বিজ্ঞাপন
default-image

আমার বাবার নাম রবি নিয়োগী, স্বামী অশোক দাশগুপ্ত। আমার বর্তমান ঠিকানা উত্তর চাষাঢ়া, জেলা নারায়ণগঞ্জ। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল ২৪-২৫।

১৯৭১ সালে আমি আমার বাবা-মায়ের সঙ্গে বর্তমান শেরপুর জেলার সদরে বসবাস করতাম। এই জেলা তখন ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত একটি মহকুমা ছিল। আমার বাবা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন।

এপ্রিল মাস শুরু হওয়ার কিছু পর পাকিস্তানি আর্মি শেরপুরে চলে আসে। তখন আমরা অনেকে একসঙ্গে বর্ডারের দিকে চলে যাই। ২৫ মাইল দূরেই ছিল বর্ডার। সীমান্ত অতিক্রম করে আমরা গারো এলাকায় আশ্রয় নিই। কয়েক দিন পর বাবা আমাকে বললেন, ‘তুমি গান জানো, কলকাতার লেনিন সরণিতে মুক্তিযুদ্ধ সহায়ক সমিতি হয়েছে, তুমি সেখানে গিয়ে তাদের সঙ্গে যোগ দাও।’ তখন আমি ও আমার বড় ভাই রঞ্জিত নিয়োগী দুজন মিলে কলকাতায় চলে গেলাম। বাবা-মা রয়ে গেলেন বর্ডারের পার্শ্ববর্তী রায়পাড়ায়। তখনো কিন্তু ওই এলাকায় আওয়ামী লীগের প্রভাব তেমন ছিল না। তাদের হয়ে কমিউনিস্ট পার্টির লোকেরাই সেটা করেছে। কারণ ওই এলাকায় কমিউনিস্ট পার্টির গ্রহণযোগ্যতাই বেশি ছিল।

কলকাতায় পৌঁছে আমরা লেনিন সরণিতে যাই। দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায় নামের ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির একজন ছিলেন ওখানে। তিনি সার্বক্ষণিক সহায়ক সমিতি দেখাশোনা করতেন। ওখানে বাংলাদেশের বেশ কিছু শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী এবং গানের লোকজন জড়ো হয়েছিল। বিধান সরণিতে তাদের থাকার জন্য একটা বাসা ছিল। দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলাদেশের সন্জীদা খাতুন, পরবর্তী সময়ে ওয়াহিদুল হক বাংলাদেশ থেকে আগত শিল্পীদের দেখাশোনা করতেন। বেণু ভাইও ছিলেন। তাঁরা আমাকে ওই দলে অন্তর্ভুক্ত করে নেন। ওখানে গান রিহার্সাল হতো। আমরা সকাল ১০টার দিকে যেতাম। আমাদের শরণার্থী শিবিরে বা অন্য কোথাও যেতে হতো। সেখানে গান গাইতাম। কোনো ঠিক ছিল না কখন কোথায় যেতে হবে।

আমি লেনিন সরণিতে যাওয়ার পর আমাকে ১০ টাকার একটা শাড়ি আর দুই টাকার একটা ব্লাউজ দেওয়া হয়। ওটা রোজই পরে যেতাম। প্রতিদিন রাতে সেটা ধুয়ে শুকিয়ে কোনো রকমে ভাঁজ করে পরদিন আবার পরে চলে যেতাম। ওই একটাই শাড়ি ছিল আমাদের একাত্তরে। এটা পরেই আমরা বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠান করেছি এবং বিভিন্ন জায়গায় বড় বড় শিল্পীর সঙ্গে গান করে টাকা তুলেছি। বড় বড় শিল্পী অনুষ্ঠানে গান গাইতেন। তাঁদের সঙ্গে আমরাও গান গাইতাম। প্রথম প্রথম আমার ভয় লাগত। ভাবতাম এত বড় বড় শিল্পী গান গাইছেন, আমরা এখানে কী গাইব! তখন অবশ্য আমাদের গ্রহণযোগ্যতা খুবই ছিল।

সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০১০ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত