিরাতেও এসে এলাকা জুড়ে চালিয়ে যায় হত্যাযজ্ঞ। পাখির মতো তারা মেরে যায় এলাকার নিরীহ কৃষক, কামলা, গ্রামবাসী। শিশু-কিশোর, বৃদ্ধ। ট্রাকে উঠিয়ে নিয়ে যায় কিশোরী, যুবতী, বধূদের। আর হিন্দুপল্লী হলে তো কথাই নেই। তাদের হত্যা-অত্যাচারের মাত্রা আরও বেড়ে যায় (কাফের মারায় সওয়াব বেশি)।

নানামুখী সাবধানতা নিয়ে টিকে রইলাম কাপাসিয়ায়। কিন্তু একসময় পাক সেনাছাউনি গাজীপুর ছাড়িয়ে এগিয়ে এল কাপাসিয়া পর্যন্ত। কাপাসিয়া হাইস্কুল ঘিরে তারা গড়ে তোলে ক্যাম্প। তখন আমার পাঁচ বোন ও আম্মাকে নিয়ে রাতের অন্ধকারে আমরা পাড়ি জমালাম পিরোজপুরে, আমার ছোট নানীর বাড়িতে। প্রায় সারা রাত হেঁটে খাল-বিল, নদী-নালা, বন-জঙ্গল পেরিয়ে প্রথম পৌঁছেছিলাম ইকুরিয়া (আমার ছোট মামার শ্বশুরবাড়ি)। সেখান থেকে পিরোজপুরে। অভাব, দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও নানি সেদিন আমাদের হাসিমুখে বরণ করেছিলেন। সেখানটার স্থান বড় অসংকুলান ছিল। আমরা মাঝে মাঝে শুতাম গোয়ালঘরে। খড় বিছিয়ে। আমরা ছেলেরা (খোকন, মিন্টু, বকুল ও আমি) মা-বোনদের রেখে আবার ফিরে আসি কাপাসিয়ায়। সে যাত্রায় কয়েকজন নিকট আত্মীয় আমাদের সাহায্য করেছিলেন। তারমধ্যে প্রধান ছিলেন সায়েদ আলী নানা (পরে তিনি মারা পড়েছিলেন)।

তখন মে মাসের মাঝামাঝি। আগের দিন নানি (মেজ নানি) চুপেচাপে কী মনে করে পিঠার গুঁড়ি করে রেখেছিলেন। সেই সময়ের জন্য সেটা খুব স্বাভাবিক ছিল না। অনেক সকালে উঠে তিনি বাইরের চুলায় চিতই পিঠা বানাতে শুরু করলেন। সারা রাত আমরা ভয়ে ভালো ঘুমাতে পারি না বলে একটু দেরিতে উঠে পিঠার আসরে যোগ দিই। হাতে হাতে পিঠা নিয়ে উঠানে গিয়ে বসি। হঠাত্ উত্তরের সুপারিবাগের ফাঁক দিয়ে দেখতে পেলাম, খাকি পোশাকি হেলমেট মাথায় শত শত পাকিস্তানি সেনা এগিয়ে আসছে। গুলি করতে করতে। সবাইকে ইশারায় উঠতে বলে পিঠা ফেলে দক্ষিণ মাঠমুখী দৌড়াতে শুরু করি। এর সঙ্গে আশপাশের দু-দশ বাড়ির লোকজন ততক্ষণে ছুটতে শুরু করেছে ঊর্ধ্বশ্বাসে। দক্ষিণমুখী। আড় চোখে একবার পেছনে ফিরে দেখি, পাক সেনারাও বন্দুক উঁচিয়ে অর্ধচন্দ্রাকারেএগিয়ে আসছে। বিরামহীন চালিয়ে যাচ্ছে গুলি। তখন আমি (অন্য কারও কথা বলতে পারব না) দক্ষিণ মাঠের চড়াই ডিঙিয়ে নেমে পড়েছি। এ সময় পেছনে বেশ কিছু আর্তচিত্কার শুনতে পাই। তবে পেছনে ফিরে তাকানোর কোনো অবস্থা ছিল না আমার।

পরে অবশ্য খোকন, মিন্টু, বকুলের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সেদিন আমরা দৌড়েছিলাম ১০-১২ মাইল। সেই দৌঁড় পথের ম্যাপ আজ আমি নিরূপণ করতে পারবো না। বেঁচে থাকার দৌঁড়ের সময় তা কি মনে থাকে? বহু পথ-ঘাট, হাট-বাজার, নদী-নালা ডিঙিয়ে মা-বোনদের থাকার জায়গা পিরোজপুরে পৌঁছুতে প্রায় সন্ধ্যা লেগে গিয়েছিল। নিদারুণ কষ্টের মধ্যেও আপনজন, মা-বোনদের দেখতে পেয়ে বেঁচে যাওয়ার আনন্দের অর্থ উপলব্ধি করেছিলাম সেদিন। তারপর সামান্য কিছু মুখে দিয়ে গোয়ালঘরের খড়ের ওপর লুটিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভেঙেছিল দেড় দিন পর। সারা গায়ে তখন প্রচণ্ড ব্যথা। পায়ে জ্বালা।

উপসংহার

এমনি ধারার আরও অনেক খণ্ডচিত্র রয়ে গেল। হয়তো সেসব বলাও হয়ে উঠবে না কোনো দিন। তবে না বলতে পারার অভিব্যক্তিতে অনেক সময় বলা হয়ে যায় কিছু কথা। সেই আশা নিয়েই আমাদের এগিয়ে চলা। আমার বিশ্বাস, তাতেই বেড়ে উঠবে, জেগে উঠবে আমাদের আগামী প্রজন্ম।

সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০০৮ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত