বিজ্ঞাপন
default-image

২৫ মার্চ, ১৯৭১ সাল। বৃহস্পতিবার। অন্যান্য দিনের মতো সকাল সাতটায় আমি আমার অফিসে গেলাম। সেখানে পৌঁছে দেখি পশ্চিম পাকিস্তানি মেজর ইকবাল বসে আছেন। তিনি আমাকে দেখেই বললেন, ‘মি. রফিক, আপনাকে দারুণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। অনেক খাটুনি গেছে আপনার ওপর দিয়ে। কক্সবাজার গিয়ে কয়েক দিন বিশ্রাম নিন না কেন? ইচ্ছা হলে আজই যেতে পারেন। আমি কমান্ডিং অফিসারকে বলে দেব।’

আমি তাঁর কথায় তাল না দিয়ে প্রসঙ্গ পরিবর্তনের জন্য বললাম, ‘আপনি বোধ করি জানেন, গতকাল পোর্ট এলাকায় জনতার ওপর সেনারা গুলি চালিয়েছে, অনেক লোক মারা গেছে।’

‘অনেক নয়’—যেন তেমন কিছুই ঘটেনি এমন ভাব দেখিয়ে তিনি বললেন, ‘মাত্র একজন কিংবা দুজন আহত হয়েছে।’

আমি যেন এক অলৌকিক সাহস অনুভব করলাম। মনে হলো, আমার ভেতর থেকে কে যেন আমাকে বলছে, আমার নিজের জীবন এবং আমাদের অন্যান্যের জীবন রক্ষার জন্য এ পশুশক্তির বিরুদ্ধে অবশ্যই ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এরপর আমি ‘হয় স্বাধীনতা অর্জন, না-হয় ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যু’ এ ধরনের এক চরম সিদ্ধান্ত নিলাম। ডা. জাফরকে বললাম, ‘আমাদের জনগণকে মুক্ত করার জন্য পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে আমি আমার ইপিআর সেনাদের নিয়ে যুদ্ধ করব। আপনারা ষোলশহরে এবং ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে বাঙালি সেনাদের আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে বলুন। তারপর রেলওয়ে হিলে আমার সদর দপ্তরে দেখা করবেন।’

খাওয়া থেকে উঠেই আমি হালিশহরে ইপিআর সদর দপ্তরে ফোন করলাম। সেখানে বাঙালি জেসিওরা আমার নির্দেশের অপেক্ষাতেই ছিলেন। তাঁদের বললাম, ‘এক্ষুনি সব ফাঁড়িতে দ্বিতীয় সাংকেতিক বার্তাটি পাঠিয়ে দিন। অস্ত্রাগার নিয়ন্ত্রণে রাখবেন। পাকিস্তানি সেনাদের রুম থেকে বের হতে দেবেন না। নৌবাহিনী সদর দপ্তরের দিক থেকে হামলা হতে পারে। সেদিকে প্রতিরক্ষামূলক কিছু সেনা মোতায়েনের ব্যবস্থা করুন। আমি আসছি।’

রাত তখন আটটা ৪৫ মিনিট। আমি শেষবারের মতো আমার সারসন রোডের বাসভবন ত্যাগ করলাম। আমাদের প্রথম লক্ষ্যস্থল ওয়্যারলেস কলোনির দিকে। আমাদের গাড়ি ছুটে চলল। আমার পাশে ড্রাইভার কালাম এবং পেছনের সিটে দুজন রক্ষী। তীব্র উত্তেজনায় সবাই ঠোঁট কামড়াচ্ছিল। রাস্তা জনমানবশূন্য। আমাদের গাড়ি যতই ওয়্যারলেস কলোনির কিংবা নৌবাহিনী সদর দপ্তর থেকে পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের প্রচেষ্টা বানচাল করে ছুটে আসতে পারে।

ওয়্যারলেস স্টেশনের গেটে পৌঁছাতেই প্রহরারত সান্ত্রি জিপ থামিয়ে দিল। বাঙালি সান্ত্রি প্রহরায় ছিল। সে আমার জিপটি ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দিল। আমরা ক্যাপ্টেন হায়াতের রুমের সামনে গিয়ে জিপ থামালাম। সেখানেও একজন সান্ত্রি পাহারা দিচ্ছিল।

সাবধানে আমি হায়াতের কক্ষের দিকে এগিয়ে গেলাম। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে মারাত্মক কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে, হয় সফল হব, না-হয় আমার মাথা ভেদ করে একটা বুলেট বেরিয়ে যাবে। শেষেরটি সত্যি হলে চট্টগ্রামের ইপিআর সেনা পরিচালনা করতে আর কোনো বাঙালি অফিসার থাকবে না। এই চিন্তা আমাকে কিছুটা বিহ্বল করে তুলছে ক্ষণিকের জন্য।

আমি খুব আস্তে দরজায় নক করলাম এবং বন্ধুসুলভ গলায় বললাম, ‘হ্যালো, হায়াত ঘুমিয়ে পড়েছ নাকি?’

‘এই কেবল শুয়েছি, স্যার।’ আমার গলার স্বর চিনতে পেরে সে আলো জ্বালাল। জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে আমি দেখলাম, বালিশের তলা থেকে কী যেন একটা নিয়ে সে তার শোবার পোশাকের নিচে রাখছে। দরজা খোলার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘সবকিছু ঠিকঠাক আছে তো।’

‘সব ঠিকঠাক হ্যায়’, জবাব দিয়েই সে দরজা খুলল।...

আমি স্টেনগান তার বুকের ওপর ধরে বললাম, ‘আমি দুঃখিত, হায়াত, তোমাকে গ্রেপ্তার করতে হচ্ছে।’ হঠাত্ সে তার পিস্তল বের করার উদ্যোগ নিতেই ড্রাইভার কালাম দ্রুত এগিয়ে আসে এবং দুজনেই হায়াতের মাথায় আঘাত করি। সঙ্গে সঙ্গে আমরা তার হাত ও মুখ বেঁধে ফেললাম এবং টেলিফোনের তার কেটে দিলাম। তারপর পাশের ব্যারাকে ঘুমন্ত সুবেদার হাসমতকে ডেকে আনার জন্য লোক পাঠালাম। সুবেদার হাসমত চোখ মুছতে মুছতে উঠে এসে স্যালুট দিয়ে দাঁড়াতেই কালাম ও অন্য প্রহরীরা তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। হাসমতকে আটক করে তার হাত ও মুখ বেঁধে ফেলা হলো।...

হালিশহর ত্যাগের আগে বন্দীদের একটি ভবনে কঠোর প্রহরাধীনে রাখার এবং ‘শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ’ করে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়ে রাত ১১টা ৪৫ মিনিটের মধ্যে আমি রেলওয়ে হিলের সদর দপ্তরে পৌঁছালাম। এখানে পৌঁছে নৌবাহিনীর সদর দপ্তর, পোর্ট এলাকা এবং বিমানবন্দরের ওপর আক্রমণ চালানোর উদ্দেশ্যে সীমান্ত এলাকার সেনাদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমি ভেবেছিলাম, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার এবং ষোলশহরে মোতায়েন ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সেনারা ক্যান্টনমেন্ট দখল করতে সক্ষম হবে। রেজিমেন্টাল সেন্টারের কমান্ডে ছিলেন লে. কর্নেল চৌধুরী এবং ৮ ইস্ট বেঙ্গলে ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান। এ দুই জায়গায় বাঙালি সেনাদের সংখ্যা ছিল প্রায় দুই হাজার এবং পশ্চিম পাকিস্তানি সেনা ছিল আনুমানিক ৪০০।

default-image

ইতিমধ্যে রেলওয়ে হিলে প্রতিরক্ষায় আমার ইপিআর প্লাটুনগুলোকে সুসংগঠিত করে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য এই পাহাড়েরই একটি আবাসিক ভবনের নিচতলায় আমরা সদর দপ্তর স্থাপন করলাম।...

প্রাথমিক সাফল্যের পর রাত ১১টা ৪৫ মিনিটের দিকে আমি ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের সেনাদের সাফল্যের খবর শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম।

চট্টগ্রাম, ২৬ মার্চ।

আমার দপ্তরে টেলিফোনে খবর এল যে পাকিস্তানি সেনারা নৌঘাট থেকে অগ্রসর হয়ে হালিশহরে আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যূহের ওপর আক্রমণ করেছে। ইপিআর ট্রুপস এই আক্রমণ প্রতিহত করে। শত্রুদের প্রচুর হতাহত হয়। পাকিস্তানিরা হালিশহরে কোনো বাধা আশা করেনি। সংগঠিত প্রতিরোধ মোকাবিলার জন্য তারা প্রস্তুতই ছিল না। তাদের অগ্রবর্তী দলটি হালিশহরের প্রথম প্রতিরক্ষা ব্যূহের সমুখীন হতেই আমাদের সেনারা পাকিস্তানিদের লক্ষ্য করে গুলি চালাল। পাকিস্তানিরা ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় হয়ে পড়ে। বহু সংখ্যক হতাহত হলো। অবশেষে তারা পিছু হটতে বাধ্য হলো। এ সময়ে অপর এক টেলিফোনে জানলাম, ৮০ থেকে ১০০টি যানের বিরাট একটি কনভয় কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রামের পথে রওনা হয়েছে। কুমিল্লা থেকে মেজর বাহার চট্টগ্রাম টেলিফোন অপারেটরকে এ কথা জানালে সে তত্ক্ষণাত্ আমাকে তা অবহিত করে। সংবাদ পাওয়ার পর পরই আমি পাকিস্তানি কলামটিকে অ্যামবুশ করার জন্য একজন জেসিওর নেতৃত্বে হালিশহর থেকে এক কোম্পানি সৈন্য পাঠালাম। হালকা মেশিনগান এবং ভারী মেশিনগান ছাড়াও কোম্পানিটির সঙ্গে ছিল ৩ মর্টার ও রকেট লঞ্চার অপারেশনাল কমান্ডার সুবেদার মুসা যাত্রার প্রাক্কালে আমাকে টেলিফোন করে বললেন, ‘আমাদের সাফল্যের জন্য দোয়া করবেন, স্যার।’

‘সকল দেশবাসী আপনাদের জন্য দোয়া করছে। যুদ্ধ চালিয়ে যান, মাতৃভূমিকে মুক্ত করুন।’ আমার গলার স্বর ছিল আবেগে উদ্বেলিত।

মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তম: সাংসদ ও সাবেক মন্ত্রী।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ, দলিলপত্র, নবম খণ্ড

আজকের অনুভূতি

নতুন প্রজন্মই ভরসা

মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে গিয়ে আজ আমরা অনেকেই অনেক কথা বলি। কিন্তু ১৯৭১ সালে আমাদের মূল স্বপ্ন ছিল একটাই। তা হলো, যেভাবেই হোক দেশকে শত্রুমুক্ত করতে হবে। পাকিস্তানি সেনারা আমাদের দেশে অত্যাচার-নির্যাতন করছে, গণহত্যা চালাচ্ছে। এদের হাত থেকে দেশের মানুষকে বাঁচাতে হবে। দেশকে শত্রুমুক্ত করে নিজেরাই দেশটার দায়িত্ব নেব। আমাদের দেশ আমরা চালনা করব। আমাদের ভাগ্য আমরাই নির্ধারণ করব। এই ছিল আমাদের তখনকার মূল প্রত্যয়। পাকিস্তানিদের দীর্ঘ শোষণ-বঞ্চনার মধ্য দিয়ে আমরা অনুধাবন করেছিলাম আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষ তখন দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল। গণতন্ত্রের পরিবেশ ছিল না। সত্যিকার গণতন্ত্র না থাকলে একটি দেশের পক্ষে অগ্রগতি অর্জন করা কঠিন। তাই দেশকে শত্রুমুক্ত করার পাশাপাশি আমরা চেয়েছিলাম অর্থনৈতিক মুক্তি, যাতে দেশের গরিব মানুষ অর্থনৈতিক মুক্তি পায়? দারিদ্র্যসীমা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। দারিদ্র্যের অভিশাপ যেন তাদের জীবন ধ্বংস না করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এর বেশি আর অন্য কোনো চিন্তা আমাদের ছিল না। আমরা চাচ্ছিলাম দেশ দ্রুত শত্রুমুক্ত হোক। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের সময় দ্রুততার সঙ্গে সবকিছু ঘটেছে। তখন আমরা যাঁরা যুদ্ধ করছি, তাঁদের বেশির ভাগ পরিবার ছিল দেশে। তাঁদের কাছ থেকে আমরা নানা খবর পাচ্ছি। গণহত্যার খবর পাচ্ছি।

একদিকে যুদ্ধ, অন্যদিকে আমাদের পরিবারের কী খোঁজখবর, পারিবারিক নিরাপত্তা, নিজেদের নিরাপত্তা—এর বাইরে অন্য কিছু নিয়ে চিন্তার অবকাশ ছিল না। আর একটি কথা, পাকিস্তানিদের অপশাসন কিন্তু আমাদের মন-মানসিকতাকে আগেই তৈরি করেছে। রাজনৈতিকভাবে আমরা সচেতন হয়েছি। এই সচেতনতাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নিয়ে এসেছে। আমরা কিন্তু জনগণকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছি। আমরা যাঁরা সেনাবাহিনীতে ছিলাম এবং নিয়মিত যে বাহিনী, তারা তথাকথিত সেনাবাহিনী ছিল না। জনগণের সেনাবাহিনী ছিল। জনগণ ও সেনাবাহিনী মিলেই মুক্তিযোদ্ধা। আমরা নিয়মিত বাহিনীর যাঁরা, সবাই মুক্তিযোদ্ধা।

স্বাধীনতার ৪০ বছর পর এসে দেখি আমাদের অর্জন অবশ্যই আছে। অর্জনগুলো মূলত হয়েছে অবকাঠামো খাতে, শিক্ষাক্ষেত্রে, স্বাস্থ্যক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। দেশের বিপুলসংখ্যক লোক বিদেশে। তাঁরা বিদেশে চাকরি করছেন। তাঁরা টাকা পাঠাচ্ছেন দেশে, এই টাকা দিয়ে বাংলাদেশে অনেক কাজ হচ্ছে। বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে এটা হতো না। তবে কতগুলো জায়গায় হতাশাও আছে। নারীরা অনেক এগিয়েছেন। তার পরও তাঁরা পিছিয়ে আছেন। তাঁদের অগ্রগতি যথেষ্ট নয়। ১৯৭১ সালে আমরা গোটা জাতি ঐক্যবদ্ধ ছিলাম। স্বাধীনতার পর কোনো না কোনো কারণে আমাদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছে। রাজনৈতিক কারণে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। আগে আমাদের প্রতিপক্ষ ছিল পাকিস্তানিরা। আর এখন যেহেতু বিশেষ শত্রু নেই, তাই আমরা নিজেদের মধ্যে শত্রু তৈরি করছি। পরস্পর প্রতিপক্ষ হয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে কাজ করছি। এটা আমাদের জাতিকে অনেক পিছিয়ে দিচ্ছে। আমরা চেয়েছিলাম ধর্ম নিয়ে যেন কোনো রাজনীতি না হয়। ধর্ম নিয়ে যেন কেউ রাজনীতি বা ব্যবসা না করতে পারে। অসাম্প্রদায়িক যে চেতনা, তা থেকে আমরা দূরে সরে যাচ্ছি। আমাদের মন-মানসিকতায় প্রত্যাশিত পরিবর্তন হয়নি। এই পরিবর্তন যতটা প্রত্যাশিত ছিল, ততটা হয়নি। তার পরও আমি ভবিষ্যত্ বাংলাদেশের ব্যাপারে আশাবাদী। নতুন প্রজন্ম যারা আগামী ১০-১৫ বছর পর দেশের শাসনক্ষমতা হাতে নেবে, তারা নিশ্চয় দেশকে অনেক দূর এগিয়ে নেবে।