মাঝরাতে বৃষ্টি শুরু হলো। এখন আকাশজুড়ে আশ্বিনের জ্যোত্স্না থাকার কথা, কাল রাতেও মোটামুটি আস্ত একটা চাঁদ অনেক মাতাল আলো ছড়িয়েছে। কিন্তু আজ সন্ধ্যা থেকেই চাঁদ অদৃশ্যবাসে গেছে, আকাশের মুখ থমথমে, যেন গোসা করেছে, জগত্সংসার অথবা নিজের ওপর। মাঝরাত এসেছে এলোমেলো, ভেজা হাওয়ার ঝাপটায়, সময়ের অনেক আগে এবং ইরফান সাহেবের জানালার বাইরে একটানা একটা কোলাহল শুরু করেছে।
কয়েক বছর থেকে ইরফান সাহেব পড়েছেন ঘুমহীনতার কবলে। তাঁর রাতগুলো আর নিজের অধিকারে নেই। অনেক অনেক বছর আগে অনেক রাত তিনি জেগে কাটাতেন। কিন্তু তখন পাশে থাকতেন আকলিমা বেগম। রাতকে তখন তাঁর খুব বন্ধু মনে হতো; রাত ঘন হলেই আকলিমার চোখ ঘন হতো, নিঃশ্বাস ঘন হতো। তখন অন্ধকার ভেঙে ভোরের আয়োজন শুরু হলে ইরফান রেগে যেতেন, আকলিমাকে বলতেন, রাতগুলো এত ছোট কেন?
সে রাতগুলো একসময় ছোট হতে হতে মিলিয়ে গেল।
আকলিমা বেগমও মিলিয়ে গেলেন। আজ রাতের চাঁদটার মতো তিনি তাঁর জীবন থেকে অদৃশ্য হয়েছেন। যে রাতে তাঁর অদৃশ্যযাত্রা, সে রাতে ইরফান সাহেব ঢাকা থেকে বরিশাল যাচ্ছিলেন স্টিমারে; বরিশালে ছোটবেলার বন্ধু মতিনউদ্দিনের কুলখানিতে অংশ নিতে, যদিও আরও একটি উদ্দেশ্য ছিল তাঁর—সরকারি চাকরিতে প্রথম পোস্টিং ছিল এই বরিশালে এবং কিছুদিন থেকে স্বপ্নে তিনি বরিশাল দেখেছেন, কীর্তনখোলা দেখেছেন; কীর্তনখোলার পাড়ে দাঁড়িয়ে আকাশকে সাক্ষী রেখে আকলিমা বেগমের হাতে আংটি পরিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখেছেন। আকলিমাকে এই স্বপ্নের বর্ণনা দিয়ে বলেছেন, বরিশাল আমাকে ডাকছে, মতিন মরে গিয়ে সেই ডাক শোনার একটা পথ করে দিয়েছে। আমি যাই?
আকলিমা হ্যাঁ-না কিছু বলেননি। স্বামীর মর্জি তিনি চল্লিশ বছরের বিবাহিত জীবনে খুব ভালো পড়তে শিখেছিলেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল ‘না’ বলার; কিন্তু তিনি ঠিক জানতেন, দিন শেষে এই না মিলিয়ে যাবে হ্যাঁ-এর কাছে।
কুলখানিটা কবে, তিনি শুধু সে তথ্য জানতে চেয়েছিলেন।
আকলিমা বেগমকে সঙ্গে নিতে পারলে ইরফান সাহেব খুশি হতেন; কিন্তু সেটি সম্ভব ছিল না দুই কারণে। প্রথমত, আকলিমার দুই পায়ের হাড়ে ভর করেছিল গেঁটে বাত। দ্বিতীয়ত, তাঁর ডান চোখে ছানির অপারেশন হয়েছিল মাত্র দিন সাতেক আগে। ইরফান সাহেব তাঁর ভাতিজা মিঠুকে ডেকে পাঠালেন আরামবাগের মেস থেকে। বললেন, চাচিকে দেখে রাখিস। বাড়িতে কাজের মেয়ে ছিল, বাবুর্চি ছিল, একটা ড্রাইভারও ছিল। তার পরও একটু বাড়তি সুরক্ষার জন্য মিঠু। মিঠুর স্ত্রী-সন্তান থাকে বিক্রমপুরে, সে থাকে ঢাকার এক মেসে। চাকরি করে বাংলাদেশ বিমানে। সে কোনো ওজর-আপত্তি ছাড়াই বিকেলে বাড়িতে এসে হাজির হয়েছে, চাচাকে আশ্বস্ত করেছে এবং হয়তো এ রকম একটি সম্ভাবনা দেখে বেশি মনোযোগী ভাব দেখিয়েছে যে এ তিন-চার দিন চাচির দেখভাল করে রাখলে এবং তার মন পেলে পাকাপাকিভাবেই এ বাড়িতে থাকতে পারবে। হয়তো পরিবার নিয়েও উঠে আসা যাবে একসময়।
জগতে একশ্রেণীর মানুষ যদি নিজের পায়ের ওপর দাঁড়াতে পছন্দ করে, অন্য একশ্রেণীর মানুষ পছন্দ করে পরের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকতে। এদের পরজীবী বলা যায়, পরগাছাও বলা যায়। মিঠু পড়ে এই দ্বিতীয় শ্রেণীতে।
ইরফান সাহেব স্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠলে মিঠু তাঁকে একটা প্রগলভ গুডবাই জানাল। তাতে হঠাত্ কিছুটা অস্বস্তি হলো ইরফান সাহেবের। এত ঘটা করে বিদায় জানানো কেন, যাচ্ছি তো মোটে বরিশাল।
প্রায় সদরঘাটের কাছে এসে তাঁর মনে হলো, মিঠু ছেলেটার জন্য স্ত্রীর হাত ধরে ভালো করে বিদায় নিয়ে আসা হয়নি।
মিঠুর ওপর প্রচুর রাগ নিয়েই তিনি স্টিমারে উঠলেন।
২.
স্টিমার চলতে শুরু করলে তাঁর মনজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল কিছু হঠাত্-শূন্যতা। আকলিমা বেগমকে ছেড়ে শেষ তিনি কোথায় গিয়েছিলেন? কেন গিয়েছিলেন? হ্যাঁ হ্যাঁ, কলকাতা গিয়েছিলেন, কিডনির চিকিত্সার জন্য। সেই সাত বছর আগে। খুবই যুক্তিপূর্ণ যাওয়া। কিন্তু আজ যে যাচ্ছেন, তার পেছনে যুক্তিটা কী? যাওয়ার কারণ আছে অবশ্য-ওই কুলখানি, ইত্যাদি। কিন্তু যুক্তি? অনেকক্ষণ এটি নিয়ে তিনি ভাবলেন। না, কোনো যুক্তি তৈরি হচ্ছে না। মতিনউদ্দিন তাঁর একমাত্র সম্প্রতি মারা যাওয়া বন্ধু নয়। এর আগে-মাস চারেক আগেই বস্তুত, সরফরাজ মারা গেছে। তার আগে সতীশ। তার আগে আসলাম। কারও কুলখানিতে তিনি যাননি। সতীশের ক্ষেত্রে শব্দটা অবশ্য শ্রাদ্ধ। আজ কেন যাচ্ছেন? তা ছাড়া বরিশাল কি একা তাঁকে ডাকে? শম্ভুগঞ্জ কি ডাকে না? কাপ্তাই অথবা পাথরঘাটা?
পাথরঘাটা?
বড় একটা পাথরের মতো আঘাত করল তাঁকে শব্দটা। পাথরঘাটা তাঁকে ডাকে-আরও নির্দিষ্টভাবে বললে, পাথরঘাটার আনারকলি নামের মেয়েটি তাঁকে ডাকে।
তাঁর নৌকা থেকে পড়ে মেয়েটি মারা গেল, নদীতে ডুবে। ডুবে যাওয়ার আগে মেয়েটি বাঁচার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। একটা হাত তুলে সামনে বাড়িয়ে দিয়েছে, কিন্তু ইরফান সাহেব আনারকলির হাতটা ধরতে পারেননি।
তিনি তো নদীতে ঝাঁপ দিয়ে পড়তে পারতেন। মেয়েটিকে উদ্ধার করতে পারতেন? তা কি তিনি করেননি এজন্য যে উনিশ বছরের এই মেয়েটি ছিল, যাকে বলে কাজের মেয়ে, রাঁধুনি এবং তিনি সরকারি অফিসার, নৌকায় যাচ্ছিলেন দুটি সরকারি প্রকল্প পরিদর্শনে। ঠিক আছে, মেয়েটি না হয় পড়ল নদীতে নৌকা থেকে, পড়ে ডুবে মারা গেল। কিন্তু কীভাবে পড়ল? মাথা ঘুরে? অসাবধানে, পা পিছলে? তা-ও না হয় হলো, কিন্তু এত বড় নৌকা, মাঝি চারজন। তারা কোথায় ছিল? তার এক খানসামা আর এক চৌকিদার। তারাই বা কোথায় ছিল? ঠিক আছে, নৌকাটা পাড়ের কাছেই না হয় বাঁধা ছিল—তারা ছিল পাড়ের ওপর, নানা জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, সাহেব আওয়াজ দিলেই দৌড়ে ফিরে আসার মতো দূরত্বে; কিন্তু তারা কি কিছুই দেখল না? শুনল না মেয়েটির চিত্কার?
ইরফান সাহেবই বা কেন জোরে ওদের ডাকলেন না, মেয়েটি যখন তলিয়ে যাচ্ছিল, সে সময়?
তা ছাড়া এই নৌকায় এতগুলো পুরুষ লোক, মেয়ে বলতে শুধু এইটুকু এই মেয়েটি, আনারকলি। কেন?
অনেক বছর পাথরঘাটা তাকে ডাকেনি। এখন কেন ডাকছে?
৩.
বরিশালের স্টিমারে একটি কেবিনে যখন ঘুমিয়ে ছিলেন ইরফান সাহেব, মোটামুটি সেই সময় ভাতিজা মিঠু তার চাচির ঘরে ঢোকে তার সঙ্গে এটা-সেটা গল্প করার জন্য। গল্প করলও কিছুক্ষণ, তারপর চাচির ঘুম পেলে সে চলে গেল। কিন্তু যাওয়ার আগে তার চোখ আটকে গেল স্টিল আলমারিটাতে। সে শুনেছে চাচার প্রচুর টাকা। সরকারি চাকরি করে কীভাবে অনেক টাকার মালিক হওয়া যায়, তা মিঠু জানে। বাংলাদেশ বিমানের একজন কর্মচারীও জানে, প্রতিষ্ঠানটি কেন উড়তে পারে না, কাদের জন্য এবং কারা কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির বারোটা বাজিয়ে। আলমারিটা অবশ্যই আন্ডার লক অ্যান্ড কি। সে ভাবল, চাবিটা নিশ্চয় ধারেকাছে আছে। হয়তো চাচির বালিশের নিচে। কিন্তু চাচি বললেন আলোটা নিভিয়ে দিতে। মিঠু আলো নিভিয়ে দরজা ভেজিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল।
সে রাতে আরেকজন মানুষ স্টিল আলমারি সম্বন্ধে কৌতূহলী হয়েছে: সে হচ্ছে বাবুর্চি হেলাল। একদিন বাজারের টাকা চাইতে এসে সে দেখেছে, আলমারিটা খোলা। ঠিক কী আছে এর ভেতরে, তার নজরে পড়েনি। কিন্তু তার মনে হয়েছে অনেক কিছু।
আজ সন্ধ্যায় সে একবার দেখেছে আলমারির সামনে বিবি সাহেবা দাঁড়িয়ে। মুখে বিরক্তি অথবা বিষণ্নতা, বোঝা যাচ্ছিল না। বুড়ো মানুষের মুখ দেখে এসব বোঝা মুশকিল। তাকে দেখে বিবি সাহেবা মৃদু বকা দিয়েছেন। যাও হেলাল মিয়া, ওই দিকে যাও। তিনি বলেছেন।
হেলাল মিয়া কাজ করছে তিন বছর। একদিনের জন্যও সাহেবকে রাতে বাড়ির বাইরে কোথাও থাকতে দেখেনি। সে ড্রাইভার জামানকে বলল কথাটা। জামানের চাকরি চার বছরের। সে-ও দেখেনি। তারা দুজনে বসে ভাবল, আজ বিবি সাহেবা ঘর থেকে বেরোননি, নিশ্চয় তাঁর মন খারাপ।
অথবা আলমারি পাহারা দিচ্ছেন-এটি অবশ্য আলাদা আলাদা, কিছুটা আগে-পিছে দূরত্বে দুজনে ভাবল। আগে ভাবল হেলাল, পিছে জামান। তবে একত্রে তারা একটি সিদ্ধান্ত নিল, আজ ইচ্ছামতো খাবে তারা। ডিম, মাছ, মুরগি সব। আজ বিবি সাহেবা রান্নাঘরের তদারক করাটাও ভুলে গেছেন।
বিবি সাহেবার খাস বাঁদী আনুয়ারা। আনুয়ারার কথা উঠতেই একটু বাঁকা হাসল দুজন, তবে আপন মনে। আনুয়ারার বয়স ত্রিশের নিচে। শরীর লতলতে। রং মেটে, তবে চোখ দুটি খুব উজ্জ্বল। তার কথায় প্রচুর ঝাল। তাদের ধর্তব্যের মধ্যে আনে না। তাদের বাঁকা হাসির অবশ্য এটিই একমাত্র কারণ নয়।
আনুয়ারাকে বিকেলে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন বিবি সাহেবা। অথবা আনুয়ারা সে রকমই বলেছে। যেহেতু কথাটা দুজনের একজনও বিবি সাহেবাকে জিজ্ঞেস করেনি। অথবা করার সাহস হয়নি।
আনুয়ারাকে কেন বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন বিবি সাহেবা? আনুয়ারা বাবুর্চি হেলালকে বলেছে, কারণ সাহেবের ভাতিজা মিঠু সাহেব।
মিঠুই বা কেন এ রকম একটা স্থানান্তরের কারণ হবে?
৪.
শেষ রাতে বাথরুমের চাপ লেগেছিল, নাকি পানির পিপাসা পেয়েছিল আকলিমা বেগমের, বলা মুশকিল। এ সম্পর্কে পরিষ্কার করে তিনিই বলতে পারতেন। কিন্তু তিনি বেঁচে নেই।
বাথরুমের সামনেই আছাড় খেয়ে পড়েছিলেন। মাথাটা লেগেছিল দরজায়। বুড়ো মানুষ। মাথায় আঘাত পাওয়াটা খুবই ভয়ানক।
ফলে যা হওয়ার তা-ই হলো।
আকলিমা বেগম নিশ্চয় চিত্কার দিয়েছিলেন অথবা তাঁর পতনেও একটা বড় শব্দ হওয়ার কথা। অথচ কেউ শুনল না এসব শব্দ। অবাক! একেবারে ঘুম থেকে ওঠার পর, সেই সকাল সাতটায়—মিঠু যখন ডাকতে গেল চাচিকে, সে টের পেল কিছু একটা ঘটেছে। তার চিত্কারে হেলাল দৌড়ে এল। মিঠু আর মিনিট দশেক দেরি করলে হেলালই প্রথম আকলিমা বেগমকে মেঝেতে আবিষ্কার করত। সে সকালের নাশতা কী হবে জানার জন্য তার শোয়ার ঘরে যেত। অন্য দিন এই সিদ্ধান্ত জানাত আনুয়ারা।
আজ সে নেই।
মিঠুই থানা-পুলিশ করল। পুলিশ এসে অবশ্য ওই হঠাত্ পতনের আলামত ছাড়া আর কিছুই পেল না। ঘরের একটা জিনিসও খোয়া যায়নি। কেউ আলমারি খুলে থাকলেও বোঝার উপায় নেই। তাছাড়া বাইরে থেকে কেউ ঢুকেছে, সে রকমও কোনো প্রমাণ নেই। যদি কোনো ফাউল-প্লে হয়ে থাকে, তা হয়েছে ঘরের ভেতর থেকে। কিন্তু মিঠু বা হেলাল অথবা গ্যারেজের ওপরের ঘরে থাকা জামান-কাউকে সন্দেহের কোনো কারণ কেউ পেল না।
এখন ইরফান সাহেব ফিরলে যদি ঘরের কোনো জিনিস খোয়া গেছে বলে অভিযোগ আসে, তখন ব্যবস্থা করা যাবে।
কিন্তু ইরফান সাহেব কোথায়?
বরিশালে খোঁজ পড়ল। সেখানে তিনি নেই। বন্ধু মতিনের কুলখানির জন্য তিনি বরিশাল গেছেন, অথচ কোথাও তার খোঁজ নেই। এমনকি কুলখানির দিনও তিনি অনুপস্থিত। মিঠু তাঁর সন্ধানে এসে অবাক হলো। কোথায় গেলেন চাচা? বরিশালের থানা পুলিশও কোনো হদিস করতে পারল না। সে ঢাকা ফিরে গেল। ঢাকার থানা পুলিশও একটু বিপাকে পড়ল। না, মৃত্যুর কারণ বা লাশের সদগতির বিষয় নিয়ে নয়; ডাক্তার বলেছে, মৃত্যু হয়েছে আছাড় খেয়ে পড়ে গিয়ে, মাথায় আঘাত লেগে এবং রক্তক্ষরণে। লাশও রাখা হয়েছে বারডেমের হিমাগারে-ছেলেমেয়েদের খবর দিয়েছে মিঠু, তারা এলে কবর হবে। পুলিশ বিপাকে পড়ল এই ভেবে যে যদি ডাকাতি হয়েছে বলে প্রমাণিত হয়, তাহলে তো খুনের একটা আশঙ্কা তৈরি হয়। সেটি হবে কি হবে না, নির্ভর করে ইরফান সাহেবের ফিরে আসার ওপর। কিন্তু তিনি তো লাপাত্তা। এখন তিনি আসার আগে তো লাশ দাফনের অনুমতি দেওয়া যায় না। কে চায় কবর থেকে এক মাস পর লাশ তুলে পোস্টমর্টেম করা। অন্তত কোনো থানা পুলিশ চায় না।
ইরফান সাহেব অবশ্য পুলিশকে উদ্ধার করলেন পাঁচ দিনের মাথায় ফিরে এসে। তিনি সদরঘাট থেকে একটা সিএনজি স্কুটারে চড়ে এসেছেন। কিন্তু ঘরে ঢুকতেই তিনি বুঝলেন, একটা কিছু ঘটেছে। তিনি জোরে চিত্কার করে উঠলেন, আকলিমা! আকু!
শূন্য বাড়িতে তাঁর আকুল চিত্কার শুধু প্রতিধ্বনিই ছড়াল।
পুলিশ খবর পেয়ে তাঁর বিলাপের মাঝখানেই এসে হাজির হলো। তাঁকে বলল, ঘর থেকে কিছু চুরি হয়েছে কি না, দেখতে। তিনি অনিচ্ছা নিয়েও দেখলেন। না, কিছু চুরি যায়নি।
আপনি নিশ্চিত, স্যার? দারোগা জিজ্ঞেস করল।
নিশ্চিত।
পুলিশ হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
তাহলে বারডেম থেকে লাশটা বুঝে নেবেন। দাফনটাফন এসব আপনাদের ব্যাপার। তবে যদি কোনো কিছুর প্রয়োজন হয়-দারোগা ইরফান সাহেবের দিকে ঝুঁকে পড়ে বলল-আমাকে জানাতে দ্বিধা করবেন না, স্যার।
মিঠু তাকে জানাল, স্যারের তিন ছেলেমেয়ে বিদেশ থেকে পরের দিনই পৌঁছাবে। তারপর শেষকৃত্য।
৫.
ইরফান সাহেব যে বললেন দারোগাকে, তার কিছু হারায়নি, কথাটা কি ঠিক?
যেমন, তার বাড়ির দলিলের কথাটাই ধরা যাক। সেটি কি হাওয়া হয়ে যায়নি? হোক না ফটোকপি, যাকে বলে কালার্ড ফটোকপি, মূল দলিলের প্রায় অবিকল নকল, তাতে কী? একজন তো কেউ নিয়েছে। সে মিঠু হতে পারে, আবার না-ও হতে পারে; কিন্তু আলমারি খুলে নিয়েছে তো।
তাহলে ইরফান সাহেব কেন বললেন না কথাটা, পুলিশকে? সে কি এ কারণে যে মিঠু ও তার দুই ভাইয়ের দাবি আছে তাঁর সম্পত্তিতে, অথচ সেই দাবি জানানোর কোনো পথ খোলা নেই তাদের কাছে? ইরফান সাহেবের অনুজ যে বছর মারা যান হূদরোগে, সতেরো বছর আগে, যখন মিঠুর বয়স ছিল বারো কি তেরো—সে বছর ইরফান সাহেব নিজের নামেই সব সম্পত্তির মালিকানা লিখে নেন, অপোগণ্ড বাচ্চাগুলো অন্যদের হাতে যাতে না ঠকে সেজন্য।
প্রশ্ন আরও আছে। শুধু দলিল অথবা দলিলের ফটোকপি নয়, ত্রিশ ভরি সোনাও কি খোয়া যায়নি? কে নিতে পারে এই সোনা? এমন কেউ, যে ইরফান সাহেবের পড়ার ঘরের ড্রয়ারে থাকা একজোড়া ডুপ্লিকেট চাবি চুরি করে নিতে পারে, আকলিমা বেগমের বালিশের নিচ থেকে যদি তা না-ও নেওয়া যায়। আনুয়ারা যে-বিকেলে হঠাত্ বাড়ি চলে গেল অথবা তাকে পাঠিয়ে দিলেন আকলিমা বেগম, তার আগে যেকোনো সময় তো সে ওই ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে আলমারি খুলে গয়না নিয়ে উধাও হতে পারে, আকলিমা বেগম আলমারির চাবি নিয়ে গোসল করতে বাথরুমে ঢুকলেও। বস্তুত ওই মাহেন্দ্র সময়েই।
কিন্তু সাহেবের ড্রয়ার থেকে আনুয়ারা কী করে চাবি আনে? সাহেবের ঘরে তো সে একবার-দুবার কিছুক্ষণের জন্য মাত্র ঢোকে। চা নিয়ে, নয়তো কোনো সংবাদ দিতে।
তাহলে কেন ইরফান সাহেব জানাননি কথাটা পুলিশকে? সেকি এজন্য যে, তাহলে পুলিশকে এও বলতে হয়, এক রাতে লোডশেডিংয়ের শুরুতে মোমবাতি হাতে তার পড়ার ঘরে ঢুকেছিল আনুয়ারা এবং একসময় তিনি জানতে চেয়েছিলেন, বিবি সাহেবা কি অনেক আগে শুয়ে পড়েছেন আজ এবং আনুয়ারা বলেছিল, হ্যাঁ, তিনি বাতের ব্যথার জন্য ঘুমের ওষুধ খেয়ে সাড়ে নটাতেই বিছানায় গেছেন এবং আরও পরে, আনুয়ারার কথার উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ড্রয়ারটিতে তার দরকারি কাগজপত্র থাকে—কলম, চাবি এসব থাকে।
তার কি সংকোচ হচ্ছিল, লোডশেডিংয়ের অন্ধকার নিয়ে পুলিশের সঙ্গে কথা বলতে?
প্রশ্নের এখানেই শেষ নয়। দলিল আর গয়নার সঙ্গে লাখ তিনেক নগদ টাকাও তো গেল। এই টাকা কে নিতে পারে? মিঠু, হেলাল অথবা জামান? হেলালের চাচাতো ভাই নসু, যাকে আকলিমা আদর করে ডাকতেন দস্যি ছেলে, সে একবার বিদেশ যাবে বলে জমিজমা বেচে, ধারদেনা করে লাখ দুয়েক টাকা জোগাড় করে ঢাকা এসেছিল। টাকাটা একটা খামে ভরে রাখতে দিয়েছিল ইরফান সাহেবকে। ইরফান সাহেব বাইরের বারান্দায় বসে কাগজ পড়ছিলেন। ছেলেটা মহাব্যস্ত ছিল। পাসপোর্ট নিয়ে দৌড়াতে হবে থ্রি স্টার রিক্রুটিং এজেন্সিতে। সে টাকাটা ওই টেবিলে রেখেই, ‘স্যার এটা তুলে রাখবেন, কাল সকালে লাগবে’ বলে চলে গিয়েছিল। হেলাল কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দেখেছিল স্যার মুখ ঢেকে কাগজ পড়ছেন। এটি তার সব সময়ের অভ্যাস। সে ‘স্যার, নসুর টাকাটা টেবিলে আছে’ বলে বার দু-এক তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। ইরফান সাহেব ‘ঠিক আছে’ বলে তাকে যেতে বলেছেন, কাগজ থেকে মুখ না সরিয়েই। তারপর তাঁর এককালের পিয়ন মমিন মিয়া এসেছে, পাড়ার নকিব কন্ট্রাক্টর এসেছে সেই পুরোনো একঘেয়ে গান নিয়ে, ‘স্যার, দিন না বাড়িটা, ডেভেলাপারকে’ এবং তিনি ‘তা হয় না নকিব মিয়া। এখন যান।’ বলে তাঁকে বিদায় করেছিলেন। তারপর, মিনিট দশেকও হয়নি নসুর টাকাটা রেখে যাওয়ার পর, ইরফান সাহেব প্রচণ্ড হুংকারে ডেকেছেন হেলালকে। হেলাল এলে তিনি জিজ্ঞেস করেছেন, টাকাটা কই? তুই নিয়েছিস? বিবি সাহেবাকে দিয়েছিস?
না, নসুর টাকাটা পাওয়া যায়নি। পিয়ন মমিনকে পুলিশ ধরে পিটিয়েছে। টাকাটা উদ্ধার হয়নি। নকিব কন্ট্রাক্টর মাথার কিরা কেটে বলেছে, টাকাটা সে নেয়নি। দেখেওনি টাকাটা কোথায় ছিল।
টাকা হারিয়ে বিদেশ যেতে না পারার শোকে নসু ছেলেটা উন্মাদ হয়ে গেল। এখন বাড়ি আছে। কিন্তু জীবনের হাসি-আনন্দ নেই। হেলাল নিশ্চয় ইরফান সাহেবকে টাকা হারানোর জন্য দায়ী করে এখনো এবং তার চাচাতো ভাইয়ের মাথাটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার জন্যও তাকেই দোষে।
পুলিশকে যদি তাঁর সন্দেহের কথা তিনি জানান, হেলাল, জামান বা মিঠুকে টাকা নিয়ে সন্দেহের, তাহলে নসু ছেলেটার মাথা বিগড়ে যাওয়ার গল্পটাও চলে আসতে পারে। এ গল্পটা অমানবিক, কষ্টকর। এটি কেউ জানুক, ইরফান সাহেব তা চান না।
কে নিয়েছিল নসুর টাকা? তার থেকেও বড় কথা, কে নিয়েছে ইরফান সাহেবের টাকা? গয়না যে নিয়েছে, সে-ও তো নিতে পারে অথবা দলিল যে নিয়েছে, সে। তাহলে?
কিন্তু তার থেকেও বড় প্রশ্ন, কেন?
৬.
স্ত্রী মারা যাওয়ার পর কিছুদিন খুব অস্থিরতায় ভুগেছেন ইরফান সাহেব। সেই সময়েই তাঁর ঘুমের সুন্দর রুটিনটা তছনছ হয়ে যায়। রাতে কিছুতেই একটানা ঘুম হয় না। আগে এগারোটার মধ্যে শুয়ে পড়তেন, উঠতেন ছটার দিকে। আকলিমা বেগম অবশ্য শেষরাতে উঠতেন। তাঁকে বাথরুমে যেতে হতো। ইরফান সাহেব কখনো কখনো টের পেতেন। কিন্তু ঘুম ভাঙলেও দ্রুত জোড়া লেগে যেত। তাঁকে ডাক্তার বলেছিল, ভালো ঘুম এবং মধুমেহ থেকে মুক্ত থাকাটা তাঁকে দীর্ঘজীবী করবে।
বাড়িতে মানুষও অনেক কম এখন। দুই ছেলে এক মেয়ে ফিরে গেছে প্রবাসজীবনে। মেয়েটি বাবাকে নিতে চেয়েছিল অস্ট্রেলিয়ায়, কিন্তু স্বামীর নিরাসক্ত ভাব দেখে আর দু’বার বলেনি। ইরফান সাহেব নিজেও প্রবাসে যেতে উত্সাহী নন। দুই ছেলে অবশ্য তাঁকে রাজি করিয়ে বাড়িটা এক ডেভেলপারের হাতে তুলে দিয়েছিল। একটি আটতলা দালান উঠেছে পুরোনো বাড়ির জায়গায়। এ জন্য তাঁকে একটা ভাড়া বাড়িতে থাকতে হয়েছে দেড় বছর। তিনি রাজি হয়েছিলেন প্রধানত আকলিমার কারণে। তাঁর শোয়ার ঘরের মেঝেতে পড়েই তিনি মারা গিয়েছিলেন। ইরফান সাহেবের জন্য ওই ঘরে ঘুমানো দূরে থাক, ঢোকাটাও ছিল কষ্টকর। কিন্তু ভাড়া বাসায় থাকতে গিয়ে তিনি খুব কষ্টে পড়লেন। নতুন ঘর, নতুন বিছানা, একেবারে নতুন পরিবেশ। তার ঘুমহীনতা প্রবল হলো।
আকলিমা বেগম মারা যাওয়ার পর হেলাল ও জামান চলে গিয়েছিল, মিঠুও তার মেসে ফিরে গিয়েছিল। অবশ্য ডেভেলপার বাড়ি তৈরি করা শুরু করলে বড় ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ করে মিঠু কীভাবে যেন একটা ফ্ল্যাট বাগিয়ে নিল। বড় ছেলে দেশে এসে বাবার কাছে তার রাগ ও বিরক্তি জানালেও ইরফান সাহেব কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। বিষয়টা ছেলেকে অবাক করলেও শেষ পর্যন্ত সে বুঝেছিল। ছেলেটা বিদেশে ওকালতি করছে, না বোঝার কথা নয়।
এখন মিঠু স্ত্রী-সন্তান নিয়ে একটা ফ্ল্যাটে থাকে, কিন্তু একবারের জন্যও চাচার ছায়া মাড়ায় না। ইরফান সাহেব খুব ভালো একটা ফ্ল্যাট পেয়েছেন, ছেলেমেয়েরাও একটা-দুটো করে পেয়েছে, সেগুলো ভাড়া দিয়েছে। সবাই খুশি। শুধু ইরফান সাহেবের ঘুমটা আর ফেরে না।
ভাড়া বাসাতে যত দিন ছিলেন, একটা বুড়ো বাবুর্চি ছিল, একটা ছোকরাও ছিল তার দেখাশোনার জন্য। আনুয়ারা একবার তাঁকে দেখে গিয়েছিল এবং বলেছিল, গ্রামের বাড়িতে থাকে—দেড় ঘণ্টার পথ, বাসে আসতে হয়। তা না হলে ঘনঘনই আসত। যাওয়ার আগে ইরফান সাহেবকে বলেছিল, আবার আসবে। কিন্তু সে আর আসেনি। নিজের ফ্ল্যাটে যখন উঠলেন, বাবুর্চিটাকে রেখে দিলেন, ছেলেটাকে বিদায় করে দিলেন এবং কাজের জন্য একটা মেয়েও রাখলেন। মেয়েটা সারা দিন থাকে, সন্ধ্যায় বাড়ি যায়। বাবুর্চিই তাকে জোগাড় করে দিল। একটা ড্রাইভারও রাখলেন, তার নাম অনীল। অনীলকে তাঁর খুব পছন্দ। কথা কম বলে, যত্ন নিয়ে গাড়ি চালায়, যা বলেন তা-ই শোনে।
তবে সব থেকে বেশি যা ইরফান সাহেবের পছন্দ, আর দশটা ড্রাইভারের মতো অনীল বাড়ির কথা বাইরে রটায় না।
কয়েক রাত তিনি ঘুমহীনতার সামান্য অবসরে স্বপ্ন দেখলেন: আকলিমা বেগম তাঁকে বলছেন, বিয়ের গয়নাগুলোও হারিয়ে গেল? স্বপ্নটা প্রতিরাতে একটা আঁচড় পড়া ডিভিডির মতো একই জায়গায় পুনরাবৃত্ত হতে থাকল।
ভোরে বিছানা ছাড়ার আগেও ইরফান সাহেব পরিষ্কার পুরো স্বপ্নটা আবার মনে করতে পারলেন। তাঁর অবাক হওয়ারই কথা, নিজের মৃত্যুর শোক ছাপিয়েও আকলিমার কাছে বড় হয়ে উঠল গয়না হারানোর শোক। কিন্তু তিনি অবাক হলেন না। তিনি বরং অনীলকে ডেকে বললেন, অনীল, চল, একটু নরসিংদীর দিকে যাই।
তিনি গেলেন এবং দুপুরে যখন ফিরলেন, তাঁর হাতের পোঁটলায় আকলিমার বিয়ের গয়না।
দুই দিন পর কাগজে নরসিংদীর একটি গ্রামে বিষ খেয়ে এক গৃহবধূর আত্মহত্যার কথা উঠল। সে উঠতেই পারে। প্রতিদিন এ রকম অসংখ্য গৃহবধূ মৃত্যুকে ডেকে নিচ্ছে পরিত্রাণ হিসেবে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য ঠিক কী কারণে আত্মহত্যা, তা পরিষ্কার বলা হলো না। স্বামী জানাল, সে মাঠে কাজ করছিল, দুপুরে খাবার খেতে এসে দেখল বউ পড়ে আছে রান্নাঘরের মেঝেতে। মুখে ফেনা। জিনিসপত্র কিছুটা ওলটপালট। মুড়ি রাখার টিন থেকে সে একটা কিছু বের করেছিল, তা বোঝা যাচ্ছিল।
স্বামী জানাল, বউয়ের গলায় লাল দাগ ছিল।
আর কেউ কি ছিল না বাড়িতে?
না। ছেলে স্কুলে গিয়েছিল।
প্রতিবেশীরা কেউ বোঝেনি, একটি মেয়ে আত্মহত্যা করেছে?
না। দুই প্রতিবেশীর ঘর বেড়ার ওই পারে। বেড়াটা নতুন লাগানো। দুই বছর থেকে তার ঘরবাড়ি বদলেছে, নতুন চাল উঠেছে, বেড়া বসেছে চারদিকে। একটা ঘর নতুন তুলেছে। গোহাল হয়েছে, গরুও কিনেছে। স্ত্রীর চাকরি করা টাকায়।
স্ত্রী চাকরি করত?
হ্যাঁ, ঢাকায়, এক বাড়িতে। বছর তিনেক হলো জমানো টাকা নিয়ে ফিরেছে।
পুলিশে কেন কেস হলো না? কী যে বলেন!
ইত্যাদি।
৭.
ফেরার পথে অনীল অনেক বিস্ময় নিয়ে ভেবেছে, স্যারের হাত এতটা কাঁপছিল কেন, যখন গ্রামের রাস্তা মাড়িয়ে, পায়ের ধুলো উড়িয়ে বড় রাস্তার পাশে রাখা তার গাড়িতে তিনি উঠে বসেন? গা কাঁপছিল কেন? চোখটাই বা এ রকম লাল ছিল কেন? হাতে শক্ত করে ধরা একটি পোঁটলা ছিল। কে দিয়েছিল তাকে পোঁটলাটা? অথবা মাইল দশেক আসার পর একটা পুলে উঠলে তিনি একটা কিছু গাড়ির জানালা দিয়ে ফেলে দিয়ে দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ছাড়লেন কেন? বস্তুটাই বা কী? কাচের শিশির মতো কিছু মনে হয়েছিল অনীলের কাছে। আবার না-ও হতে পারে। কে জানে!
অনীলের স্বভাব চুপ করে যাওয়া, কথা না বলা। সে চুপ করেই গেল।
৮.
আজ মাঝরাতে বৃষ্টি শুরু হলে ইরফান সাহেব অবাক হলেন। কোত্থেকে এল এই বৃষ্টি? তিনি জানালাটা বন্ধ করতে গিয়ে দেখলেন, বেশ জোরেশোরে বাতাসও দিচ্ছে। ছয়তলায় তাঁর ফ্ল্যাটটাতে ঘন ঘন ঝাপটা লাগছে বৃষ্টির। তিনি শুয়ে শুয়ে বৃষ্টির শব্দ শুনলেন। একসময় চোখের পাতা ভারী হয়ে হয়তো একটু ঘুম এল, কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তিনি জেগে উঠলেন। প্রবলভাবে জেগে উঠলেন। জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়তে থাকল তাঁর, স্বপ্নের আঘাত পাওয়া কোনো মানুষের মতো।
না, আকলিমা বেগম নন। আজ তাঁর স্বপ্নে হানা দিয়েছে নরসিংদীর ওই গৃহবধূটি।
নামটা কী জানি ওই গৃহবধূর?
নামের কী প্রয়োজন? কাগজের রিপোর্টার যদি ভুল নাম দিয়ে একটা খবরই ছাপিয়ে দিতে পারে, তাহলে আমাদেরও তার নাম জানাটা কেন জরুরি, বলুন?
আমাদের জন্য বরং যা জরুরি, তা হলো, এ মুহূর্তে ইরফান সাহেবকে দেখা। তিনি স্বপ্নে মেয়েটির ডাক শুনে উঠে বসেছেন, তারপর বিছানার পাশের ছোট টেবিলের ড্রয়ারে অস্থির হাতে কিছু খুঁজছেন।
এই ড্রয়ারে তিনি ওষুধ রাখেন। ওষুধের ভিড়ে কাচের একটা শিশিও আছে, যে রকম একটা শিশিকে অনীল এক ঝলক গাড়ির জানালা দিয়ে উড়ে নদীতে পড়তে দেখেছিল। অনীল অবশ্য নিশ্চিত ছিল না, ওটি শিশি কি না। আমরাও না।
তিনি কি শিশিটা পেলেন? না পেলে কি টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালাতেন না?
সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০০৭ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত