বিজ্ঞাপন
default-image

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ যুদ্ধ শুরু হলো। আমার ছেলেরা ব্যস্ত হয়ে পড়ল অস্ত্র আর লাঠিসোঁটা গোছাতে। কয়েক বন্ধুকে নিয়ে ওরা আমাদের পাবনার সাধুপাড়া মহল্লার বাড়িতে ক্যাম্প তৈরি করল। দিন-রাত ওরা কী যেন পরিকল্পনা করত। আমি জানতে চাইলে বলত, মা, যুদ্ধ শুরু হয়েছে। পাকিস্তানি সেনারা নির্বিচারে মানুষ খুন করছে। ওদের থামাতে হবে। আমি আর কিছুই বলতাম না।

২৭ মার্চ পাবনা টেলিফোন অফিসে যুদ্ধ হলো। পাকিস্তানি সেনাদের যুদ্ধে হারিয়ে পতাকা ওড়ালেন মুক্তিযোদ্ধারা। ভয়ে আমাদের বাড়ি থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো। ৭ এপ্রিল খবর পেলাম, পাকিস্তানি বাহিনী আরও শক্তিশালী হয়ে নগরবাড়ী ঘাট দিয়ে পাবনা শহরের দিকে আসছে। আমি তখন দুই মেয়েকে নিয়ে সুজানগরে বাবার বাড়িতে। ছেলেরা সেখানে গিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করল। বলল, মা, এখানে আর থাকা যাবে না। ওরা চলে যায়। অনেক দিন খোঁজ পেতাম না ওদের। তাই আমিও ঢাকার মগবাজারে আমার বড় ছেলে মোজাম্মেল হোসেনের বাসায় যাই। ২৭ জুলাই গভীর রাতে দুই বন্ধুকে নিয়ে ছেলেরা আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে। পরদিনই আবার চলে যেতে চায় ওরা। আমি নিষেধ করি। ওরা আমাকে প্রশ্ন করে, সব মা যদি ছেলেদের ঘরে আটকে রাখে, তাহলে দেশ স্বাধীন হবে কীভাবে? মা-বোনের ইজ্জত রক্ষা করবে কে? আমি আর আটকাইনি ওদের। ওরা চলে যায়। তবে হঠাত্ হঠাত্ রাতে আসত। এসেই বলত, মা, খুব খিদে পেয়েছে, খেতে দাও। রাতটা কোনোমতে পার হলে সকালেই আবার চলে যেত ওরা। মাঝেমধ্যে আমি কাঁদতাম। তখন ওর বাবা আমাকে সান্ত্বনা দিত।

৫ ডিসেম্বর আমার মেজো ছেলে মোস্তাক হোসেন ও মোশারফ হোসেন কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়। ৮ ডিসেম্বর ঢাকার রূপগঞ্জে পাকিস্তানি সেনারা ওদের ঘিরে ফেলে। পরবর্তী সময়ে যত দূর শুনেছি, সেদিন সেখানে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে ছেলেরা সম্মুখযুদ্ধ করেছিল। কিন্তু অপ্রস্তুত থাকায় সে যুদ্ধে ওরা জিততে পারেনি। আমার দুই ছেলেসহ বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা সেদিন শহীদ হন।

খবরটা আমার কাছে গোপন রাখা হয়েছিল। কিন্তু বাসার সবাই কী যেন কানাঘুষা করত। আমি গেলেই সব চুপ। এভাবেই চলল বেশ কিছুদিন।

১২ ডিসেম্বর, বিকেল চারটা। আমরা বড় ছেলের ঢাকার বাসায়। দ্বিতীয় ছেলে মোকারম হোসেন, তৃতীয় ছেলে মনসুর হোসেন ও জামাতা আবু ইউসুফ বাসায় ছিল। সবাই ক্লান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে। বড় মেয়ে দৌড়ে এসে খবর দিল, মা, মেশিনগান লাগানো চারটে আর্মির গাড়ি এসে আমাদের বাড়ি ঘিরে ফেলেছে। আমি উঠে দাঁড়ানোর আগেই ওরা দোতলায় উঠে আসে। সবাইকে বাড়ি থেকে বের হতে বলে। একজন পাকিস্তানি আর্মির হাতে বেশ কিছু কাগজ ছিল। সে কাগজ দেখে আমার ছেলেদের নাম ধরে ডাকছিল। ছেলেরা ভয়ে কাঁপছে। আমি তাকাতে পারছিলাম না ওদের দিকে। আর্মিরা বাড়ির সবাইকে ঘর থেকে বাইরে বের করে। বাড়ির উঠানে গোল করে বসায়। সবার নাম জানতে চাইলে ছেলেরা মিথ্যা নাম বলে। কিন্তু ওরা কিছুই মানে না। ওরা আমার দুই ছেলে ও জামাতাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। ছেলেরা যাওয়ার সময় শুধু বলেছিল, মা, তুমি চিন্তা কোরো না, আমরা ফিরে আসব।

ওরা আর ফিরে আসেনি। কদিন পরই দেশ স্বাধীন হয়। আমি ওদের প্রতীক্ষায়। শেষ পর্যন্ত খবর পেলাম, পাকিস্তানি আর্মিরা ওদের হত্যা করেছে। কিন্তু কোথায়, কীভাবে, আজও তা জানতে পারিনি।

পাবনায় ফিরে এসে দেখলাম, ঘরে যা ছিল সব লুট হয়ে গেছে। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বাড়ির একাংশ। চার সন্তান ও জামাতাকে হারিয়ে এলোমেলো হয়ে গেল সবকিছু। বুকের মধ্যে একটা পাথর ভর করল। অনেক কেঁদেছি তখন। আজও বারবার মনে পড়ে আমার সন্তানদের স্বপ্নের কথাগুলো। চিন্তা হয়, কী চেয়েছিল ওরা, আর কী পেলাম আমরা। আজও মনে হয়, ওরা ফিরে আসবে। বলবে, মা, খুব খিদে পেয়েছে, খেতে দাও।

অনুলিখন: সরোয়ার উল্লাস, পাবনা