১৯৭১ সালের এপ্রিল মাস। আমার বয়স তখন ২০ বছর। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। খবর পেলাম, ২ নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম চৌধুরী মানিকগঞ্জের হরিরামপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প খুলেছেন। মা-বাবাকে না বলেই ওই ক্যাম্পে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করি।
প্রথম দিনই তিনি অস্ত্র তুলে দিলেন আমার হাতে। এরপর আর বাড়ি ফেরা হয়নি। দিন কয়েক প্রশিক্ষণ নিয়ে নেমে পড়লাম পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে। আমি যুদ্ধ করেছি ঢাকার নবাবগঞ্জের জয়পাড়া থেকে মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার পাটুরিয়া ঘাট পর্যন্ত ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে। আমাদের মূল দায়িত্ব ছিল যমুনা ও পদ্মা নদীর তীর এলাকায় থেকে নৌপথে আসা শত্রুসেনাদের নৌযানগুলো ধ্বংস করা। তবে স্থলভাগেও আমরা একাধিক যুদ্ধে অংশ নিয়েছি। আমি রেকির (গোয়েন্দা) কাজও করতাম। হরিরামপুর থানায় পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে প্রায়ই পাঞ্জাবি টুপি পরে মাছের খালইয়ে করে ডিম আর বালতিতে করে দুধ বিক্রি করতে যেতাম। নিয়মিত যাওয়া-আসার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি সেনারা কে কোথায় থাকে, কোথায় অস্ত্র রাখা আছে, ক্যাম্পের সদস্যসংখ্যা কত, কী কী অস্ত্র আছে এবং কীভাবে বাংকার কাটা হয়েছে—এসব দেখে এসে নিজ ক্যাম্পে খবর পৌঁছে দিতাম। পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে যাওয়া-আসা করতে করতে তিন বালুচ সেনার সঙ্গে আমার সখ্যও গড়ে উঠেছিল। তারাও আমাদের গোপন তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছে।
আমার প্রথম এবং বড় যুদ্ধ পদ্মা নদীর তীরবর্তী হরিরামপুর থানা ক্যাম্পেই। এর আগে চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের অনেক নৌকা নদীতে ডুবিয়ে দিয়েছি। ওই ক্যাম্পে যেদিন আক্রমণ চালানো হয়, তার কয়েক দিন আগে কীভাবে, কখন এবং কোন দিক থেকে হামলা চালাতে হবে, সে সম্পর্কে ধারণা দিয়েছিলেন আমাদের বন্ধু তিন পাকিস্তানি সেনা। অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে বিকেল তিনটার দিকে আমরা অতর্কিত আক্রমণ চালাই হরিরামপুর ক্যাম্পে। রাইফেল, থ্রি নট থ্রি ও হালকা মেশিনগান নিয়ে আমরা ওই যুদ্ধে অংশ নিই। ওই যুদ্ধে সেই তিন পাকিস্তানি সেনাও আত্মপক্ষ ত্যাগ করে আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়। যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরই হাতিয়ারসহ ক্রলিং করে তারা আমাদের কাছে চলে আসে। আগে থেকেই জানা থাকার কারণে আমারা তাদের নিরাপদে আসতে দিই। ওই যুদ্ধে ৯৬ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।
দ্বিতীয় যুদ্ধ হয় পাটুরিয়া ঘাটের অদূরে শিবালয়ের দাসকান্দি এলাকায়। আমরা তখন শিবালয়ের নালী ক্যাম্পে (অগ্রবর্তী ক্যাম্প) সকালের নাশতা খেতে বসেছি। এমন সময় খবর পেলাম, তিনটি বড় নৌকা করে পাকিস্তানি সেনারা আসছে আমাদের আক্রমণ করতে। নাশতা করা বাদ দিয়ে আমরা এগোতে থাকি যমুনার দিকে। নদীতীরবর্তী এলাকায় গিয়ে শত্রুসেনাদের দেখতে পাই। যে যার মতো অবস্থান নিই আক্রমণ করার জন্য। শত্রুসেনাদের নৌকা তিনটি তীরের কাছাকাছি আসার পরপরই আমরা আক্রমণ চালাই। এরপর দুটি নৌকায় করে পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটে যায়। অপর একটি নৌকায় থাকা পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ হয়। সেদিন মাত্র ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম। ওই যুদ্ধে ৩৫ জন পাকিস্তানি সেনা প্রাণ হারায়। আর আমাদের এক সহযোদ্ধা ইদ্রিস আলী বিশ্বাস গুরুতর আহত হয়েছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধে জয়ী হয়েও জীবনযুদ্ধে আমি অনেকটাই পরাজিত। অনেক স্বপ্ন নিয়ে যুদ্ধে গিয়েছিলাম। যুদ্ধ আমাদের স্বাধীন একটা ভূখণ্ড দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু অর্থনৈতিক কোনো উন্নতি হয়নি। অর্থের অভাবে আমার তিন মেয়ে ও দুই ছেলের কাউকে লেখাপড়া করাতে পারিনি। অনেক কষ্ট করে মেয়েদের বিয়ে দিলেও ছেলেরা কাজ করে অন্যের বাড়িতে। মাথা গোঁজার মতো ৩৩ শতাংশের এক টুকরো ভিটেবাড়ি ছাড়া আমার আর কিছুই নেই।
অনুলিখন: অরূপ রায়, মানিকগঞ্জ
সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০১০ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত