বিজ্ঞাপন
default-image

সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর আমি পরিষ্কার বুঝেছিলাম, ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা দেবে না আওয়ামী লীগের হাতে। বাঙালির জীবনে অনিবার্যভাবে নেমে আসছে সশস্ত্র যুদ্ধ। বিষয়টি নিয়ে ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে স্বাধীনতার ইশতেহারের পাঠক ও বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলীর সঙ্গে কথাও বলেছিলাম। বলেছিলাম যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে। কিন্তু তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।

আনসার ও মুজাহিদ বাহিনীর দুই দফা প্রশিক্ষণ আমার আগেই নেওয়া ছিল। দিনাজপুরের উপশহর এলাকায় বর্তমানে তফির উদ্দিন মেমোরিয়াল স্কুলমাঠে ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকেই নিজে উদ্যোগ নিয়ে ৩০ জন যুবককে একত্র করে ডামি রাইফেল দিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ শুরু করি। পরবর্তী সময় প্রশিক্ষণ ক্যাম্পটি নিয়ে যাওয়া হয় শহরের দক্ষিণে কেবিএম কলেজে। সেখানে আনসার-মুজাহিদসহ শতাধিক যুবক প্রশিক্ষণে অংশ নেয়। ২৮ মার্চ বিকেল থেকে প্রচণ্ড সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে রাতে স্থানীয় ইপিআর ক্যাম্প কুঠিবাড়ী আক্রমণ ও দখল করে বীর বাঙালিরা। এখানে অনেক পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। বাকিরা পালিয়ে যায় সৈয়দপুরে। কুঠিবাড়ী অস্ত্রাগার থেকে বের করে আনা বিপুল পরিমাণ অস্ত্র নিজেদের অধীন হয়। পরবর্তীকালে সেই অস্ত্র দিয়ে কেবিএম কলেজে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রসহ প্রশিক্ষণ শুরু করি।

১৩ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনারা আবার দিনাজপুর দখল করে নেয়। বিষয়টি আগেই অনুমান করতে পারি। আগের দিনই অস্ত্রসহ ক্যাম্পটি সরিয়ে প্রথমে চেরাডাঙ্গী স্কুলে এবং এরপর আমার গ্রামের বাড়ি সদর উপজেলার ১০ নম্বর কমলপুর ইউনিয়নের বড়গ্রাম গ্রামের ভাতখৈর নামে একটি পাড়ায় নেওয়া হয়। ওই ক্যাম্পের অধীন যেসব বিশিষ্ট ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন মহিউদ্দিন মাস্টার, অধ্যাপক মো. ছফর আলী, মজু খান, নাদের আলী প্রমুখ।

একপর্যায়ে ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেড়ে চার শতাধিক হয়। জুন মাসে যুদ্ধের তীব্রতা বেড়ে যায়। নিরাপত্তার কথা ভেবে জুলাই মাসে ক্যাম্পটি সরিয়ে ভারতীয় ভূখণ্ডের ভেতরে কুমারগঞ্জ থানার এলান্দর গ্রামের একটি আদিবাসী পল্লিতে নেওয়া হয়। অদূরেই ছিল ভারতীয় বিএসএফের আঙ্গিনাবাদ ক্যাম্প। আমি সেই ক্যাম্পে গিয়ে অধিনায়ক রণজিত্ সিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করে এলান্দর থেকে যুদ্ধ করার অনুমতি এবং সহযোগিতা চাই। তিনি সম্মতি দিলেও সহযোগিতার ব্যাপারে নিশ্চুপ রইলেন। আগস্ট মাসে বদলি হয়ে গেলেন রণজিত্ সিং। তাঁর পরিবর্তে এলেন ভারতের ১৭ মাউন্টেন ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক সালোওয়ান সিং বাট (এস এস বাট)। তাঁর সঙ্গে সখ্য হয়। তিনি ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রয়োজনীয় অস্ত্র-গোলাবারুদ এমনকি রেশন দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। আমরা নতুন উদ্যমে যুদ্ধাভিযান শুরু করি।

বড়গ্রাম, বকশীদীঘি, পাতলশা, মালিগ্রাম, শংকরপুর, পাঁচবাড়ী, ত্রিশুল্লা, বনতাড়া, মোহনপুর, খানপুর, মুরাদপুরসহ সংশ্লিষ্ট এলাকায় অসংখ্য যুদ্ধ হয়।

দেশ স্বাধীন হলো। প্রবল আশা নিয়ে দেশ গড়ার কাজ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু চরম বিস্ময়ের সঙ্গে দেখলাম, আমার মতো বেশার মাস্টারের বুদ্ধি-পরামর্শ গ্রহণ বা কাজে লাগানোর মানুষ নেই। সময় বয়ে গেল হতাশার মধ্যেই। দেশের মানুষ যে স্বাধীন বাংলাদেশ চেয়েছিল, তা অধরাই থেকে গেল।

অনুলিখন: আসাদুল্লাহ্ সরকার, দিনাজপুর

সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০১০ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত