বিজ্ঞাপন
default-image

সেই ভয়ঙ্কর রাত এখনো চোখের ওপর ভাসে অরণ্যর। মনে হয় এই তো সেদিন। দক্ষিণ দিক থেকে উড়ে উড়ে আসছে ঝাঁকে ঝাঁকে লাল-নীল-হলদে আলোর ফুলঝুড়ি সঙ্গে দানবিক শব্দ। রাজারবাগ পুলিশ ফাঁড়ির দিক থেকে। ওগুলো কিসের গোলা তখনো দেশের লোক জানত না। জানত না জনবহুল ঢাকা শহরের রাজপথ দিয়ে গড়গড়িয়ে এগোতে পারে সমরাস্ত্র ট্যাঙ্কবাহিনী। ঘড়ির কাঁটা মিলালাম বারোতে।

অবশ্য এখনো মনে হয় এই তো সেদিন, বৃহসিতবার প্রচণ্ড তুফানের আগে প্রকৃতি যেমন থমথম করে, ঠিক তেমনি ছিল গোটা ঢাকার দিনের চেহারা। বিক্ষোভ-বিদ্রোহের চূড়ান্ত রূপ প্রতিটি বাঙালির বুকে। পোস্টার মিছিল। গণমানুষের উষ্ণ ্পোগান-

ভিয়েতনামের পথ ধর

বাংলাদেশ স্বাধীন কর...

প্রতিবেশীদের কেউ কেউ পাড়া বদল করছিল। যাদের বাড়ি রাজপথের ধারে তারা এক কাপড়ে চলে যাচ্ছিল গলির ভেতরের আত্মীয়স্বজনদের আস্তানায়। গুজব ছিল আজ একটা কিছু হবে। এই কিছুটা কী, সঙ্ষ্ট ছিল না। সাধারণের ভেতর ছিল কিছু ঘটনা এবং গুঞ্জন। বিপুল ভোটে জিতেও কেন মুজিব ক্ষমতায় যেতে পারছেন না। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নানা বাহানায় একটার পর একটা বাধার ফলক। জুলফিকার আলী ভুট্টো, জেনারেল ইয়াহিয়া খান দিচ্ছে চালের পর চাল। পরিষদে অনুপস্থিত ভুট্টো। অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবী বৈঠক। বন্ধ স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকায় হরতাল। পরে পুরো বাংলাদেশে। সামরিক জান্তার পক্ষ থেকে জারি হয়েছে কার্ফ্যু। হঠাত্ হঠাত্ বন্ধ হয়ে গেছে ট্রেন-প্লেন ও যাবতীয় যাতায়াত ব্যবস্থা। অফিস-আদালত। আবার হাওয়ায় উড়ে এসেছে ভয়াবহ আতঙ্ক সংবাদ-রাতের অন্ধকারে তেজগাঁও বিমানবন্দরে দলে দলে পাকিস্তানি সৈন্য নামছে। চাটগাঁ জাহাজ থেকে নামছে ট্রাক বোঝাই যুদ্ধাস্ত্র-কিসের আলামত?

সেদিন আবার সকাল থেকে রাত্রির শরীর খারাপ। অন্ত্রের পুরনো সেই বংশগত ব্যথাটা। কলিকপেইন। ওষুধে সাময়িক সারে আবার মাথাচাড়া দেয়। রাত্রি খেয়াল করেছে ভাবনা-চিন্তার জটিলতা এলে বাড়াবাড়ি হয়। ডাক্তারও সায় দিয়ে যে আশ্বাস দিয়েছেন সেটা এ রকম-বয়স তিরিশ হলে এটা আপনিই চলে যায়।

সান্ত্বনার বদলে মাথায় হাত তুলছে রাত্রি-ওহ্ গড, কবে হবে তিরিশ! বিষয়টি মোটেও হাসির নয়? কিন্তু হেসে ফেলেছে অরণ্য-তুই দেখছি উল্টো প্রকৃতির। বিশেষ করে মেয়েরা তো বয়স কমাতে ওস্তাদ।

রাত্রি ধমক দিয়েছে, তুই থামবি! ইস আরো চার বছর এই অসহ্য কষ্ট ভোগ করতে হবে।

এরপর ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পর্ব আসবে। সেদিন ভীষণ ব্যস্ত বরেণ্য। বায়তুল মোকাররমে ইলেক্ট্রনিকসের মস্ত দোকান। পেছনের দরজা দিয়ে মতিঝিল মুগদাপাড়ার খাল দিয়ে কিছু কিছু মাল রোজই সরাচ্ছে। ডাক্তারের বিষয়টা তার ঘাড়ের ওপর আসার আগেই অরণ্য কেটে পড়ল। শহীদ মিনারে গরম গরম বক্তৃতা রয়েছে। রয়েছে সারা শহর ভরে ভাগে ভাগে মিছিল পরিচালনার দায়িত্ব।

অরণ্য যখন বেরোয়, বরেণ্য তখনো ঘরে। পেটের ব্যথাটা হলে নিজের ওপর নিজে বিরক্ত হয়ে যায় রাত্রি আজকাল। স্বামীর বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি দেখে চোখ ফেরাল দেয়ালের দিকে। সেখানে যেন কেউ খাড়া এমনভাবে বলল, তোমাদের অসুখ হলে দিন নেই রাত্রি নেই, সেবা আর সেবা। নইলে স্ত্রীধর্ম থাকে না। আর আমাদের কিছু হলে সাত দিনেই বদল হয়ে যায় স্বামী দেবতার ভৌগোলিক চেহারা।

সে তর্কে না গিয়ে বরেণ্য নরম, কিছুটা অসহায় ভঙ্গিতে বলল, কী করব, ওদের টার্গেট যদি গুলিস্তান হয় পুরো এলাকা ছাই হয়ে যাবে। চাকরি করলাম না। ধরলাম পৈতৃক ব্যবসা। যুদ্ধ আসুক, চলুক বা শেষ হয়ে যাক রোজগারের রাস্তাটা খোলা রাখতে হবে তো।

কোথায় সরাচ্ছ সব?

কদমতলীতে আরহামের বাড়ির একটি ঘরে। পাড়াটা এত ভেতরের দিকে, আর্মি অ্যাকসনেও ভয় কম। দেখছ না মিছিলকে ওরা যত তাড়া দিক, ধরপাকড় করুক, যদি একবার গলিতে ঢুকে যেতে পারে জনতা, ওরা আর এগোয় না। একটা ভয় পাঞ্জাবিদের ভেতর অলরেডি ঢুকে গেছে, ভেতো ভীরু বাঙালি রূপান্তরিত হয়েছে, সাহসী হচ্ছে দিনদিন।

কি জানি আরো কী কী বলছিল বরেণ্য, ব্যথায় চোখে অন্ধকার দেখছিল রাত্রি। ঢুকরে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। তো সে কাঁদবে কি! তাকে মড়ার মতো পড়ে থাকতে দেখলে রনি বারবার ঝাঁপ দেয় বুকের ওপর। বয়স হলো বছর পেরিয়ে আরো দু মাস। এখনো দুধ ছাড়েনি। বোতল ধরাতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে বারবার। বরেণ্য দিয়েছে প্রশ্রয়ের হাসি-থাক না আরো কিছুদিন। ডাক্তার চাচা তো বলেন স্বাস্থ্যবতীদের কোনো ক্ষতি হয় না। বরং বাচ্চার কলিজা বড় হয়। মানে ভবিষ্যতে আমাদের রনি হবে হূদয়বান মানুষ।

মুখ বাঁকাল রাত্রি-হূদয়বান মানুষ! তুমি তো বলবেই। কষ্টটা তো আর তোমাকে সহ্য করতে হচ্ছে না।

উম! তবে মূল্যহীন কষ্ট নয়। মা বলতেন একালের আমরা নাকি দিন দিন অনুদার হচ্ছি। স্বার্থপর বেশি বেশি। তার একটা বড় কারণ, প্রজন্মের মায়েরা ফিগার ফিগার করে শিশুদের বঞ্চিত রাখছে প্রকৃতিদত্ত আসল খাবার থেকে। মায়েরা এমন হলে ভবিষ্যতে মানুষ নাকি স্বভাব চরিত্রে নিষ্ঠুর হবে। অমানবিক হবে।

মায়েদের সবই সেকেলে।

হয়তো। কিন্তু এটা কি অস্বীকার করতে পারি, চোখের ওপর অনুদার পারিপার্শিকতার জমি দিন দিন বাড়ছে। প্রাণবন্ত দিলদরিয়া মানুষদের এখন মনে করা হচ্ছে মূর্খতার অংশবিশেষ।

তুমি একটা একচোখা অন্ধ। অতীত-ভবিষ্যত্ দেখছ বর্তমান এড়িয়ে। এই খুদে দস্যুটার হাত থেকে আপাতত আমায় তো বাঁচাও।

এই ব্যাটা ওঠ, যা কিমতির মার কাছে।

রাত্রির বুক থেকে রনিকে নিজের কোলে তুলে নিতে কিমতির মা এল জামবাটিতে ফ্রিজের ঠাণ্ডা পানি নিয়ে। রকিসহ বরেণ্য বেরিয়ে যেতে শাড়ি আলগা করে নাভির নিচে নামিয়ে আনল রাত্রি। কিমতির মা পেটে শীতল পানির বাটি চেপে ধরে বলল, আপনে তো আফা কথা গেরাজ্জি করেন না আমগো মতন ফেলনা-হেলনা মানুষ গো। এই বিষ আমাগো বংশেও আছিল। হেরা কাদামাটির আস্তরা লাগাইত প্যাটে। আরাম হইয়া যাইত।

হয়তো ঠিক হয়তো নয়। এই তো কিছুদিন আগে রকির পায়ে দানা দানা কি হলো। ডাক্তাররা রায় দিলে পুরো জায়গাটা অস্ত্রে চেছে ফেলতে হবে। ওইটুকু বাচ্চা, মার কথায় প্রতিদিন দুবেলা নিম পাতায় গরম পানিতে পা পরিস্কার করে দিতে দিতে সাত দিনে চলে গেল আলাই বালাই। দরকার হলো না অপারেশনের। বলতে নেই এই যে এত তীব্র ব্যথা ওষুধের চেয়ে কম কাজ করে না শীতল পানির সর্ঙ্শ। বেদনা কমের দিকে গেলেই তন্দ্রা তন্দ্রা ভাব আসে। তেমনি একটি অবস্থায় শুনল কিমতির মা ফিসফিস করে বলছে অ আফা, পুবে-দক্ষিণে এগুলান কী শুনতাছি। কী শুনতাছি গো?

আধ জাগরণ থেকে রাত্রি শুধাল, কী?

দেয়ালেরও কান আছে-এমনি করে চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে কিমতির মা বলল, উত্তর-পশ্চিমে হাকিহুকি শুনতাছি কী বলে হইব। পশ্চিমের তেনাদের নাকি হাউস হইছে আমগো মাইরা ধইরা হেগো গোলাম বানাইবো। হাচানি আফা!

গেল তন্দ্রা। গেল মাথার ভেতরের মিষ্টি ঝিমিঝিমি। বিরক্ত হয়ে রাত্রি বলল, এসব আজব কথা কে যে বলে তোদের। যা রান্নাঘরে যা। আমার জন্য হেলেঞ্চার ঝোল করবি কৈ মাছ দিয়ে।

আর হগ্গলের?

জানি না, যা। এক বাবু তো কোন সকালে হাওয়া হয়েছে। আর একজন যাই যাই করছে। যা তোর মনে হয়, তাই করগে।

রাত্রি ঘুরে শুতে যাবে, ঢুকল বরেণ্য। লম্বা ঘোমটা টেনে কিমতির মা চলে যাবে, দাঁড়াল মনিবের কথায়। বরেণ্য বলল, কিমতির মা, চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ যা আছে মাস কাবার হবে তো?

কিমতির মা ঘাড় নাড়ল-হ। ইবার তো সাব মাসের বাজার আগে আগেই করলেন। ফিরিজে মাছ-গোশতও মওজুত।

কিমতির মা বেরিয়ে যেতে কাঁধে ঘুমিয়ে পড়া রকিকে রাত্রির পাশে শুইয়ে দিয়ে বরেণ্য বলল, আমি যাচ্ছি রাত্রি। দরজা জানালা সাবধানে খুলো।

রাত্রি একটু ঝংকারের ভেতর বলল, খোলার কি দরকার আছে? আমার শরীর খারাপ শুনলে মা ছুটে আসতেন। তা ও বাড়ির সবাই তো দেশে চলে গেছেন। তুমি লাট্ সাহেব লোহা লক্কড় বাঁচাতে চলেছ। আর এক লাট সাহেব দেশ উদ্ধার করতে পথে-ঘাটে ঘুরছে। আমি যে একটা রুগ্ণ মানুষ ব্যথায় গড়াগড়ি খাচ্ছি, অবসর আছে কারো দেখার?

বরেণ্য জুতোর ফিতে বাঁধতে বাঁধতে বলল, বিশ্বাস করো, তোমায় এমনি ফেলে যেতে আমার খারাপ লাগছে। খু-উ-ব।

করলাম বিশ্বাস। আরে আমার জন্য যাই হোক, রকিটার কষ্ট যাবে। আমি যন্ত্রণায় কাতর। আগাম বাজার করে কিমতির মাকে ফেলে দিয়েছ বেশি বেশি কাজে।

কী করব। সবাই বলছে খাবার দাবার কিছু মওজুত করতে। মুজিব-ইয়াহিয়ার বৈঠক বানচাল হয়েছে, দেশের মানচিত্রের ওপর বোদ্ধারা দেখছেন অশুভ কালো ডানার ছায়া। সাবধানে থেক।

-তুমি কখন ফিরবে?

-অন্ধকারে মালপত্র চালান করে তারপর।

-দিনেরবেলা করা যায় না ওসব?

-মাথা খারাপ! রাজধানীর কেন্দ্র জায়গাটিতে দোকানপাট স্বাভাবিক রাখতে হবে। নানা উছিলায় পাক আর্মিরা ওই সব দিক টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। সন্ধ্যার অন্ধকার ছাড়া উপায় নেই। কি প্রহসন বল, নিজের জিনিস নিজে সরাচ্ছি। চোরের মতো।

বরেণ্য উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চলি।

রাত্রি কাঁধের আঁচল ঠিক করে বলল, আমি উঠতে পারব না। তুমি কাছে এস।

বরেণ্য বিছানায় এসে বসতেই রাত্রি স্বামীর বুকে মাথায় সূরা পড়ে ফুঁ দিয়ে বলল, সাবধানে যেও। আমি বড় ভাবনায় থাকি।

বরেণ্য মৃদু হেসে বলল, থেকো না। এই তো অদৃশ্য বর্ম পরিয়ে দিলে। বালা-মুসিবত দূরে থাকবে।

রাত্রির বিশ্বাসও তেমনি ছিল। কিন্তু বাস্তবে ফল হলো একদম বিপরীত। বরেণ্য ফিরল পাড়ার স্বেচ্ছাসেবী যুবকদের ধরাধরিতে রক্তাক্ত অবস্থায়। পাকিস্তানি আর্মিদের অ্যাকশন শুরু হয়ে গেছে রাত বারোটায়। গোলাগুলির শব্দে কাঁপছে পুরো শহর। যে ছেলেটি ডাক্তার নিয়ে আসবে বলেছিল সে আর ফেরেনি। ফেরেনি অরণ্যও। কি জানি কি আতঙ্কে একটানা কাঁদছে রকি। কাঁদছে রাতের বেড়াল, রাস্তার কুকুর। নীড় ছেড়ে দিশেহারার মতো নিরাপদ শূন্যে চক্কর খাচ্ছে পাখিরা। কিমতির মা আহাজারি করছে বুক চাপড়ে-মাবুদ গো, ঠিক রোজ কেয়ামতের রাইত নামায়া দিলা ঢাকা শহরে!

ওদিকে বিছানা ভেসে যাচ্ছিল রক্তে। বুক-পিঠ দুদিকেই জখমি বরেণ্য। রাত্রি ভেজা তোয়ালায় যতবার মুছতে গেছে ফিনকি প্রবাহ থামাতে পারেনি। দু-একটি কথার মধ্যে থেকে আবার জ্ঞান হারিয়েছে বরেণ্য। জ্ঞান এলেই বলছে, রাত্রি তোমরা পালাও।

কোথায় পালাব?

যেদিকে হোক। আমি শুনে এসেছি রাজারবাগ পুলিশ লাইন ওরা যদি অতিক্রম করতে পারে, পাড়ার ভেতর ঢুকে পড়বে। সেই গণহত্যা হবে নজিরবিহীন। রকিকে যে করে হোক বাঁচাতেই হবে।

কেঁদে কেঁদে হয়রান হয়ে রকি তখন ঘুমুচ্ছে। বুট-মোটরের মতো বাইরে তখনো একটানা গোলাগুলির বিকট শব্দ। এই রাতের বুঝি সকাল নেই। মানুষের সাড়াশব্দ নেই। আছে শধু মারণাস্ত্রের দানবিক দাপাদাপি।

ভয়ঙ্কর সেই সব আওয়াজ ছাপিয়ে চারদিক থেকে নয়, যেন আকাশ থেকে ভেসে আসতে লাগল আজানের সুরধ্বনি। সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হলো তামাম বীভত্স শব্দের। রাত্রি শুধু নিজের আহাজারি শুনছে, কে কোথায় আছ? একজন ডাক্তারকে খবর দাও।

বাইরের রাস্তায় প্রচুর লোকের পায়ের শব্দ। জানালা খুলে দিয়েছে কিমতির মা। সূর্যের প্রথম আলোর সঙ্গে ঢুকল এলোমেলো গুঞ্জন। পথ ভর্তি পলাতক মানুষের ঝাঁক। কোথায় ছিল সারারাত এরা? কিন্তু কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছে না। উদভ্রান্ত দৃষ্টি সবার চোখে। সম্ভব হলে তারা দৌড়াত। জায়গা নেই বলে হাঁটছে। পেছনে যেন তাড়া করে আসছে অদৃশ্য আজরাইল। রাত্রির গলা শুকিয়ে কাঠ। স্বগতোক্তির মতো উচ্চারণ করল, এত এত লোক অথচ আমার স্বামী মরে যাবে বিনা চিকিত্সায়।

গণজোয়ারের গুঞ্জন থেকে সমবেত থাকার আতঙ্কের মতো ফুটে এসেছে, ট্র্যানজিস্টরে পাক সরকার ঘোষণা দিয়েছে, অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য জারি হলো কার্ফ্যু। সাধারণের ধারণা, নাগরিকদের গৃহবন্দি করে আবার শুরু হবে হত্যাজজ্ঞ। সুতরাং রাজধানী ছাড়া যে যেদিকে চোখ যায় ভেগে পড়। হায় হায় করতে করতে চলতি জনতায় কখন মিশে গেছে কিমতির মা। ক্ষুধায় কাঁদছে রকি। রবেণ্যর সাড়া শব্দ নেই। রাত্রি বুঝি পাগল হয়ে যাবে। তখনি ঝড়ের মতো ঢুকল অরণ্য। বিকারগ্রস্তের মতো রাত্রি অনবরত বলছে, ডাক্তার, একজন ডাক্তার চাই।

কেউ কি আছে কারো ঠিকানায়।

অরণ্য হাঁটু ভেঙে বসে বরেণ্যর আধাসোয়া দেহ কোলে তুলে নিল। ব্লিডিং তখন বন্ধ হয়েছে। এক সময় আধখানা চোখ মেলেও তাকাল বরেণ্য। কান পেতে শুনতে হয় এমন আবছা স্বরে বলল, পালা। এখনো পালাসনি কেন তোরা।

তোমার জন্য দেখি রিকশা-টিকশা একটা জোগাড় করতে পারি কি না। কিছু পাবি না। আমিও বাঁচব না। রকিকে বাঁচা।

বরেণ্য আবার চোখ বুজল। পড়ে রইল নিস্তেজ প্রাণহীন মড়ার মতো। কী করবে বোঝার মতো শক্তি নেই। গত রাতের স্বেচ্ছাসেবকদের একজন নবী ভাই ঢুকলেন। বলতে গেলে এক রকম জোর করে ওদের নামিয়ে দিলেন পথে। বরেণ্য যদি বেঁচে থাকে রাত অবধি, অন্ধকারে চিকিত্সার ব্যবস্থা হবে।

সেই থেকে এক হাতে রাত্রিকে ধরে, রকিকে কাঁধে ফেলে পলাতক মানুষদের সঙ্গে পথ চলছে অরণ্য। বিশাল বাহিনীর কারো মধ্যে ক্ষুধা-তৃষ্ণা, ক্লান্তি কিছুই যেন নেই, কেবলি পথ থাকলে সামনের দিকে চলা। এ চলার গন্তব্য কেউ কিছু জানে না। পড়ন্ত বেলায় দেখল রাস্তার দুধারে নানা বয়সের মানুষ। প্রত্যেকের হাতে পানি, গুড়, মুড়ি, চিঁড়া, খই। চলমান বিশাল দল যেন উপলব্ধিতে এল ক্ষুধা তৃষ্ণার। রাত্রি ধুলায় বসে তাকাল অরণ্য রকি কি এখনো বেঁচে আছে?

দেখা গেল চিঁড়া-মুড়ির সঙ্গে বোতল বোতল দুধ এসেছে শিশুদের জন্য। রাত্রি জ্ঞান হারিয়েছে সেই কথা বলে। পাশে কাটান এক গ্রামীণ প্রৌঢ়ার কাছ থেকে একটা বোতল নিয়ে অরণ্য জোড় আসনে বসে গেল। প্রায় নিস্তেজ রকির মুখে ধরল বোতলের নিপল। ওকে সাহায্য করল অন্যূন আশি প্রৌঢ়া। এমনও উপদেশ দিয়ে গেল, দিনেমানে না খাওয়া শুকনো পেট। রয়েসয়ে দুধ পান করাতে হবে বাবা।

খাবার আয়োজন এমন কিছু নয়। তবু দেহে চৈতন্যে আতঙ্কিত জনজোয়ার যেন আবার চলার গতি পেল। বয়স্কদের অনেকেই ঘাসের বিছানায় শুয়ে রইল। আর এগোনোর ক্ষমতা তাদের নেই। বাকিরা আবার চলতে শুরু করেছে। কোথায়, কেউ জানে না। তবে নদী পার হয়ে ওপারে। পাকসেনাদের শুনেছে পানিতে বেজায় ভয়। রকিও ঘুমাচ্ছে একটা বকুল গাছের ছায়ায়। রাত্রির চোখে-মুখে পানি দিতেই জ্ঞান ফিরেছে। জোর করে ওকে খাইয়ে নিজেও কিছু চিবিয়ে অরণ্য আবার সামনের দিকে এগোল। সূর্য ডুবল এক হাটে। খুবই স্বাভাবিক হাট। বেচাকেনা চলছে। তার মধ্যে মুখ্য আলোচনা, উত্তেজনা, শুক্রবার দিবাগত রাতে ঢাকা শহর আবার আক্রান্ত হবে। সারা দিন একটানা চলে পা টাটাচ্ছে। বুঝি শিরা ফেটে রক্তক্ষরণ হবে। যে দোকানে চা কুকিজ খেল তাকে অরণ্য জিজ্ঞেস করল, ভাই আমাদের সঙ্গে শিশু রয়েছে। রাত্রিবাসের মতো কোনো জায়গা পাব?

পরম সুহূদের মতো চাওয়ালা বলল, ভাই আমি গরিব মানুষ তাও বাড়তি চালা থাকলে আপনের পরিবার লয়া যাইতাম।

সে একটা সাহাবাড়ির খবর দিল। সাহারা হপ্তা খানেক আগে বর্ডার পার হয়ে গেছে। সেখানে গেলেও পেতে পারে একখানা ঘর। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখা গেল বিশাল অট্টালিকার গৃহ, অলিন্দ ছাদ সব ভর্তি। উঠানের গাছতলায়ও পড়ে আছে কেউ কেউ। এত মানুষ কিন্তু সাড়াশব্দহীন মৃতপুরী যেন। এক কাঁধে অর্ধ চৈতন্য রাত্রি, অন্য কাঁধে ঘুমন্ত রকি। একটা তালগাছে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে অরণ্য তাকাল আকাশের দিকে। খুব আশ্চর্য লাগল প্রতি সন্ধ্যার মত জ্বলছে কোটি নক্ষত্রের চোখ। পৃথিবী তাহলে ধ্বংস হয়ে যায়নি। ইস্রাফিলের সিঙ্গার ফুঁ-এ ফানা ফানা হয়ে যায়নি আসমান, জমিন, মাটি।

একটা যান্ত্রিক শব্দ ক্রমশ কাছে আসছে। অসঙ্ষ্ট আদমের আকৃতি। অবনীতে আধার নামলেও দূর অন্তরীক্ষ থেকে বুঝি তারারা পাঠায় মোছা মোছা আলো। লোকটি বলল, কতকাল পরিবারসহ গাছতলায় দাঁড়িয়ে থাকবেন মশাই!

না বসব শোব। হয়তো ঘুমিয়েও যাব।

যদিও মার্চ মাস। কিন্তু পাড়াগাঁয়ে শেষ রাতে শিশির পড়ে। বাচ্চাটার ঠাণ্ডা লাগবে। আপনাদের সঙ্গে তো দেখছি একটা গায়ের চাদরও নেই।

কাল কিনে নেব। পালাবার সময় ক্যাশ ছাড়া সঙ্গে আর কিছু আনার কথা মনে হয়নি। সম্ভবও ছিল না। আপনারা আমার সঙ্গে আসুন।

ভদ্রলোক নিজের নাম বলেছিল অঞ্জন সাহা। এ বাড়ির শেষ রক্ষক। কিন্তু গত রাতের ঘটনার পর সেও বর্ডার ক্রসের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নিজের ঘরের চাবি খুলে দিয়ে বলল, যদ্দিন প্রয়োজন এখানে থাকুন।

যাওয়ার আগে ধরিয়ে দিয়ে গেল হাতের ট্রানজিস্টার এবং একটি দিয়াশলাই। তার চেহারাটাও সঙ্ষ্ট করে দেখা হলো না। শুধু শুনল মধ্যরাতের নিশুতি বাতাসে ফিসফিস করছে এক পুরুষ কণ্ঠ, এখন রওনা না হলে নদী পার হতে গিয়ে নররাক্ষস পাকসেনাদের ক্রস ফায়ারে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা।

মানুষ নয়, অপার্থিব কেউ যেন করে দিয়ে গেল বেঁচে থাকার সম্ভাবনা। রকিকে রাত্রির কাছে দিয়ে দিয়াশলাই জ্বালাল অরণ্য। মাঝারি ঘর। টেবিলে হারিকেন। আলো জ্বলতে সঙ্ষ্ট হলো সাবেকি আমলের খাট। আরমারি, আলনা, র্যাক, একটা মিটসেভও। তার ভেতর মিষ্টির হাঁড়ি। রঙচটা বিস্কুটের টিন। বিছানাটা এলোমেলো হলেও শোবার মতো সবই রয়েছে। রকিকে বুকে জাপটে রাত্রি। অরণ্য কাছে বসে বলল, তুই কেমন আছিস?

রাত্রি পরিশ্রান্ত স্বরে জবাব দিল, তুই ভালো আছিস তো? যা ধকল গেল তোর ওপর দিয়ে।

আমার ওপর দিয়ে?

অরণ্য দীর্ঘ নিঃশ্বাস সামলাল, কণ্ঠস্বর সামাল দিতে পারল না-হারামজাদা, কুত্তার বাচ্চারা কি ব্যক্তি ভাবনা বলে কিছু অবশিষ্ট আর রেখেছে। তবু জীবন থেমে থাকার নয়। ক্ষুধা-তৃষ্ণা জীবিত মানুষের বেঁচে থাকার অন্যতম শর্ত। মিষ্টি আছে। খাবি?

বমি হয়ে যাবে।

তাহলে থাক। দেখ ঘুমাতে পারিস কি না।

কী করে পারব? ওকে ওই ভাবে ফেলে এলাম।

রাত্রি যে অবস্থায় তাকে রেখে এসেছি হয়তো এতক্ষণে অসমাপ্ত কথায় থেমে গেল অরণ্য। রাত্রি ফোসফোসে কাঁদছে। এক সময় আবার অবাক হয়ে নিজেই যা শুনল, সে জাগতিক কথাবার্তা বলছে, অরণ্য ট্রানজিস্টরে কোনো খবর আছে?

বিবিসি ধরছে। কিন্তু সঙ্ষ্ট তেমন নয়।

তাহলে শুয়ে পড়। না কিছু খা তার আগে।

না রে, খাবার কোনো ইচ্ছা নেই।

খাটটা বড় রীতিমতো। কুচিমুচি হয়ে একদিকে রকিসহ রাত্রি। মাঝে অনেকটা ফাঁকা রেখে অরণ্য। বলল, ব্যথাটা আর ওঠেনি তো?

হয়তো উঠেছে। মহাআতঙ্ক কেড়ে নিয়েছিল বোধশক্তি।

সেটা যে কত সত্য বোঝা গেল পরদিন থেকে এবং পাশাপাশি কয়েক দিন। একবেলা ভালো থাকে তো অন্য বেলা উথাল-পাথাল যন্ত্রণা। অরণ্য রাত্রির নির্দেশমতো পুকুর থেকে কাদামাটি তুলে প্রলেপ লাগিয়েছে পেটে। সাময়িক সুস্থ।

সাহাদের আট্টালিকা শুধু প্রকাণ্ড নয়, সীমান্ত লাগোয়া পুকুরটা বড় এবং গভীর। ওপারে পুরুষদের ঘাট, এপারে মেয়েদের। মূল বাড়ির অন্দরে এক মানুষ সমান উঁচু বারান্দা। বার বাড়িতে এক ডজন চওড়া দীঘল সিঁড়ির ধাপ। শহর পালান মানুষেরা শূন্য সোপান ভরাট করে ফেলেছে। রাতে মনে হয় জীবিত প্রাণী নয়, কাতারে কাতারে পড়ে আছে মরা মানুষ। হিন্দু বাড়ি বলে মুসলিম কৃষকপাড়া থেকে একটু দূরে। গ্রামের মানুষরা রোজই এ বাড়ির খবরাখবর নিতে আসে। সাধ্যমতো দিয়ে যায় খাবার দাবার। তাদের কাছেই অরণ্য শুনেছে চওড়া চওড়া এই সোপান শ্রেণী আসলে দর্শক গ্যালারির কাজে আসত। বারো মাসে তের পার্বণের রকমারি উত্সব হতো। গ্রামের নাম গোবিন্দপুর। যুবকদের জে কেটি ক্লাব থেকে নাটক হতো খোলা আঙিনায়। যাত্রা দল আসত ঢাকা থেকে। কবির লড়াই তভচা গান পৌষ ফাগুনের নানা পালা। বাবুরা বসতেন চেয়ারে চাতালে। সাধারণরা সিঁড়িতে। আজও তারা সিঁড়িতেই। তবে বসে নয়, শুয়ে। চোখে আনন্দ নেই, আছে অনিদ্রার দুঃস্বপ্ন।

ক্ষেতের আল, মেঠোপথ এমনকি সাহা বাড়ির ভিটার তলার রাস্তা দিয়ে এবেলা ওবেলা হেঁটে যায় প্রতিদিন রাজধানী ঢাকার পলাতক বাসিন্দারা। তাদের কাছে জানা যায়, ওই ভয়ঙ্কর মহানিশার পর পাকবাহিনী জ্যান্তারা আক্রমণ আর করেনি। তবে দমননীতির যত নিষ্ঠুর প্রাগৈতিহাসিক পন্থা রয়েছে, সবই ঘটছে অন্ধকারে। বাঙালিরা নিজ ভূমে পরবাসী। কোণঠাসা, জিম্মি জীবনযাপন করে বেঁচে আছে। শোনা যাচ্ছে নদী-নালা, খাল-বিলে পানি এলে ওদের নীল নকশায় রয়েছে গ্রাম-গঞ্জ আক্রমণের রাক্ষুসে তৃষ্ণা।

কয়েক ঘর চাকুরে ছিল। সরকারের নির্দেশে তারা ফিরে গেছে ঢাকায়। অনেকে পরিবার রেখে একলাই গেছে। এদের একজন হয়ে অরণ্যও ঘুরে এসেছে। তাদের পৈতৃক ভিটা দখল করে নিয়েছে এক বিহারি মাস্তান। দোকানটা লুট হয়ে পড়ে আছে তালাবদ্ধ অবস্থায়। শহর এখনো স্বাভাবিক নয়। তবে গোটা বিশ্বের চোখে ধুলো দিতে মহাপ্রলয়ের ঘটনাকে অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে চালানোর চেষ্টা চলছে। নগর একদম স্বাভাবিক, সেটা দেখানোর চেষ্টা। নবী ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। বরেণ্যকে ভর্তি করানো হয়েছিল হাসপাতালে। ওখানে তখন অগুনতি আহত মানুষ মারা গেছে। নবী ভাই বরেণ্যর খোঁজ আর পায়নি। অরণ্য নিজে জুলাই পর্যন্ত খুঁজেছে। না, কেউ দিতে পারেনি সন্ধান। পাড়া থেকে যে গায়েবি জানাজার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, তার মধ্যে নাম ছিল বরেণ্যর।

রাত্রির চোখ আর পানি ঝরায় না। সারাক্ষণ উদাস হয়ে থাকে, এর মধ্যেই চলে যাপিত জীবন। উঠানে একসঙ্গে জ্বলে অনেকগুলো মাটির চুলা। রাজধানীর দিকে চালান যেতে পারে না বলে অসম্ভব সস্তা মাছ, তরিতরকারি, দুধ। সাহাদের গোয়ালে দুধেলা গরু আছে একটা। প্রতিবেশীরা দুধ দিয়ে যায় রাত্রিকে।

দিনের বেলা রকিকে নিয়ে খুব একটা সমস্যা হয় না। কিন্তু রাতে সে একদম বোতল ধরে না। রাত্রি দেহে কাবু ছিল কনিক পেইনে। মনে মনে কেমন কেমন হতে লাগল বরেণ্যর হারিয়ে যাওয়ার সত্য জেনে। ছোট ছোট উন্মাদনার লক্ষণ। পাড়াগাঁয়ের যে কবিরাজ সে স্বর্ণ সিঁদুর খাওয়ায়। কাজে আসে না খুব একটা। বর্ষা মৌসুম সেবার শুধু খান সেনাদের আগাম আনার আতঙ্ক নিয়ে এল না। শহরের লঞ্চ থেকে নামিয়ে নিয়ে এল ডা. আসিরুদ্দিনকে। মুক্তিসেনাদের গোপন ওষুধপত্রে সহযোগিতা দেওয়ার গুপ্ত খবরের পরিপ্রেক্ষিতে পাক সৈন্যরা তার একমাত্র মেয়েটিকে ক্যান্টনমেন্টে ধরে নিয়ে গিয়ে গণধর্ষণে হত্যা করেছে। কিশোর ছেলেটিকে পাওয়া গেছে সেদিন তিন টুকরা অবস্থায় পাড়ার ডাস্টবিনে। স্ত্রী অর্ধ উন্মাদের মতো বর্ডার পার হয়ে গেছে বড় ছেলের সঙ্গে। তিনি নিজে এসেছেন তার পৈতৃক ঠিকানায়। এখানকার লোকদের দেখাশোনা করে কাটিয়ে দেবেন বাকি জীবন। রাত্রিকে দেখে বলেছেন, ওকে স্বাভাবিক অবস্থায় না আনতে পারলে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

মহাবিপদগ্রস্ত একজনের মতো অরণ্য বলল, আমি কী করব কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। দেশের এই অবস্থায় রাত্রির এই অবস্থা।

ওর সঙ্গে বন্ধুর মতো ব্যবহার কর। এক সময় তোমরা ক্লাসফ্রেন্ড ছিলে না?

জি। আমরা একসঙ্গে গ্র্যাজুয়েন করেছিলাম। তখন রাত্রি আমার বান্ধবীদের একজন ছিল। শুনলাম বিয়ের কারণে আর পড়বে না। মজার ব্যাপার, ঘটকালি বিয়ের ঘটনাচক্রে ও আমাদের বাড়ির বউ হয়ে এল। খুব হাসিখুশি। জীবনটাও আমাদের স্বাভাবিক সুন্দর গোছানো ছিল। পাকিস্তানিদের ব্ল্যাক ম্যাজিকে সব অন্য রকম হয়ে গেল। একমাত্র রকি ছাড়া আর কিছুতে রাত্রি চোখ মন ফেরায় না। এমনকি আপনার ওষুধপত্র যতটা পারে নষ্ট করে ফেলে। ও না খেয়ে মরে যাবে ডক্টর।

রকিকে ওর কাছে বেশি করে থাকতে দাও।

সেও সম্ভব হয় না। রাত্রি পেটের যন্ত্রণায় অস্থির থাকে। রান্নাটান্না আমার তো আসে না। ডাল-ভাত ওই ফোটায়।

মনে মনে কাতর বেশি ভাবান্বিত হয়ে পড়ছিল অরণ্য। এখানকার ওয়েদারও সহ্য হচ্ছে না রাত্রির। স্যান্ডেল ছিঁড়ে গেছে। হাঁটতে হয় খালি পায়ে। কাদামাটি খেয়ে নিচ্ছে পায়ের পাতা। কারা লাগিয়ে দিয়েছে তার জন্য আলতার প্রলেপ। ঠোঁট ফেটে রক্ত পড়ছে। ওষুধ হিসেবে ঘন ঘন লাগাচ্ছে লিপস্টিক। তবু দিন দিন কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে রাত্রি। হঠাত্ ঠিক আকস্মিক বলা যাবে না, খুবই জাগতিক ব্যাপার কিন্তু ফল হলো অলৌকিক। সায়ম বেলায় বারান্দায় বসে ছিল। হঠাত্ রাত্রির চিত্কার-অরণ্য, এ্যাই অরণ্য!

কি জানি আবার কী ঘটল। আজকাল শুভ কিছু আর মাথায় আসে না। ছুটে ঘরে যেতে দেখল রকি কাঁপা কাঁপা পায়ে হাঁটার চেষ্টা করছে। হাঁটু গেরে বসে দুহাত বাড়িয়ে দিতে রকির মুখ দিয়ে প্রথম দুটি শব্দ বেরোল-বা-বা...।

রাত্রি যেন ঘোর ঘুম থেকে জাগন্ত গলা নিয়ে উল্লসিত চাপা চিত্কারে বলল, রকি কথা বলছে। তোকে বাবা বলছে।

অরণ্য দুহাতে রকিকে বুকে চেপে ধরতে রাত্রি কাছে এসে বলল, কি পাজি ছেলে দ্যাখ! তেল-নুন দিয়ে বড় করছি আমি। আর ডাকের সময় কিনা বাবা। এই দুষ্টু, বল মা।

ব্যস্ত হচ্চিস কেন? মা তো হাজারবার বলবে।

কথাটা অরণ্যর বলা হয়নি। সে অবাক বিস্ময়ে দেখছিল রাত্রিকে। একাত্তরের পঁচিশে মার্চের আগের রাত্রিকে। খাবার সময় বলল, অরণ্য, তুই কত রোগা হয়ে গেছিস রে। দাড়িটারিও কামাস না বুঝি ঠিকমতো!

অরণ্য জবাব দিতে পারেনি। এক ধরনের আনন্দ চাপা আবেগ ওকে নিশ্চুপ করে রেখেছিল। হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিল। শুনল রাত্রির বেদনাক্লিষ্ট স্বর। সেই সঙ্গে রকির কান্না। ব্যস্ত হয়ে বলল, কী হয়েছে?

আমার না সে ব্যথাটা হঠাত্ মাথাছাড়া দিচ্ছে। তুই একটা কাজ করবি। জানিস তো আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে এ সময়। আমি পারছি না, রকির মুখে নিপলটা দিয়ে দে।

হাত-পা ঠাণ্ড হতে থাকল অরণ্যরও। যন্ত্রণার সঙ্ষ্ট রেখা রাত্রির মুখে, দেহ সঙ্কোচনে বাচ্চাটার কান্না বাড়লে পাশের ঘরের প্রতিবেশীদের কেউ এসে দরোজায় নক করবে। এক খেপা বদমেজাজি বুড়ি আছে, সে জেগে গেলে রক্ষা নেই। রাত্রি বলল, কই রে?

গলা শুকিয়ে কাঠ। ঢোক গিলে অরণ্য বলল, আমি তো এসব জানি না রে।

জানতে হয় না। রকিকে আমার বুকের সঙ্গে সাঁটিয়ে দে। আর ব্রার হুকটা খুলে দে পেছন থেকে আমার।

রাত্রি অরণ্যর হাত ধরল। কাজটা করে অরণ্য সরে যেতে চেয়েছিল। পারল না। প্রচণ্ড বিস্ময় অন্তরাত্নায়। নির্নিমেষ সে তাকিয়ে রাত্রির বুকের দিকে। এক সময় ঘোরকাটা মানুষের মতো বলল, পেটে ব্যথা বলছিলি না। আমি যাই পুকুরঘাট থেকে কাদামাটি নিয়ে আসি।

যাবি না। রোজ রোজ তুই পায়ের দিকেই বা শুবি কেন? রকি আজ ওপাশে শোবে। তুই এপাশে।

রাত্রির কথার শেষে অরণ্য হারিকেনের নিভু নিভু আলোয় সলতে উসকে দিয়ে এক ধরনের কষ্টের ভেতর থেকে বলল, রাত্রি, আমরা কিন্তু স্বামী-স্ত্রী নই। বিপাকে পড়ে এক সঙ্গে থাকছি। কাল সকালে-

কথা শেষ করতে পারল না। গ্রামীণ নিস্তব্ধ হাওয়া ভেসে শোনা গেল শত মানুষের হাঁক-ভাই রে সজাগ হও। বড় গাঙের কুমির খালে ঢুকে পড়েছে।

তার মানে পাকিস্তানি সেনাদের যেকোনো একটি সাঁজোয়া লঞ্চ পদ্মা থেকে শাখা নদীতে ঢোকার চেষ্টা করছে। গ্রামের স্বেচ্ছাসেবী যুবকদের হাতে হাতে জলন্ত মশাল। জেগে গেছে গোবিন্দপুর, বাঁশখালী, রানীরহাট। যে গ্রামই আক্রান্ত হোক লোকজন একবস্ত্রে পালায় অন্য গ্রামে। মশাল নিভে যায়। চারদিকে শুরু হয় ত্রাহি ত্রাহি এলাহীকাণ্ড। কে একজন সাহাবাড়ির উঠান পার হতে গিয়ে চিত্কার করে গেল, ও মিয়া, ঘরের বাত্তি নিভান। দুশমনরা নোয়াপাড়া নামছে। এই দিকেও আসতে পারে।

অরণ্য হারিকেন নিভিয়ে দিল। শুনল রাত্রি বলছে, আমার ভয় করছে। ভীষণ ভয়! অরণ্যের ভেতর থেকে কেউ যেন বলিয়ে নিল, আমি আছি। আমি আছি।

সেই কষ্ট ছাপিয়ে উঠল রাত্রির প্রায় অসঙ্ষ্ট স্বর, তুমি আমায় আরো সর্ঙ্শ কর। ভুলিয়ে দাও এই ভয়াল রাতের সব আতঙ্ক।

বাইরের আঙিনায় পলাতক কিংবা আশ্রয়প্রার্থী মানুষের ছোটাছুটি। ভেতরের একজোড়া নর-নারী তখন কোন আদিম খেলায় কখন জড়িয়ে গেছে, ভুলে গেছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড নিজেরাও জানে না। জানে না নিশিযাম কখন শেষ হয়েছে। পুবের আকাশে রোজকার মতো আপন নিয়মে দীপ্তি দাহ ছড়াচ্ছে সূর্য। কোমল মিহি আলোয় রাত্রির ঘুমন্ত মুখ তৃপ্ত, সুস্বপ্নময়। রকি জেগে ওঠার আগে অবশ্য ওকে মায়ের বুকের কাছে সরিয়ে নিয়ে এল। স্তনবৃন্ত স্থাপন করল মুখের কাছে, যাতে হঠাত্ করে সুখনিদ্রা না ভাঙে রাত্রির।

পায়ে পায়ে চলে এল ডা. আসিরের চেম্বারে। সব শুনে তিনি বললেন, যে সমর্ঙ্ক হয়েছে সেটা নষ্ট করো না। হয়তো আমার ওষুধের চেয়ে এটাই বেশি কাজে দেবে।

কিন্তু?

তোমার ভাইয়া জীবিত থাকলে এদ্দিনে ফিরে আসতেন। এই যুদ্ধ কবে শেষ হবে তাও কেউ জানে না। নানা রকম পরীক্ষার ভেতর বাঙালিদের বেঁচে থাকতে হবে। বাঁচতেই হবে। শৃঙ্খলমুক্ত করতে হবে বঙ্গ জননীকে। রকিদের কাছে রেখে যেতে হবে এই অত্যাচারের খবর।

অরণ্যর পিঠে একটি হাত বুবিয়ে ডা. আসির একটু চুপ করে থেকে আবার বললেন, তোমাকে বুঝতে পারছি। তোমাদেরও বুঝতে হবে এই সময়টাকে। স্বামী-স্ত্রী সমের্কর জন্য সাক্ষীর প্রয়োজন হয়। আমি তোমাদের সেই সাক্ষী। ফজরের নামাজ আদায় করে পরম করুণাময়ের কাছে আমি তোমাদের জন্য দোয়া চাইব।

রাত্রিকে নিয়ে অরণ্যর ভাবনা ছিল। ফিরে দেখল রাত্রি ঘর সংসার নিয়ে স্বাভাবিক, যেমন দেখেছে সেই কালরাত্রির আগে। দুপুরে দরোজা বন্ধ করে কাছে ডেকে বললন, অরণ্য কিছুটা সময় ঘুমিয়ে নে।

অরণ্য খাটে আসতে ওর দুগালে দু হাত রেখে আবার বলল, খোঁচা খোঁচা দাড়িগুলো কেট ফেলবি। বড্ড লাগে।

ওর চোখে চোখ ডুবিয়ে অরণ্য প্রশ্ন করেছে, তুই ভালো আছিস তো?

তোর কি মনে হয়?

আছিস। ভালো আছিস।

সত্যি ভালো আছি। এবার একটু ঘুম পাড়িয়ে দে দেখি,

অরণ্যর কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুঝে তখনি রাত্রি আবার বলল, খালি দুঃস্বপ্ন আর দুঃস্বপ্ন দেখি। এগুলো আর দেখতে চাই না...।

পালংয়ের একদিকে টালমাটাল পায়ে হাঁটতে চেষ্টা করছে রকি। সেই সঙ্গে মুখে বা-বা-বা... আওয়াজ, যেন যুগান্তের পর অরণ্য রকির মুখে দেখল সুন্দর মিষ্টি হাসি। সেই হাসিতে যে চমক ছিল, দুষ্টু ছেলে বল মা-মা-মা...।

সেটা ছিল শরত্ ঋতু। দেশ স্বাধীন হলো শীতে।

অরণ্যরা ফিরে পেয়েছে পৈতৃক ভিটা। ভাইয়ার বন্ধু আরহাম তার কাছে গচ্ছিত রাখা মালামালে নতুন করে সাজিয়ে দিয়েছে গুলিস্তানের দোকান। জীবনে এসেছে রিমি। রকি খুশি হয়নি। বলেছে, তোমরা বলেছিলে আকাশ থেকে কেউ আসবে। কিন্তু কই, নতুন খেলনা গাড়ি এল না। এল একটা জ্যান্ত পুতুল। ছেলেরা কি পুতুল খেলে?

ওকে কোলে তুলে অরণ্য-রাত্রি একসঙ্গে বলেছে, এই পুতুলটা এসেছে আমাদের সবার সঙ্গে খেলার জন্য।

রিমির বয়স যখন পাঁচ, দোকান লকআপ করে গাড়িতে উঠতে যাবে, অরণ্যর মনে হলো কে যেন ঘুরে দাঁড়ালো তার দিক থেকে। বড় চেনা ভঙ্গি। ছুটে গিয়ে সামনে থেকে তাকে আটকাল। ঘন দাড়ি-গোঁফে মুখ ঢাকা থাকলেও বরেণ্যকে চিনে জড়িয়ে ধরল। বরেণ্য কালরাত্রির সেই ছোবল থেকে কী করে বেঁচেছিল নিজেও বলতে পারে না। কারা তাকে বর্ডার পার করিয়ে কোথায়, কীভাবে চিকিত্সায় নব জীবন দিয়েছিল তাও জানে না। মানসিকভাবে সুস্থ হয়েছে মাত্র দু মাস আগে। বাড়ি ফিরতে কিছুতেই রাজি হলো না। বলল, তোদের জীবন যেমনি চলছে চলুক। গত এক মাসে আমি শুধু দূর থেকে তোদেরই দেখেছি। আমি দেহে-মনে পুরো সুস্থ হয়তো আর কখনো হব না। শান্তি পাই নানা পীরের দরগায় গিয়ে। বাকি জীবন সেখানেই কাটিয়ে দেব। আমার খবর ওদের কাউকে দিস না। ওরা যেমন আছে তেমনি থাকবে...।

তারপর কেটে গেছে আরো কয়েক বছর। কে একজন সংবাদ বহন করে এল ক্লিনিক থেকে। বরেণ্য মরণশয্যায় রকিকে দেখতে চায়।

দুই.

বাবা, আমায় দোকানে কেন ডেকেছ?

অরণ্য যেন বহু দূর থেকে কার কণ্ঠ শুনল। ফিরে এল বর্তমানে। কাছে দাঁড়িয়ে তরুণ রকি। টেবিলের ধারের চেয়ার থেকে ওঠে অরণ্য বলল, কারণ আছে। এখান থেকে আমাদের এক জায়গায় যেতে হবে।

গাড়িতে সংক্ষেপে কথা বলে ক্লিনিকে এল। বরেণ্যর শেষ অপেক্ষাটুকু বুঝি রকির জন্যই ছিল। রকি কাছে এসে বলল, তুমি আমার বাবা।

বরেণ্য ওর হাত বুকে চেপে ধরে ঘোলাটে চোখে তাকিয়ে বলল, জন্মসূত্র তাই বলে। কিন্তু তোর আসল বাবা অরণ্য। এর চেয়ে বেশি বলার মতো অবস্থা আমার নয়। কি জানি কেন তোকে বড্ড দেখতে ইচ্ছে হলো। তাই তো ডাকলাম।

অরণ্য বরেণ্যর দুহাত চেপে ধরল নিজের মুখে। অশ্রু জমাটবাঁধা গলায় বলল, রাত্রিকে নিয়ে আসি।

না, ওকে আর এর মধ্যে টানিস না। কোনো লাভ নেই ক্ষতি ছাড়া। রকি, তুই আমার কাছে আয়।

রকি হাঁটু ভেঙে বসতে, নার্স ছুটে আসতে গিয়ে ডাক্তারের ইঙ্গিতে থেমে গেল। রকি এক সময় টের পেল বরেণ্যর হূদসঙ্ন্দন থেমে গেছে। কিন্তু আশ্চর্য উজ্জ্বল দুই চোখের দ্বীপ্তি। সেই দৃষ্টি নিয়ে বরেণ্যর শেষ কথা ছিল, যে বেইমান পাকিস্তানি আর ওদের দোসরদের কারণে বাঙালিদের নানা ট্র্যাজেডি, তাদের তোরা কখনো ক্ষমা করিস না।

সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০০৪ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত