২২ মার্চ ২০০১ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের পঞ্চম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ‘যুদ্ধাপরাধের বিচার ও সভ্যতা’ শীর্ষক প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর বক্তৃতায় আমি বলি, ‘উনিশ শ একাত্তরের আগে ২০০ বছরের অধিককাল ধরে আমাদের দেশে তেমন কোনো বড় যুদ্ধ হয়নি। যুদ্ধ ও ন্যায়যুদ্ধ পক্ষে-বিপক্ষে কিছু তত্ত্বাবধানে হয়েছে বেশ প্রাচীনকাল থেকে। কোরআন শরিফে বলা হয়েছে, যারা আক্রান্ত হয়েছে তাদের যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হলো। কারণ, তাদের প্রতি জুলুম করা হয়েছে। বিরোধ-নিষ্পাদনের একটি প্রক্রিয়া হিসেবে যুদ্ধের একধরনের স্বীকৃতি ছিল বহুদিন আগে থেকেই।’
২২ ডিসেম্বর ১৯৭১ মুজিবনগরে মন্ত্রিসভার শীর্ষস্থানীয় সদস্যরা রাজধানী ঢাকায় ফিরে আসেন। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলছেন, ‘তার দুই দিন আগে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে দুটো বিষয়ে কথা হয়েছিল। একটি ছিল বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রসঙ্গ ধরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দোসরদের শাস্তি দেওয়ার বিষয়। তিনি বলেছিলেন, চেষ্টার ত্রুটি হবে না, তবে কাজটি সহজ হবে না। আমি জানতে চাই, কেন? তিনি বলেন, যুদ্ধবন্দী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাউকে বিচার করা সম্ভবপর হবে বলে তিনি মনে করেন না। আমি আবার জানতে চাই, কেন? তিনি বলেন, মার্কিনিদের চাপ আছে। তারা পাকিস্তানকে চাপ দিচ্ছে বঙ্গবন্ধুকে ছেড়ে দিতে, ভারতকে চাপ দিচ্ছে যুদ্ধবন্দীদের ছেড়ে দিয়ে উপমহাদেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে তুলতে। তিনি আরও বলেন, যুদ্ধবন্দীদের বিচারে সোভিয়েত ইউনিয়ন ইচ্ছুক নয়, ভারতও উত্সাহী নয়। এ অবস্থায় কার জোরে আপনি বিচার করবেন? আর মূল অপরাধীদের বিচার না করতে পারলে তাদের সাঙ্গপাঙ্গদের বিচারের প্রক্রিয়া দুর্বল হয়ে যেতে বাধ্য।’
২৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামরুজ্জামান বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধীরা বিচারের হাত থেকে বাঁচতে পারবে না।’ ২৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর যেসব অফিসার অসামরিক লোকদের হত্যা, নারী ধর্ষণ ইত্যাদি অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের বিচারের সম্মুখীন হতে হবে।’
এ সম্পর্কে ফখরুদ্দীন আহমদ তাঁর উত্তাল তরঙ্গের দিনগুলিতে লিখেছেন, ‘কিন্তু সেটা ছিল একটা বিবৃতি মাত্র।’ তাঁর কথা, ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে মুজিবনগর সরকারের দলিলপত্রে কোনো নীতিমালাই আমি খুঁজে পাইনি। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের আগে এ ব্যাপারে ভারত সরকারের সঙ্গে কোনো সমঝোতা হয়ে থাকতে পারে।’
মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে আমরা যতটা আবেগাপ্লুত হই, ততটা চেতনাপ্রাপ্ত হই না। মুক্তিযুদ্ধকে যখন গৃহযুদ্ধ বলা হয়, তখন তা তথ্যগতভাবে সত্য হতে পারে, বিশেষ করে তার কাছে, বাংলাদেশের প্রতি যার কোনো আনুগত্য নেই। আর যুদ্ধ বা গৃহযুদ্ধ শুরু হলেও শেষ হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে জয়োল্লাসে। এই জয়োল্লাসে বাংলাদেশের অন্তত এক-তৃতীয়াংশ লোক খুশি হয়নি। ভারতবিরোধী শঙ্কা তাদের মনে কাজ করে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়ে আমরা সেই নুলার মতো ব্যবহার করি যে ঢাকার দাঙ্গার সময় বলে, ‘আমি কী করমু? আমি তো চাকু চালাইতে পারমু না।’ তাকে বলা হয়, ‘তুই ছাদে যা। ছাদে গিয়া মুখ খিস্তি করে গাল পাড়।’
আমাদের এই জানাশোনার দেশে জ্ঞাতিগোষ্ঠীদের প্রতি দুর্বলতার কারণে এই বিচারের ক্ষেত্রে প্রথম থেকেই দোলাচলতা দেখা গেছে। যখন সবচেয়ে বেশি সুযোগ ছিল, তখনো সম্ভব হয়নি। ৩ জুলাই ১৯৯৯ ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার: এ প্রজন্মের ভাবনা’ শীর্ষক এক আলোচনায় প্রবীণ সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্ত সাত-পাঁচ ভেবে বলেন, ‘মাত্র ৩৭ শতাংশ ভোট পেয়ে যারা নির্বাচিত হয়েছে, তাদের পক্ষে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা অসম্ভব।’
যুদ্ধ ও ন্যায্যযুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষে কিছু মানবতাবাদী তত্ত্বের আলোচনা শুরু হয়েছে বেশ প্রাচীনকাল থেকে। বাংলা ভাষার বনেদি অভিধানে ‘যুদ্ধ’ শব্দের সঙ্গে সন্ধি করে বিভিন্ন শব্দ থাকলেও ‘যুদ্ধাপরাধ’ কথাটার কোনো উল্লেখ নেই। কথাটা আমরা ‘ওঅর-ক্রাইম’ (warcrime)-এর তরজমা করে পেয়েছি। ওঅর-ক্রাইম কথাটা প্রথম ব্যবহূত হয় ইংরেজি ১৯০৬ সালে। ‘ওঅর’ শব্দটা চলে আসছে দ্বাদশ শতাব্দী থেকে।
মিত্রশক্তির বোমারু বৈমানিকেরা জার্মানির বেসামরিক লক্ষ্যবস্তু ও অযুধ্যমান নাগরিকের ওপর বোমাবর্ষণ করে একধরনের যুদ্ধাপরাধ করেছিল। প্রথম মহাযুদ্ধের নৃশংসতা বিশ্বের মানবচিত্তে তেমন আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারেনি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর তিন ধরনের যুদ্ধাপরাধ আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী বলে বিবেচিত হচ্ছে। ১৯৪৯ সালের জেনেভা কনভেনশনস আন্তর্জাতিক মানবতার আইন সংহিতারূপে লিপিবদ্ধ করার সময় একাধিক যুদ্ধাপরাধের উল্লেখ করে।
যুদ্ধাপরাধের বিচারের একটা সমস্যা হচ্ছে, প্রায়ই বিচারকার্য বিজয়ীদের তত্ত্বাবধানে হয়ে থাকে। আর বিজয়ীরা যদি অনুরূপ অপরাধ করে থাকে তবে তার বিচার হয় না। এই ধারার দু-একটি ব্যতিক্রম লক্ষ করা যায়। ভিয়েতনামের মাইলাইয়ের হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে ক্যাপটেন কেলিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিচার করে শাস্তি দেয়।
গৃহযুদ্ধে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইনের বিধিমালা তুলনামূলকভাবে কম। ১৯৭৭ সালের অ্যাডিশনাল প্রোটোকল (Additional Protocol II of 1977) অভ্যন্তরীণ বিরোধ সম্পর্কে যে প্রাথমিক বিধান দিয়েছে তার মধ্যে ফৌজদারি অপরাধের দায়-দায়িত্বের উল্লেখ নেই। আন্তর্জাতিক যুদ্ধের ক্ষেত্রে যুদ্ধাপরাধ সম্পর্কে নির্দেশ যে রকম সুস্পষ্ট, অভ্যন্তরীণ বিরোধের ক্ষেত্রে তেমন সুস্পষ্ট বিধানের অভাব রয়েছে। অবশ্য জেনেভা কনভেনশনসের কমন আর্টিকল ৩ গৃহযুদ্ধের ক্ষেত্রে কিছু বিধান দিয়েছে। প্রাক্তন যুগোস্লাভিয়া ও রুয়ান্ডা সম্পর্কে যে স্ট্যাটিউট রচিত হয়েছে তার অপরাধের তালিকায় ওই ৩ কমন আর্টিকলের লঙ্ঘন অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের স্ট্যাটিউটে ওই ৩ কমন আর্টিকল চারটি গুরুতর লঙ্ঘনের কথা তালিকাভুক্ত করেছে—জীবন ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ, ব্যক্তিমর্যাদার ওপর হামলা, পণবন্দী গ্রহণ এবং সরাসরি দণ্ডদান। যুদ্ধ-আইন ও রীতির ১২টি লঙ্ঘনের কথাও ওই স্ট্যাটিউটে উল্লেখ রয়েছে।
সাধারণত দরিদ্রের পক্ষে বিচার পাওয়া যেমন কঠিন, শক্তিমান-বিত্তবান রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের বিচার করাও তেমনি সুকঠিন। ন্যুরেমবার্গ ও টোকিও ট্রায়াল হয়েছিল, কিন্তু ভিয়েতনামের ক্ষেত্রে যুদ্ধাপরাধে তেমন যথাযথ বিচার হয়নি।
একাত্তরে আমাদের দেশে যেসব নৃশংস অপরাধ সংঘটিত হয় তার পরিণতি যে কেবল একজন ব্যক্তি, একটি পরিবার বা একটি রাষ্ট্রকে স্পর্শ করে তা নয়; সেই সব অপরাধ সারা মানবসমাজের বিরুদ্ধে সংঘটিত হয় এবং তাদের বিরুদ্ধে ন্যায়পর মানুষ দেশে-বিদেশে সর্বত্র সোচ্চার হন।
৯৩ হাজার পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২-এর জুলাইয়ের মধ্যে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্তদের সংখ্যা ৪০০ থেকে ১৯৫-তে কমিয়ে ফেলে।
জে এন দীক্ষিত তাঁর লিবারেশন অ্যান্ড বিয়ন্ড-এ বলছেন, ‘এমনকি এই স্বল্পসংখ্যক যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ সরকার সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ কিংবা মামলার নথিপত্র প্রস্তুতির ব্যাপারে তেমন তত্পর ছিল না।’ তিনি আরও বলেন, ‘মুজিবুর রহমান এ ব্যাপারে হাকসারকে (ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত) বলেছিলেন, সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহে অসুবিধার কারণে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিষয়ে শক্তি ও সময় নষ্ট করতে চান না। হয়তো কোনো দীর্ঘমেয়াদি কৌশলের কথা ভেবেই মুজিব এ ধরনের একটি বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নেওয়ার পথে চালিত হয়েছিলেন। তিনি এমন কিছু করতে চাননি, যাতে পাকিস্তানসহ অন্যান্য মুসলিম দেশের বাংলাদেশকে স্বীকৃতিপ্রদান বাধাপ্রাপ্ত হয়।’
বাংলাদেশে গণহত্যাজনিত অপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধ এবং আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে অন্যান্য অপরাধের জন্য যেকোনো সশস্ত্র বাহিনী বা প্রতিরক্ষা বাহিনী বা সহায়ক বাহিনীর সদস্য বা যুদ্ধবন্দীকে আটক, ফৌজদারি আদালতে সোপর্দ বা দণ্ডদান করার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন (১৯৭৩ সালের ১৯ নম্বর আইন) পাস করা হয়।
আমাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) অ্যাক্ট ১৯৭৩-এ ‘যুদ্ধাপরাধ’-এর সংজ্ঞায় যুদ্ধের আইন বা রীতির লঙ্ঘনে সীমিত না রেখে খুন, নিপীড়ন, বাংলাদেশের রাজ্যসীমায় দাস শ্রমিক হিসেবে বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে বেসামরিক লোককে দেশ থেকে বিতাড়ন, যুদ্ধবন্দীর খুন বা নির্যাতন, পণবন্দী বা আটক ব্যক্তিদের হত্যা, ব্যক্তিগত বা সাধারণ সম্পত্তি লুণ্ঠন, শহর, নগর বা গ্রামের সামরিক প্রয়োজনে যথার্থ নয় এমন সীমাহীন ধ্বংস ও ক্ষয়ক্ষতিকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য ন্যূনতম যে দক্ষতা ও নিবেদিতপ্রাণ প্রসিকিউটরের প্রয়োজন ছিল, তার বড়ই অভাব ছিল। যুদ্ধাপরাধ ট্রায়ালের জন্য যাদের সরকারি কৌঁসুলি নিয়োগ করা হয়েছিল তাদের শীর্ষস্থানীয় একজন যখন আমাকে বললেন, ‘আমার ...কে আমাকে বাঁচাতে হবে’, তখন আমার মনে হয়েছিল যুদ্ধাপরাধের আর বিচার হচ্ছে না। আমি আমিনুল হককে (পরে তিনি অ্যাটর্নি জেনারেল হন) বলেছিলাম, ‘আপনারা ওঅর ক্রাইমের ট্রায়াল করতে পারবেন না।’
অভিজ্ঞতা ও অভিজ্ঞ আইনজীবীর অভাব, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পর্কে দোদুল্যমানতা এবং সর্বোপরি উপমহাদেশের রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার জন্য শেষ পর্যন্ত আমাদের দেশে কোনো ট্রাইব্যুনাল গঠন করা সম্ভব হয়নি। যুদ্ধাপরাধীদের কোনো বিচার হয়নি।
কারও কারও জাতীয়তা বাজেয়াপ্ত করা হলেও অনেকের জাতীয়তা ফেরত দেওয়া হয়। যাদের বিরুদ্ধে হত্যা বা অনুরূপ গর্হিত অপরাধের অভিযোগ ছিল সেই সব মামলায় সরকার পক্ষ থেকে তেমন তদবির করা হয়নি। ওই আইনে প্রায় ৩৪ হাজার ৬০০ আসামি অভিযুক্ত হলে আইনের গতিপথ রুদ্ধ হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে সরকারকে প্রায় উদারভাবে ক্ষমা প্রদর্শন করতে হয়।
বাংলাদেশে যে বিচার তাড়াতাড়ি করা যায় না তা নয়। ১৩ নভেম্বর ১৯৭২ দালাল আইনে পাকিস্তানি গভর্নর ডা. মালেকের বিচার শুরু হয়। ১৯ নভেম্বর তাঁর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। ডা. মালেকের যাঁরা মন্ত্রী ছিলেন তাঁদের সবার বিচার হয়নি।
১৫ ডিসেম্বর ১৯৭৩ বিজয় দিবসের প্রাক্কালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আমরা প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধ গ্রহণের নীতিতে বিশ্বাসী নই। তাই মুক্তিযুদ্ধের শত্রুতা করে যাঁরা দালাল আইনে অভিযুক্ত ও দণ্ডিত হয়েছিলেন তাঁদের সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন করা হয়েছে।’
২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী বিল পাস হওয়ার পর নতুন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘কোনো দেশের ইতিহাসে নাই বিপ্লবের পর বিপ্লবকে বাধা দিয়েছে যারা, শত্রুর সঙ্গে সহযোগিতা করেছে যারা, যারা এ দেশের মানুষকে হত্যা করেছে, তাদের কোনো দেশে, কোনো যুগে ক্ষমা করে নাই। কিন্তু আমরা করেছিলাম...সবাইকে ক্ষমা করেছিলাম।’
২৬ মার্চ ১৯৭৫ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের এক জনসভায় রাষ্ট্রপতি বললেন, ‘ভায়েরা, বোনেরা আমার, আমরা চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু একটা ওয়াদা আমি রাখতে পারি নাই। জীবনে যে ওয়াদা আমি করেছি জীবন দিয়ে হলেও সে ওয়াদা আমি পালন করেছি। আমি ওয়াদা করেছিলাম তাদের বিচার করব। এই ওয়াদা আপনাদের পক্ষ থেকে খেলাপ করেছি, তাদের আমি বিচার করিনি। আমি ছেড়ে দিয়েছি এ জন্য যে এশিয়ায়, দুনিয়ায় আমি বন্ধুত্ব চেয়েছিলাম।’
১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২ গোলাম আযম ও তাঁর সহযোগীদের বিচারের দাবিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল সমন্বয় কমিটি গঠিত হয়। ২২ মার্চ ১৯৯২ লন্ডনে বাংলা পত্রিকার সাংবাদিকদের এক সাক্ষাত্কারে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেন, ‘গোলাম আযম আইনের ঊর্ধ্বে নন, তবে গণ-আদালতে বিচারের কোনো যুক্তি নেই।’
২৬ মার্চ ১৯৯২ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৭ মার্চ স্মৃতিস্তম্ভের পাশে চারটি ট্রাক পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে নির্মিত এক এজলাস মঞ্চ থেকে ১২.৩০ মিনিটে বাংলাদেশ গণ-আদালত ১-এর চেয়ারম্যান হিসেবে জাহানারা ইমাম একটি রায় পড়ে ঘোষণা দেন যে, ‘মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধের জন্য গোলাম আযমের যথাযথ বিচার হওয়া উচিত।’ পরের দিন স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে এক আলোচনা সভায় বিরোধী দলের নেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘সরকার যদি গণরায় বাস্তবায়ন না করে তাহলে জনতাই এ রায় কার্যকর করবে।’
পাকিস্তানের হামদুর রহমান কমিশন রিপোর্টের কিছু অংশ ২০০০ সালের আগস্টে দিল্লির ইন্ডিয়া টুডে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। পরে ইন্টারনেটের মাধ্যমে তার ব্যাপক প্রচার ঘটে। এরপর যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবি দেশে কিছুটা সোচ্চার হয়েছে। পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তারা যে বাঙালিদের ‘বাংলাদেশ পাঠিয়ে দাও’ অর্থাত্ ‘জানে খতম করো’ ধরনের হুকুম দিয়েছিল, ওই রিপোর্টে তার উল্লেখ রয়েছে।
৩ মে ১৯৯৮ পাকিস্তানের এক বর্ষীয়ান রাজনীতিক ইউসুফ হারুন একাত্তরের ঘটনার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, ‘পাকিস্তান ক্ষমা চাইলে বিবেচনা করা হবে, তবে একাত্তরের কথা বাংলাদেশ ভুলবে না।’ পরের দিন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান মিয়া আবদুল ওয়াহিদ বলেন, ‘একাত্তরের যুদ্ধের সম্পর্কে বাংলাদেশ যে অবস্থান নিয়েছে তা ইসলামাবাদ জানে না। বাংলাদেশকে অবশ্যই অতীতকে ভুলতে হবে এবং তার উচিত হবে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক জোরদার করতে সচেষ্ট হওয়া।’ ১৩ সেপ্টেম্বর ২০০০ নিউইয়র্কে এক সংবাদ সম্মেলনে পাকিস্তানের সামরিক শাসনকর্তা জেনারেল পারভেজ মোশাররফ বলেন, ‘পাকিস্তানি হিসেবে আমি একাত্তরকে ভুলে যেতে চাই।’
মানুষ ভুলে যায়। তার স্মৃতিশক্তি প্রখর নয়। বাঙালির স্মৃতিশক্তি সেই প্রবাদ বাক্যের তুলনার চেয়েও কি ক্ষীণ? ফখরুদ্দীন আহমদ তাঁর উত্তাল তরঙ্গের দিনগুলিতে বলেছেন: ‘আমাকে এবং আরও অনেককে যা সবচেয়ে বেশি অবাক করেছিল তা হলো ভুট্টোর প্রতি জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অভিনন্দন। ঢাকার রাস্তার দুধারে সমবেত জনতা ভুট্টোকে স্বাগত জানানোর জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে এবং নিরাপত্তা-ব্যবস্থা কার্যত ভেঙে পড়ে। জনতা ভুট্টো ও পাকিস্তানের সমর্থনে মুহুর্মুহু স্লোগান দিতে থাকে। ভারতবিরোধী স্লোগানও এ সময়ে জনতা মাঝে মাঝে দিচ্ছিল। এ ছিল কল্পনাতীত ব্যাপার।’
৩১ অক্টোবর ২০০৭ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে অনুষ্ঠিত এক আলোচনা সভায় সেক্টরস কমান্ডাররা বলেন, ১৯৭১ সালে এই যুদ্ধাপরাধীরা এ দেশের মাটিতে প্রায় ৫৩ ধরনের অপরাধ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে ১৭ ধরনের যুদ্ধাপরাধ, ১৩ ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং ৪ ধরনের গণহত্যাসংক্রান্ত অপরাধ। এ সময়ের ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের জন্য দেশে প্রায় পাঁচ হাজার বধ্যভূমি তৈরি হয়।
ওই তারিখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীন আহমদ সম্পাদকদের সঙ্গে এক বৈঠকে বলেন, ‘তিনি বিশ্বাস করেন, যুদ্ধাপরাধীদের জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ অনভিপ্রেত। তবে আইনের মাধ্যমেই এর সহায়তা সম্ভব। কোনো ভুক্তভোগী এ ক্ষেত্রে আইনের সহায়তা চাইলে তার জন্য আইনের দ্বার খোলা রয়েছে।’
নভেম্বর ২০০৭ সমকাল-এ এক লেখায় আমি বলেছিলাম, ‘বর্তমান সরকার ভোটের জোরে আসেনি। তাদের ভোট হারানোর ভয় নেই। তারা ইতিমধ্যে বেশ কিছু ভালো কাজ করেছে যা এ যাবত্কালের সব নির্বাচিত সরকার নানা রকম পাঁয়তারা করে ব্যাহত করে রাখে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এ সরকার না করলে আর হবে না। জন্মসূত্রে বাংলাদেশিকে কেবল প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিচার করা যায় না। এ ব্যাপারে সরকারকে বাদী হতে হবে এবং নিষ্ঠার সঙ্গে তদন্ত করে বিচারের ব্যবস্থা করে এসপার-ওসপার করতে হবে। বিচার শুরু হোক, রায় যা-ই হোক আমরা মেনে নেব। একটি অনির্বাচিত সরকারের বড় জবাবদিহি হচ্ছে তার গ্রহণযোগ্যতায়, তার সফলতায়।’
দেশের সাধারণ মানুষের বিশ্বাস এবং নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকের মতে, একাত্তর সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসররা বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ করেছিল। সেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আইন প্রণয়নের সময় ১৯৭৩ সালে তত্কালীন আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর বলেন, ‘এরা শুধু বাংলাদেশের শত্রু নয়, মানবতার শত্রু।’ আমরা সেই মানবতার শত্রুদের বিচার করতে পারিনি। আমরা প্রত্যয়ের সঙ্গে বলেছি, ‘বাংলার মাটিতে তাদের বিচার হবে।’ বিচার হয়নি। আমরা আবার মনের মাধুর্যে বলেছি, ‘বাংলাদেশের মানুষ জানে কী করে ক্ষমা করতে হয়।’ যাঁরা বিচার করতে পারেননি, তাঁদের মুখে ক্ষমা করার অহংকার মানায় না। আমরা জানি, প্রতিকূল অবস্থায় বিচার হয় না, অনুকূল অবস্থায় কখনো কখনো বিচার হয়।
২১ মার্চ ২০০৮ মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের জাতীয় সম্মেলনে প্রধান অতিথির ভাষণে আমি বলি: ১৯৭৩ সালের ১৯ নম্বর আইনের কোনো একটি, না একাধিক অপরাধের বিচারের জন্য এখন আমরা বিচারপ্রার্থী, তা স্থির করতে হবে। সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করার জন্য অভিযোগ সুস্পষ্ট করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় দলিলীকরণ অবশ্যই সম্পূর্ণ করতে হবে। আমরা অসত্যের আশ্রয় নেব না। ভাবাবেগ আমাদের অতীতে সাহায্য করেনি, ভবিষ্যতেও করবে না। আইন নিজের গতিতে চলে না, তাকে সঠিকভাবে সঞ্চালন করতে না পারলে আইনের গতি রুদ্ধ বা বিপথে চালিত করার জন্য বুদ্ধিধরদের অভাব হয় না।
কাউকে দোষারোপ না করে আমাদের পরিষ্কারভাবে জানতে হবে কোন কোন কারণে আমরা গণহত্যার বিচার করতে পারিনি এবং আমাদের সামনে কী কী বাধা রয়েছে, যা সম্পূর্ণ অপসারণ করতে হবে। আইনগত অস্পষ্টতা দূর করতে হবে। আমরা ইংল্যান্ডের টিউডর আমলের বিল অব অ্যাটেন্ডারের মতো আইন পাস করে কোনো বিশেষ ব্যক্তিকে দণ্ড দেব না। আমরা নিজের সুবিধামতো আইন বানাব না। আমরা ক্যাঙারু আদালত প্রতিষ্ঠা করব না। বিচারের অভিযুক্ত ব্যক্তিরা যেন ন্যায়বিচার পায় তা লক্ষ রাখব। তাদের অজুহাতে বা কৈফিয়ত বিবেচনা করে আমরা সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করে তাদের মোকাবিলা করব।
আমরা যদি তা না পারি তবে আইনে তাদের নির্দোষ বলে ঘোষণা দেব। বিনা কারণে অভিযুক্তকে শাস্তি দিলে দেশে অরাজকতা বৃদ্ধি পাবে। এ ব্যাপারে বিচারের মাধ্যমে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। জন্মসূত্রে বাংলাদেশি নাগরিকের অধিকার প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে আমরা খর্ব বা হরণ করব না। বিচারের প্রশ্নটি অনির্দিষ্টকালের জন্য টেনে নিয়ে গেলে তা দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না। আমরা এমন সুষ্ঠুভাবে বিচার করব যাতে ভবিষ্যতে এই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে পারি। বিদেশে তুলনীয় অবস্থায় বিচার করতে গিয়ে যেন বিদেশিরাও আমাদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে পারে। বিচারপ্রার্থীরা অপরাধের বিচার চান। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ত্বরান্বিত হোক।’
৭ আগস্ট বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার প্রেরিত বার্তা বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়:
শেরপুর, ৭ আগস্ট (বাসস): কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী বলেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য যাঁরা সাফাই সাক্ষী দেবেন তাঁরাই রাজাকার। তাঁরাই ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় খুন, ধর্ষণ ও লুটতরাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ সম্পন্ন করা বর্তমান সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার। তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে ওয়াদা পূরণ করবেন।...
এ সময় কৃষিমন্ত্রী আরও বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার একটু ধীর গতিতে হলেও সম্পূর্ণ আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে। যাঁরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে সাফাই সাক্ষী দিতে যাবেন তাঁদের চিহ্নিত করে এলাকায় তাঁদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে। এখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ চলছে। এ নিয়ে কেউ কেউ মানবাধিকারের কথা বলছেন।
তিনি তাঁদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন রেখে বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে ছেলের সামনে আর ছেলেকে পিতার সামনে হত্যা করা হয়েছিল তখন মানবাধিকার সংস্থা কোথায় ছিল? যাঁরা মানবাধিকার শব্দটি বানান করতে পারেন না তাঁরাও এখন মানবাধিকারের কথা বলছেন।
আদালত অবমাননার শুনানিতে ট্রাইব্যুনাল মন্তব্য করেন, ‘আমরা যদি উত্তরদায়কের ব্যাখ্যা গ্রহণ করি যে কথিত বক্তব্য তাঁর চিন্তাপ্রসূত নয় এবং তিনি কেবল জনগণের আবেগ, ধারণা ও হতাশার প্রতিধ্বনি করেছেন এবং আসামির সাফাইকে বিঘ্নিত করেননি তবু আমাদের পর্যবেক্ষণ করতে হবে যে সংবিধানে সংরক্ষিত বাক্স্বাধীনতার অধিকার পরম ও শৃঙ্খলহীন নয় এবং এই অধিকার অনুশীলন করতে হবে কিন্তু নিয়ন্ত্রণ ও সাবধানতার সঙ্গে।’
২৭ জুলাই ২০১২ রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে বাংলাদেশ আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের ১৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সরকারের সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী বলেছেন, ‘রাজাকাররা আইন মেনে একাত্তরে নির্যাতন করেনি। কাজেই এত আইন দেখলে হবে না। বসে বসে আইন কপচালে হবে না। আগেই দুয়েকটাকে ঝুলিয়ে দিলে ওদের আইন নিয়ে কপচানি বন্ধ হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে আর প্রহসন নয়, রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে দ্রুত এ বিচার শেষ করতে হবে।’
সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী বলেন, ‘ওরা যখন ’৭১ সালে আমার ভাইকে হত্যা করেছিল, মেয়েদের ঘর থেকে বের করে নিয়ে গেছে, তখন কোথাও আইন ছিল না। অনেকেই প্রশ্ন তোলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে এত আইন-কানুনের কী দরকার। তারা যখন অত্যাচার করেছে তখন কোনো আইন দেখে করেছিল? আইন দেখে আমরা স্বাধীনতাযুদ্ধ করিনি।’
আদালত অবমাননার মামলায় উত্তরদায়ক বলেন, তিনি বলেছিলেন, ‘মানুষের সঙ্গে যখন যাই তখন তারা আমার কাছে অনুরোধ করেছেন যে আপনারা এই প্রহসন শেষ করেন এবং দু-একটা যদি না ঝুলে যায় তাহলে এটা আমার কথা ভাই...
‘আর প্রহসন নয়, মানুষের কাছে যখন যাই তখন তারা আমায় বলে, দুই একটা শাস্তি না হলে, বসে বসে আইন কপচালে হবে না, আমরা কি আইন দেখে স্বাধীনতাযুদ্ধ করেছিলাম?’
৩ ডিসেম্বর ২০১২ বাংলাদেশ প্রতিদিন-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অন্য মামলাগুলোর মধ্যে সাঈদীর মামলার পরই রয়েছে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলাটি। এই মামলায় প্রসিকিউশনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে আসামিপক্ষের সাফাই সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। ৯ ডিসেম্বরের মধ্যে সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হতে পারে। এরপর তিন দিনে প্রসিকিউশন এবং পাঁচ দিনে আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক শেষ হতে পারে। সেই হিসেবে ২৭ ডিসেম্বরের মধ্যে এ মামলার রায় আসতে পারে।’
ট্রাইব্যুনাল মন্তব্য করেন: ‘In the name of freedom of press or speech nobody can so predict on a subjudice case. Nobody does have jurisdiction of foretelling such imaginary dates as to subjudice proceedings. It apparently causes obstruction to the indepence and fairness of the Tribunal. Therefore, we cannot keep mum, Words spoken in the alleged report on a subjudice matter tends to interfere with the due course of judicial proceeding and thus it shall have the effect of undermining respect for the administration of justice falls within the provisions as specified in section 11 (4) of the Act of 1973.’
১৩ নভেম্বর ২০১২ ট্রাইব্যুনাল দুটি আদালত অবমাননার বিষয়ে পরিষ্কার করে বলেন, এটা ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে কেউ বাক্স্বাধীনতার অধিকারের অনুশীলনে কোনোভাবেই অন্যজনের অনুমিত অনপরাধের অধিকার প্রভাবান্বিত করতে পারবে না যতক্ষণ না আইনানুযায়ী তিনি অপরাধী প্রমাণিত হন।
ট্রাইব্যুনাল মন্তব্য করেন, প্রত্যেকের স্মরণ করা উচিত যে সব নাগরিককে আইন মেনে চলতে হবে। ট্রাইব্যুনাল আইনত প্রত্যাশা করেন যে ট্রাইব্যুনাল স্বাধীনতা ও ন্যায় বিচারের স্বার্থে দায়িত্বশীল ব্যক্তিগণ বিশেষ করে যাঁরা ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, ভবিষ্যতে তাঁদের বিচক্ষণতার পরিচয় দেবেন বিচারাধীন বিষয়ে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করে কল্পিত সময়সীমার মধ্যে মামলা নিষ্পন্ন হওয়ার ভবিষ্যদ্বাণী না করা থেকে এই মন্তব্য করে বিষয়টির নিষ্পন্ন করেন অন্য কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করে।
৬ ডিসেম্বর ২০১২ যুক্তরাজ্যভিত্তিক সাপ্তাহিক দ্য ইকোনোমিস্ট-এর চীন সংস্করণের সম্পাদক রব গিফোর্ড ও দক্ষিণ এশীয় ব্যুরো-প্রধান অ্যাডাম রবার্টসের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগে কেন কার্যক্রম নেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে নোটিশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
আদেশে বলা হয়, গঠনের পর থেকে এই ট্রাইব্যুনাল উন্মুক্ত এজলাসে বলে আসছেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩ একটি নতুন আইন। এ জন্য তাঁরা এ বিষয়ে অভিজ্ঞ ও দক্ষ মানুষের কাছ থেকে পরামর্শ নিতে পারেন। তাঁরা চাইলে দেশ-বিদেশে গবেষকদের কাছ থেকেও এ বিষয়ে পরামর্শ নিতে পারেন। বেলজিয়ামে বসবাসরত বাংলাদেশের নাগরিক ও আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন বিশেষজ্ঞ আহমেদ জিয়াউদ্দিনসহ আরও কয়েকজনের সঙ্গে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানের বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ রয়েছে। চলমান বিচার কার্যক্রমের বিভিন্ন সময়ে চেয়ারম্যান তাঁর কাছ থেকে সহযোগিতাও নিয়েছেন। দু-তিন দিন আগে চেয়ারম্যান বুঝতে পারেন, তাঁর ই-মেইল ও স্কাইপ অ্যাকাউন্টের পাশাপাশি কম্পিউটারও হ্যাক করা হয়েছে।
গত বুধবার রাত ১০টার দিকে ইকোনোমিস্ট থেকে চেয়ারম্যানকে ফোন করে বলা হয়, চেয়ারম্যান ও আহমেদ জিয়াউদ্দিনের মধ্যে কথোপকথন তাঁদের কাছে আছে এবং এ বিষয়ে তাঁকে কয়েকটি প্রশ্ন করেন। চেয়ারম্যানের কম্পিউটার, ই-মেইল ও স্কাইপ অ্যাকাউন্ট হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে গোপনীয়তা মারাত্মকভাবে নষ্ট করা হয়েছে। এ ছাড়া আইনত কোনো ব্যক্তি একজন বিচারকের কাছে টেলিফোনে প্রশ্ন করতে পারেন না। চেয়ারম্যান আরও জানতে পেরেছেন, আহমেদ জিয়াউদ্দিনের ই-মেইল ও স্কাইপ অ্যাকাউন্টও হ্যাক হয়েছে। এটা পরিষ্কার যে যাঁরা ট্রাইব্যুনালে বিচার বাধাগ্রস্ত করতে চান, তাঁরাই এ কাজ করেছেন। এ জন্য ট্রাইব্যুনাল ইকোনোমিস্ট-এর চীন সংস্করণের সম্পাদক রব গিফোর্ড এবং দক্ষিণ এশীয় ব্যুরো-প্রধান অ্যাডাম রবার্টসের বিরুদ্ধে নোটিশ জারি করেন। আদেশে ওই দুজনকে চেয়ারম্যানের ই-মেইল ও স্কাইপ অ্যাকাউন্ট থেকে পাওয়া তথ্য গোপন রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়।
কিন্তু তাঁদের অবৈধভাবে হ্যাক করা কথোপকথন সম্প্রতি দেশের একটি পত্রিকায় ফাঁস করা হয়। এই নাজুক অবস্থায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে এর চেয়ারম্যান নিজামুল হক ‘ব্যক্তিগত’ কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেন। সরকার দ্রুত সে শূন্যস্থান পূরণ করেছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এ ধরনের অপরাধের যে বিচারকার্য হয়েছে এবং কম্বোডিয়ায় তা যেভাবে চলছে, সেসবের বিবেচনায় আমাদের ট্রাইব্যুনালের কাজ সম্পর্কে প্রশ্ন তোলার তেমন একটা অবকাশ নেই। আমাদের বিশ্বাস, স্বাধীন ও স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এ বিচারকার্য সমাধা হবে।
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার এ যুগের এক অভিনব ব্যাপার, আমাদের দেশে তো বটেই। তাই এ ব্যাপারে নানা ধরনের অভিব্যক্তির দেখা পাওয়া যায়। এই বিচারের কথা বিজয় দিবসের কাল থেকেই আমাদের এক আলোচ্য বস্তু।
মাঝে ওই বিচার দাবি নানা কারণে স্তিমিত হলে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে আবার তা উজ্জীবিত হয়। আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির আন্দোলনে রাজনৈতিক আঁতাত-সহযোগিতায় ওই প্রশ্ন ধামাচাপা পড়ে যায়। নবম সংসদের নির্বাচনের সময় ওই বিচারের দাবি অপ্রতিহত হয়ে দেখা দিলে সরকারি দল নির্বাচনী ইশতেহারে সেই দাবি সম্ভাব্য কর্মসূচি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে। এখন বিচার শুরু হওয়ার পর নানা প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। অপর পক্ষের সব সমালোচনাকে নস্যাত্ করার জন্য মন্তব্য করা হচ্ছে, ‘ওরা বিচার প্রতিহত করতে চায়।’ অন্যদিকে বলা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বিচার হতে হবে।
কূটনীতিকদের খয়রাতি পরামর্শ দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ এক মজার জায়গা। এদের মধ্যে রয়েছেন যাঁরা আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল স্বীকার করেন না, নিজেদের ভূখণ্ডে যা করতে পারেন না তা পরের দেশে করেন এবং বহিঃসূত্রে নিপীড়ন (আউটসোর্সিং টরচার) করে স্বীকারোক্তি আদায় করেন। ওপরপড়া এই মোড়লি বক্তব্যে কান দেওয়ার আমি কোনো প্রয়োজন দেখি না। এই বিচার বিষয় অপরকে দুয়ো দেওয়ার জন্য এক মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
মানবতাবিরোধী অপরাধের অন্যতম অভিযুক্ত ব্যক্তি গোলাম আযমের জন্মসূত্রে প্রাপ্ত নাগরিকত্ব অক্ষুণ্ন রেখে আমি অন্যান্য বিচারকের সঙ্গে একটি রায় দিয়েছিলাম। আমার সম্পর্কে কিছু বলতে গেলে কলাম লেখক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী সে কথা সব সময় টেনে নিয়ে আসেন। ওই রায়ের জন্য যেন আমি মানবাধিকার বিষয়ে আলোচনা করার সব অধিকার হারিয়ে ফেলেছি।
যা হোক, বিচক্ষণতা ও ধৈর্যের সঙ্গে ট্রাইব্যুনাল যেভাবে তার কাজ করে যাচ্ছে, তাতে আমার মনে হয় আকস্মিক কোনো অঘোরপন্থী অশুভ শক্তি হস্তক্ষেপ না করলে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার সম্পন্ন হবে। দেশের শান্তি ও পরম কল্যাণের জন্য যে ব্যাপারটা এতকাল ধরে আমরা টেনে আনছি, তার একটা সত্কার হলে সেটা হবে সবার জন্য এক স্বাস্থ্যকর ও মঙ্গলময় ব্যাপার।
সূত্র: ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১২ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত